Durga Puja and Independence Day: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক দেবী দুর্গা…

Durga Puja and Independence Day: দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে রোজ যোগ দিচ্ছে বঙ্গ মায়ের বীর সন্তানেরা। আর ঠিক সেই সময়ে সাধারণ জনগণকে সংঘবদ্ধ করে তোলার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠল এই দুর্গাপুজো।

Durga Puja and Independence Day:  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক দেবী দুর্গা...
Follow Us:
| Updated on: Oct 10, 2024 | 5:41 PM

প্রহর গোনা শেষ হয়েছে। মা এসেছেন বাড়িতে! সেই উপলক্ষ্যে মণ্ডপে মণ্ডপে উৎসুক জনতার ভিড়। নতুন নতুন জামাকাপ পরে জোরদার প্যান্ডেল হপিং। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো নয়, এই পুজো আক্ষরিক অর্থেই যুগ যুগ ধরে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের উৎসব মঞ্চ হয়ে উঠেছে। ধর্ম-জাতপাতের বিভেদ ভুলে, মানুষ মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে।

তবে কী ভাবে দুর্গাপুজো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তকমা ছেড়ে সাধারণ মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠল?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের পাতায়। সময়টা উনিশ শতকের গোড়ার দিক। দেশ মাতৃকাকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করবার জেদ ততদিনে চেপে বসেছে বঙ্গবাসীদের মধ্যে। গোটা দেশ জুড়ে এক উত্তাল সময়। দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে রোজ যোগ দিচ্ছে বঙ্গ মায়ের বীর সন্তানেরা। আর ঠিক সেই সময়ে সাধারণ জনগণকে সংঘবদ্ধ করে তোলার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠল এই দুর্গাপুজো।

সেই সময় ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে লড়াই, সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জ্বালাময়ী ভাষণে প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছে সাহসী তরুণ-তরুণীরা। এমন সময় বিপ্লবী আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলতে ১৯১৯ সালে প্রথম উত্তর কলকাতার বাগবাজারে শুরু হল সর্বজনীন পুজোর। সেই সময়ে পুজোর নাম ছিল নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো।

সিমলা ব্যায়াম সমিতির উদ্যোগে পরিচালিত বারোয়ারি পুজোয় সুভাষ চন্দ্র বোস ও শরৎচন্দ্র বোস।

তখন কলকাতার পুজো বলতে মূলত বনেদি বাড়িগুলির পুজো। সেখানে আবার সবসময় সাধারণের প্রবেশাধিকার থাকত না। আমন্ত্রণ পেলে তবেই যাওয়ার অনুমতি ছিল। তার উপর সব সময় সাহেবদের আনোগোনা লেগেই আছে। এমতাবস্থায় বাগবাজারে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন এলাকাবাসীরা। সাধারণ মানুষের জন্য পুজো। তাই নাম হল সর্বজনীন পুজো। বাগবাজারের এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে গেলেন নগেন্দ্র নাথ ঘোষাল, হেম মুখোপাধ্যায়, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী লাল চট্টোপাধ্যায়ের মতো সমাজ সংস্কারক ও স্বদেশী কর্মীরাও। তাঁদের উদ্যোগেই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ হল। কলকাতার প্রথম সর্বজনীন পুজোর সঙ্গে জুড়ে গেল নেতাজির নামও। পুজোয় নেতাজি আসবেন! তাই তাঁকে দেখতেই ঢল নামলো সাধারণ মানুষের। সেখানে নেই কোনও জাত-পাতের ভেদাভেদ। তাঁকে ঘিরে মানুষের এই উন্মাদনাকেই কাজে লাগাতে চাইলেন নেতাজি। পুজোর মণ্ডপেও তাঁর মুখে শোনা গেল বিপ্লবের বাণী। পুজোর মণ্ডপ হয়ে উঠল স্বাধীনতা সংগ্রামের মঞ্চ। পরবর্তীকালে ১৯৩৮-৩৯ সালে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজোর সভাপতিও হয়েছিলেন নেতাজি।

আবার এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও। তাঁর মেয়র থাকার সময়, ১৯২৮ সালে নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজোর পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়ে চলে আসে বর্তমানের বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোর মাঠে। নাম পরিবর্তন হয়ে হল ‘বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব’। ১৯২৯ সাল থেকে নেতাজির অনুপ্রেরণায় ওই মাঠেই পুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হল স্বদেশী মেলার। বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে বিক্রি হতে শুরু হল স্বদেশী সামগ্রী। বেজে উঠল স্বদেশী গান।

শুধু বাগবাজার নয়, পরবর্তকালে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার একাধিক পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। সেই তালিকায় রয়েছে আদি লেক পল্লী, কলকাতা ৪৭ পল্লী, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যয়াম সমিতি সহ আরও অনেক ক্লাব। তাঁকে দেখতে এই সব পুজোয় ভিড় করতেন সাধারণ মানুষ। আর সেই ভিড়কে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রতী করে তোলার সচেষ্ট ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে নেতাজির দেখানো পথে হেঁটেছিলেন চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও।

বিবেকানন্দ রোডের সিমলা ব্যয়াম সমিতির পুজোর সঙ্গেও রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের যোগ। ঋষি অরবিন্দ ও বাঘা যতীনের এক সময়ের সহযোগী যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী অতিন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে ১৯২৬ সালে শুরু হয়েছিল এই পুজো। এই ক্লাব হয়ে উঠেছিল স্বদেশীদের আখড়া। এই পুজোয় ছিল এক বিশেষ রীতিও। অষ্টমীর দিনটিকে বীরাষ্টমী রূপে পালন করার চল শুরু করেন পুজোর উদ্যোক্তরা। সারা বছর ধরে অস্ত্র শিক্ষার যে প্রশিক্ষণ গোপনে চলত, এই দিন তাঁর পরীক্ষার দিন। আয়োজন করা হত নানা প্রতিযোগীতার। দেবীর সামনেই চলত লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, তরোয়াল চালানোর মতো প্রতিযোগিতা। এছাড়াও যাত্রাপালা, কবিয়াল গান, পুতুল খেলা ইত্যাদি বিনোদন মূলক পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে চলত দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।

দুর্গা পুজোর স্বদেশী পোস্টার।

ইংরেজি পত্রিকা ‘অ্যাডভান্স’-এ এই পুজোকে ‘স্বদেশী ঠাকুর’ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে, ভয়ে ১৯৩২ সালে তিন বছরের জন্য নিষদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই পুজো। পরে ১৯৩৯ সালে পুনরায় শুরু হয় মাতৃ আরাধনার।

অন্যদিকে ১৯৩৭ সালে বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কয়েকজন মিলে হেদুয়ার কাছে কাশী বোস লেনে দুর্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেমন কথা তেমন কাজ, শুরু হল দুর্গাপুজোর। পুজোর আড়ালেই চলত লাগল বিপ্লবী কার্যকলাপও।

পুজোর মণ্ডপে চামড়ার বুট পরে ওঠার সাহস ছিল না ব্রিটিশ পুলিশের। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাল দুর্গাপুজোর আয়োজকরা। পুজোতেও এক অভিনব নিয়ম প্রথার প্রচলন করলেন বিপ্লবীরা। এক জনের বদলে ১১জন পুরোহিত মিলে শুরু করলেন মাতৃ আরাধনার। আসলে পুজো করত একজনই, আর বাকিরা ছিলেন বিপ্লবীর দলের সদস্য। ছদ্মবেশে,সাধারণ মানুষের দিকে পিঠ করে বসে, মায়ের মণ্ডপেই গোপনে চলত সমিতির কাজ। ঠিক করে নেওয়া হত আন্দোলোনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে!

তবে কেবল সর্বজনীন পুজোগুলিই নয়, পরবর্তীকালে বহু বনেদি বাড়িও অংশগ্রহণ করেছিল এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে। সরাসরি না হলেও, স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে বহু পরিবার। ডায়মন্ড হারবারের নন্দীবাড়ির সদস্য নিজেই জড়িয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন জেলে। শেষে পুজোর আগে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। সেই বছর থেকেই প্রতিবাদে মায়ের গায়ের বিদেশি কাপড়ের পরিবর্তে পরানো হয় স্বদেশী শাড়ি।

আবার কলকাতায় বহু বাড়িতেও পুজোয় বিদেশির পরিবর্তে স্বদেশী সামগ্রী ব্যবহারের চল শুরু হয়। এমনকি দশমীতে বিসর্জনের পরে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে বাড়ি আসতেন অনেকেই। আবার কিছু বাড়িতে অসুরের মুখ তৈরি করা হয় সাহেবদের মুখের আদলে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ধারায় ভাগীদার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামও। মায়ের আগমনের সঙ্গে স্বদেশী বোধকে মিশিয়ে কবিতা লিখে ব্রিটিশ শাসকের রোষানলের মুখে পড়েন তিনি। করতে হয় কারাবাস।

এভাবেই বৃটিশ বাংলায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় দুর্গাপুজোর চল। আর পুজোকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পরে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা। সময়ে সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেবী দুর্গা জাগ্রত হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে।