যানবাহন-কলকারখানা থেকে নির্গত ‘ওয়েস্টেজ হিট’ থেকে বিদ্যুৎ, যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি অধ্যাপকের

কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের জেরে রসায়নের দুনিয়ায় এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে সফল হয়েছেন ডক্টর কণিষ্ক বিশ্বাস এবং তাঁর সহযোদ্ধারা।

যানবাহন-কলকারখানা থেকে নির্গত ‘ওয়েস্টেজ হিট’ থেকে বিদ্যুৎ, যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি অধ্যাপকের
অধ্যাপক কণিষ্ক বিশ্বাস- জহরলাল নেহেরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্স সায়েন্টিফিক রিসার্চ (JNCASR)-র বিজ্ঞানী।
Follow Us:
| Updated on: Feb 27, 2021 | 7:59 PM

মোবাইল ফোন চার্জে বসানোর পর মাঝেমধ্যেই সেটা গরম হয়ে যেতে দেখেন?

শুধু মোবাইল ফোনই বা কেন, একটানা ল্যাপটপে কাজ করার পর কিংবা চার্জে বসানোর পর ল্যাপটপের তলাটাও গরম হয়ে গিয়েছে, এমনটা লক্ষ্য করেছেন তো? একই ঘটনা লক্ষ্য করা যায় বাস কিংবা গাড়ি বা মোটরবাইক, অটোর ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও। অনেকটা পরিমাণ তাপ ওই যানবাহন বা বিভিন্ন গ্যাজেট থেকে নিষ্কাশিত (নিষ্কাশিত নাকি নির্গত) হয়। আর এই নির্গমন হওয়া তাপের সাহায্যেই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স জিনিস চালানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী এবং বর্তমানে অধ্যাপক ডক্টর কণিষ্ক বিশ্বাস। সহজ কথায় ‘ওয়েস্টেজ হিট’ পরিণত হবে বিদ্যুতে।

শুনতে ম্যাজিক মনে হলেও বাস্তবে এমন যুগান্তকারী আবিষ্কার ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন কণিষ্ক। মার্কিন জার্নাল ‘সায়েন্স’ স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁর গবেষণাকে। এই গোটা প্রজেক্টের পুরোধা ছিলেন কণিষ্ক নিজে। আর তাঁর মিশনে সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরই ছাত্র হুগলির বাসিন্দা শুভজিৎ রায়চৌধুরি। বর্ধমানে তিনি জার্মানিতে পোস্ট ডক্টরেট করছেন জার্মানিতে (জার্মানি শব্দটা ২বার ব্য়াবহৃত হয়েছে)। এ ছাড়াও রয়েছেন বর্ধমানের তন্ময় ঘোষ। ইনিও পোস্ট ডক্টরেট করছেন। তিন বঙ্গ সন্তানের মিলিত প্রচেষ্টায় এদেশের বুকে হয়েছে এক অভিনব আবিষ্কার।

মূল আবিষ্কার-

ডক্টর বিশ্বাস জানিয়েছেন যে, তাঁরা এমন একটা সলিড মেটেরিয়াল (সলিড মেটেরিয়াল-এর বাংলা) তৈরি করেছেন, যা তাপমাত্রার ফারাক থেকে ভোল্টেজ বা বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে।

কীভাবে হবে এই ম্যাজিক-

আমরা প্রতিদিন যেসব যানবাহনে চড়ি, সেগুলো পেট্রল বা ডিজেলে চলে। এক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ জ্বালানি গাড়ির ইঞ্জিনে ভরলে মাত্র ৩০ শতাংশ গাড়ি চালাতে কাজে লাগে। বাকি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ তাপ হয়ে যানবাহনের এগজস্ট পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

কণিষ্কবাবুর কথায়, “এই এগজস্ট পাইপের কাছে আমাদের তৈরি ডিভাইসটা ধরলে সেটা ওই নিষ্কাশিত (নিষ্কাশিত নাকি নির্গত) তাপের প্রভাবে গরম হবে। আর এই তাপ থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে আমাদের মেটেরিয়াল উত্তম তড়িৎ পরিবাহী, কিন্তু তাপ পরিবাহক হিসেবে কাজ করবে না।” দীর্ঘদিন ধরে উত্তম তড়িৎ পরিবাহক অথচ তাপ পরিবাহক নয় এমন এক উপাদানের খোঁজে ছিলেন ডক্টর বিশ্বাস ও তাঁর টিম। অবশেষে সেই উপাদানই আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কী-কী কাজে লাগবে?

ছোট যানবাহনের ক্ষেত্রে ওয়েস্টেজ হিট থেকে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করা যাবে। গাড়িতে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ চার্জ দেওয়া যাবে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। ধরা যাক, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল শোধনাগার, স্টিল কারখানা, কেমিক্যাল কিংবা রঙের কারখানা, এসব জায়গাতেও ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ তাপ নিষ্কাশিত হয়েই থাকে। সেই বর্জ্য তাপকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

মোবাইল হোক বা ল্যাপটপ কিংবা ফ্রিজ সব জিনিস থেকেই ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ তাও নির্গত হয়। ওই পরিমাণ ওয়েস্টেজ হিটের অনেকটাই বিদ্যুতে পরিণত করা সম্ভব হবে কণিষ্ক এবং তাঁর টিমের তৈরি মেটেরিয়াল বা ডিভাইসের সাহায্যে। এর পিছনে রয়েছে কোন বিজ্ঞান-

যে উপাদান নিয়ে কণিষ্ক এবং তাঁর টিম কাজ করেছেন, তাঁর নাম সিলভার অ্যান্টিমণি টেলুরাইড।

ডক্টর বিশ্বাসের কথায়, “এই সিলভার এবং অ্যান্টিমনি খুবই বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী উপাদান। এরা নিজেরা জানে না একটা সলিড স্ট্রাকচারের মধ্যে কোথায় গিয়ে বসলে খাপ খাবে। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে ক্যাডমিয়ায় ডোপিং করালে এই উপাদানগুলি বুঝতে পারে তারা ঠিক কোথায় গিয়ে বসলে ফিট করবে। অর্থাৎ উপাদানগুলি অর্ডারে চলে আসে এবং থার্মোইলেকট্রিক পারফর্ম্যান্স বেড়ে যায়। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে এমন একটা সলিড উপাদান প্রয়োজন, যার এক দিক হবে গরম, অন্য দিক হবে ঠাণ্ডা। যেমন ধরুন, ল্যাপটপের তলাটা গরম হয়। সেখানে আমাদের তৈরি ডিভাইস রাখলে তার এক দিকেই তাপ আসবে, অন্য দিকে যাবে না।”

বাস্তবের প্রসঙ্গ টেনে সহজ-সাবলীল উদাহরণও দিয়েছেন কণিষ্কবাবু। তাঁর কথায়, “ধরা যাক কাচ। এই উপাদান না তাপ পরিবাহক, না তড়িৎ পরিবাহক। অন্য দিকে, অ্যালুমিনিয়াম বা তামার তার একাধারে তাপ এবং তড়িৎ পরিবাহক। আমরা এমন একটা উপাদান খুঁজছিলাম যার মধ্যে কাচের এবং ধাতুর একটা করে বৈশিষ্ট্য থাকবে। অর্থাৎ সেই উপাদান তড়িৎ পরিবাহক হবে, কিন্তু তাপ পরিবাহক নয়। এটা সাংঘাতিক বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের কাছে।”

শেষ পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের জেরে রসায়নের দুনিয়ায় এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে সফল হয়েছেন ডক্টর কণিষ্ক বিশ্বাস এবং তাঁর সহযোদ্ধারা।

গ্রাফিক্স- অভিজিৎ বিশ্বাস