‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’
অর্থাৎ ‘মা ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও বড়।’ মা হল প্রত্যেক সন্তানের কাছেই সবচেয়ে নিরাপদ এবং শান্তির আশ্রয়। মা যেমন সবার চেয়ে বেশি স্নেহ করে ও ভালবাসে, তেমনই সন্তান কিছু ভুল করলে শাসন করে জীবনের সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে। ঠিক একইভাবে শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের স্নেহ ও ভালবাসা দেয় এবং জীবনে এগিয়ে যেতে তাদের সঠিক পথ দেখায়।
এ কথা সত্য যে এক জন মায়ের জায়গা হয়তো কেউ নিতে পারে না। কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় এক দিকে যেমন এক জন শিক্ষক হিসাবে কঠোর হতে হয়, অন্য দিকে মাতৃত্বসুলভ ভালবাসাও নিজের মধ্যে রেখে এগোতে হয়। এই উভয়েরই উৎকৃষ্ট ভারসাম্যের ফলস্বরূপ হলেন একজন ‘মা-শিক্ষক’। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই কারণেই শিক্ষকের বদলে ‘মা- শিক্ষক’ এই পরিভাষাটির উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সেই নিষ্ঠার সঙ্গে সেই সত্ত্বার পালন করে যাচ্ছেন শ্রীময়ী সরকার।
শ্রীময়ী পেশায় সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁর কাছে শিক্ষকের ভূমিকা মায়ের মতোই। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাস্তবে মা এবং শিক্ষক উভয়েরই সত্ত্বা এক জন শিক্ষকের মধ্যে থাকাটা খুবই প্রয়োজন। না হলে শিক্ষার্থীর সঠিক বিকাশ হয় না।”
দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকতা করার দরুন এই নিরিখে বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতাও রয়েছে শ্রীময়ীর। তার একটি উদাহরণ পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তিনি। এই গল্পটি আবেগের। এই গল্প বাস্তবতার সাক্ষী।
আরাধ্যা দিক্ষীত সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। বিদ্যালয়ে আসার প্রাথমিক পর্যায়ে আরাধ্য়া ছিল অত্যন্ত অন্তরমুখী। আর পাঁচটা ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে সহজে মেলামেশা করে উঠতে পারত না সে। ওকে দেখে শ্রীময়ীর মনে হয়েছিল, তাঁর সন্তানও হয়তো এরকমই ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতে পারে স্কুলে গিয়ে। এই বিষয়ে শ্রীময়ী বলেন, “হয়তো আমার সন্তানও ওরই মতো বিদ্যালয়ের পরিবেশের সঙ্গে, সে ভাবে মানিয়ে নিতে নাই পারতে পারে। তাই আরাধ্যাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিতাম আমি।”
আরাধ্যার পঠন-পাঠন ব্যবস্থার মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য শ্রীময়ী নিয়মিত ওর সঙ্গে কথা বলে ওর চলার পথটা সরল করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। আরাধ্যার সমস্যাগুলো বোঝা থেকে শুরু করে, ওর মনে যে ভাবনা-চিন্তাগুলো চলত সেগুলোকেও বোঝার করার চেষ্টা করতেন তিনি। টিফিনের সময় টিফিন খেতে খেতে গল্প করতেন আরাধ্যার সঙ্গে, যাতে ওর মধ্যে জড়তা কেটে যায়। আর পাঁচটা ছাত্রছাত্রীর মতোই জড়তা কাটিয়ে সকলের সঙ্গে মেলামেশা করে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে।
দেখতে দেখতে বেশ কিছু মাসের মধ্যেই আরাধ্যা জড়তা কাটিয়ে এক জন উজ্জ্বল ছাত্রী হিসেবে নিজের অবস্থান সুনিশ্চিত করে। ধীরে ধীরে শুধু বন্ধু বানানোই নয়, আরাধ্যা ক্লাসের সকল বিষয়ে নিজের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে থাকে এবং পারদর্শিতার সঙ্গে সমস্ত বাঁধাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলার পথকে সুগম করে। আর ওর এই সাফল্যই বলে দেয় শিক্ষার্থীর জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা মায়ের থেকে কম কিছু নয়।
আরাধ্যার জীবনে এমন পরিবর্তনে অবাক আরাধ্যার মা-ও। তিনি বলেন “শ্রীময়ী ম্যাডাম আমার মেয়ে আরাধ্যা দীক্ষিতের জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে এক জন। ক্লাস শিক্ষিকা হিসাবে তিনি আমার মেয়ের জীবন গঠনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মায়ের মতো আরাধ্যাকে আগলে রেখেছেন। আমার সন্তানের সার্বিক বিকাশের প্রক্রিয়ায়, শ্রীময়ী আমার সন্তানের জন্য দ্বিতীয় অভিভাবক হিসাবে সমান্তরাল ভূমিকা পালন করছেন। তাই, মা দিবসের প্রাক্কালে, আমি সেন্ট ফ্রান্সিস অ্যাকাডেমির শিক্ষিকা শ্রীময়ীকে ধন্যবাদ জানাই স্কুলে দ্বিতীয় অভিভাবক হিসেবে আমার মেয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য।”
এই ছোট ছোট কারণগুলির জন্য মাতৃ দিবস শিক্ষকদের জীবনে, বিশেষ করে মহিলা শিক্ষকদের জীবনে একটা বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়। শ্রীময়ী বলেন, “এক দিকে মা, অন্য দিকে শিক্ষক হিসাবে জীবনের সার্থকতা তখনই খুঁজে বার করতে পারব, যখন আরাধ্যার মতোই অসংখ্য শিশুকে আমি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও সঠিক আদর্শে দীক্ষিত করে তাদের ভবিষ্যত আলোকিত করে তুলতে সক্ষম হব।”
মনে রাখতে হবে, আজ যারা শিশু কাল তারাই আমাদের ভবিষ্যত। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মের আরও বেশি সাফল্য সুনিশ্চিত করতে, তাকে মায়ের স্নেহ, ভালবাসা প্রদানের পাশাপাশি, শিক্ষকের আদর্শ, দীক্ষা ও চেতনাবোধের সামঞ্জস্যের মধ্যে দিয়ে যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে সেটাই হবে এই সমাজের যুগান্তকারী পরিবর্তন।