কোহলিকে শো-কজ নোটিস পাঠানোর কথা না ভেবে সৌরভকে পরিণতবোধ দেখাতে হবে

বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, বিরাট কোহলিকে শো-কজ নোটিস পাঠানোর কথা ভেবেছিলেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও সৌরভ দাবি করেন, এই খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিরাটকে শো-কজ করার কথা না ভেবে বরং এখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হিসেবে সৌরভকে অনেক বেশি পরিণতবোধ দেখাতে হবে।

কোহলিকে শো-কজ নোটিস পাঠানোর কথা না ভেবে সৌরভকে পরিণতবোধ দেখাতে হবে
কোহলিকে শো-কজ নোটিস পাঠানোর কথা না ভেবে সৌরভকে পরিণতবোধ দেখাতে হবে
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 23, 2022 | 4:13 PM

বিরাট কোহলি (Virat Kohli) বনাম ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড দ্বৈরথ ঘোরতর জটিল জায়গায় পৌঁছিয়েছে। বলা ভালো, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) বনাম বিরাট কোহলির সংঘাত ক্রমশ জট পাকিয়ে চলেছে। সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রাণভোমরা ছিলেন, সেই দিনগুলোর কথা মনে করলে দেখা যাবে, তিনি টিম ইন্ডিয়াকে জেতানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দলের মধ্যে জেতার অভ্যাসও তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি সতীর্থদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর আগ্রাসন, হাবভাব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে অন্য মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিল।

২০০০-২০০৫ সৌরভ যখন ক্যাপ্টেন ছিলেন এবং তারপর গ্রেগ চ্যাপলের সময় তিনি যখন দল থেকে বাদ পড়েছিলেন– পুরো অধ্যায়ের ব্যাপারে মনে করলে দেখা যাবে, তাঁর অধীনে ভারতীয় ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছিল। সৌরভ সেই সময় যথেষ্ট প্রশংসা কুড়োতেন। তাঁর লড়াকু মনোভাব, জেদ, অদম্য সাহসে ভর করে ভারত এগিয়ে চলত।

তাঁর পরের দুই প্রজন্ম সৌরভকে সেভাবেই স্মরণ করে। সেই অধিনায়ক যিনি কিনা ভারতীয় ক্রিকেটের মেরুদণ্ড ইস্পাতের মতো কঠিন করে গড়েছিলেন। কিন্তু কিছু কিছু সময় অতীত বর্তমানের বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে যখন অতীতকে আঁকড়ে রাখার প্রবণতা বাড়ে, তখন এই সমস্যাও বাড়তে থাকে। ক্রিকেটার হিসেবে সৌরভের যে ছবিটা ছিল, ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রধান হিসেবে সেই ছবিটা একদমই বিপরীত। সৌরভ অনেক সময় গুলিয়ে ফেলেন যে, ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর যে জনপ্রিয়তা ছিল তা তাঁর বর্তমান পরিস্থিতিতে, বর্তমান দায়িত্বের সঙ্গে খাপ খায় না। কারণ তিনি এখন অন্য দায়িত্বে রয়েছেন। বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব পালন করা তাঁর প্রধান কাজ।

বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, বিরাট কোহলিকে শো-কজ নোটিস পাঠানোর কথা ভেবেছিলেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও সৌরভ দাবি করেন, এই খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিরাটকে শো-কজ করার কথা না ভেবে বরং এখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হিসেবে সৌরভকে অনেক বেশি পরিণতবোধ দেখাতে হবে।

যখন ভারতের একজন সেরা অধিনায়ক বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের পদে বসেন, তখন যে কেউ আশা করবে তিনি ক্রিকেটারদের ব্যাপারে একটু বেশি সংবেদনশীল হবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শুরুটা এক প্রকার বোর্ড ও কোহলি দ্বৈরথ দিয়ে শুরু হয়েছিল। এই সফরে ভারতীয় দলের কাছে ইতিহাস গড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু কোথায় কী! দুই ফরম্যাটের সিরিজ হেরে দেশে ফিরতে হচ্ছে টিম ইন্ডিয়াকে। যেখানে ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল, সেখানে বিপর্যয়ের মুখে পড়ল ভারত। সৌরভ-বিরাটের বাক্যবিস্ফোরণ দিয়ে শুরু হয়েছিল সফর। টেস্ট সিরিজের পর আরও বড় ধাক্কা খেল ভারত। বিরাট সাদা জার্সির ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দিল। বিরাট-বোর্ড সংঘাতের জন্য প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ভাবে সৌরভের দিকে আঙুল তুলেছেন। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার দিলীপ বেঙ্গসরকর খালিজ টাইমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, পুরো ব্যাপারটাই। আমি মনে করি ক্রিকেট বোর্ডের এটাকে আরও পেশাদারভাবে পরিচালনা করা উচিত ছিল। নির্বাচক কমিটির হয়ে ওর কথা বলার কোনও প্রয়োজন ছিল। সৌরভ বিসিসিআইয়ের সভাপতি। এই বিষয়টা নিয়ে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের কথা বলা উচিত ছিল।”

প্রোটিয়া সফরের শুরুতে ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় এই বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। সেঞ্চুরিয়ন টেস্ট জয়ের পরই নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান চেতন শর্মা বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। তিনি বলেন, ‘ বিসিসিআইয়ের প্রত্যেকে কোহলিকে টি-২০-র ক্যাপ্টেন্সি না ছাড়ার অনুরোধ করেছিলেন, যে কথা রাখেননি বিরাট। অন্যদিকে প্রোটিয়া সফরে আসার আগে কোহলি দাবি করেছিলেন, তিনি যখন টি-২০-র ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার কথা বোর্ডকে জানিয়েছিলেন, তখন তা ভালোভাবেই বোর্ডের তরফ থেকে মেনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চেতন শর্মা বলেন, বোর্ড যেহেতু সীমিত ওভারের ফর্ম্যাটে এক অধিনায়ক চায়, তাই কোহলিকে ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।’ ওই ঘটনার পর থেকে ভারত আর কোনও ম্যাচে জেতেনি। টেস্ট সিরিজের দুটো ম্যাচে হারের পর ওয়ান ডে সিরিজের দুটো ম্যাচেও হেরেছে ভারত।

পিঠের চোটের কারণে জোহানেসবার্গে দ্বিতীয় টেস্টে খেলতে পারেননি বিরাট। এরপর কেপটাউন টেস্টের পর তিনি ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার খবর ঘোষণা করেন। তার পর ওয়ান ডে সিরিজে সাধারণ ব্যাটার হিসেবে দেখা গিয়েছে কোহলিকে। কিন্তু দর্শকদের দাবি, মাঠে কোথাও যেন সেই আগ্রাসী বিরাটকে আর দেখা যাচ্ছে না। এর পর ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলবে ভারত। রয়েছে আইপিএলও। সব কিছুর মধ্যেও কোথাও থেকে যাবে সৌরভ বনাম কোহলি দ্বৈরথ।

গত চার মাসে ভারতীয় ক্রিকেটে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এক নজরে যদি দেখা যায় কোহলি ও বোর্ডের সংঘাতের ছবি…

১. সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১ — টি-২০ বিশ্বকাপের ঠিক আগে, বিরাট ঘোষণা করেন তিনি টি-২০ ফর্ম্যাটের ক্যাপ্টেন্সি বিশ্বকাপের পরই ছেড়ে দেবেন। তবে ওয়ান ডে ও টেস্টে দেশকে নেতৃত্ব দিতে চান।

২. ডিসেম্বর ৮, ২০২১ — কোহলিকে ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।

৩. জানুয়ারি ১৫, ২০২২ — কোহলি টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরে দাঁড়ালেন।

চার মাসের মধ্যে তিন ফর্ম্যাটেই আর অধিনায়ক থাকলেন না বিরাট কোহলি। ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভের থেকে বেশি রাজনীতির ব্যাপারে কেউ ভালো জানেন না। সৌরভের সঙ্গে গ্রেগ চ্যাপেলের সংঘাতের স্মৃতি এখনও সবার মনে টাটকা। সৌরভের জন্য, চ্যাপেল কাহিনী ভুলে যাওয়ার সব থেকে ভালো উপায় হল কোহলির প্রতি চ্যাপেলের মতো আচরণ না করা। এটা হতেই পারে যে সৌরভ সঠিক এবং কোহলি ভুল। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে একটা সময় এই পরিস্থিতিতে নিজে থেকে, এবং দলের জন্য কোহলি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা জেনেও সৌরভের উচিত বর্তমান পরিস্থিতি সামলানো।

নতুন কোচের অধীনে আইসিসি ট্রফিকেই টার্গেট করছে ভারত। কোহলি দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন, সে কথা ভেবে তাঁকে সাহায্য করতে হবে। কোহলিকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য প্রয়োজনে সৌরভকে এগিয়ে আসতে হবে।

বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে সৌরভকে বুঝতে হবে, স্বীকার করতে হবে, ব্যাটার কোহলিকে দরকার। অধিনায়ক হিসেবে না হলেও ব্যাটার হিসেবে কেরিয়ারে এখনও অনেক সাফল্য পাওয়া বাকি বিরাটের। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে সৌরভকে বুঝতে হবে। নির্মম মনে হলেও, এটাই সত্যি যে ভারতীয় ক্রিকেটে কোহলিকে যতটা প্রয়োজন তার থেকে বেশি প্রয়োজন সৌরভকে।