আলিপুরদুয়ার: পঞ্চায়েত ভোটের আগে অস্বস্তি যেন পিছু ছাড়ছে না রাজ্যের শাসক দলের। আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকার ও রাজ্যের শাসক দল বার বার আদিবাসী ও উপজাতিদের নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অথচ আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) জেলায় যে অভিযোগ উঠে আসছে, তাতে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আলিপুরদুয়ার ১ নম্বর ব্লকের পাতলাখাওয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। সেখানে ১২/৩৫ নম্বর বুথে প্রায় ৪০-৪২ ঘর উপজাতিদের বাস। অভিযোগ উঠছে, সেখানে উপজাতি-আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের জমি ‘বেআইনিভাবে’ কিনে নেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, এমন প্রায় ৪৫ বিঘা জমি নাকি কিনে নেওয়া হয়েছে।
সাধারণত, আইন অনুযায়ী আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের জমি অন্য সম্প্রদায়ের কেউ কিনতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন গ্রামবাসীরা, তিনি এলাকার তৃণমূল নেতা ধীরেন বর্মণ। শাসক দলের পাতলাখাওয়া অঞ্চলের সভাপতি তথা এসসি-এসটি সেলের সভাপতিও তিনি। জানা গিয়েছে, ওই নেতা তফসিলি উপজাতির নন, তিনি তফসিলি জাতিভুক্ত গোষ্ঠীর। সেক্ষেত্রে কীভাবে তিনি উপজাতি সম্প্রদায়ের জমি কিনতে পারেন তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
পাতলাখাওয়া গ্রামের ওই এলাকার দুর্গাচরণ চিক বড়াইক ও দুর্গন চিক বড়াইকের বেশ কিছু জমি ছিল। দাগ নম্বর ৯৫৮ এবং খতিয়ান নম্বর ৯৭/৯৬। ধীরেন বর্মণ ও তাঁর অনুগামীরা ওই এলাকার বিস্তর আদিবাসী জমি কিনে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠছে। পাশাপাশি অনেক জমি বর্গাদারদের হঠিয়ে দখলও করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। এই এলাকার গ্রামবাসীরা চরম দরিদ্রতার মধ্যে দিনযাপন করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা। অভিযোগ উঠছে, সাময়িকভাবে টাকার লোভ দেখিয়ে উপজাতিদের জমি কিনে নিয়েছেন ওই তৃণমূল নেতা ধীরেন বর্মণ। সংবাদমাধ্যমের সামনে এই নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। এমন অবস্থায় তাঁরা কোথায় যাবেন, কী করবেন, ভেবে কূল পাচ্ছেন না। তাঁদের সাফ বক্তব্য, “ট্রাইবাল জমি তো কেনা-বেচা হয় না। কী করে এসব তৃণমূল নেতা করছেন?”
যদিও বিষয়টি নিয়ে ওই তৃণমূল নেতা ধীরেন বর্মণের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “ওরকম কোনও ব্যাপার নেই। আমি আইনতই করেছি। আমার কাছে দলিল আছে, খতিয়ান আছে। আমি টাকা দিয়ে কিনেছি। অতটাও নয়, ৮-১০ বিঘে হবে।”
জানা গিয়েছে ওই জমিতে এখন তৃনমূল নেতা ধীরেন বর্মণ গড়ে তুলেছেন পাতলাখাওয়া ফার্মার প্রডিউসার কোম্পানি লিমিটেড। করছেন ড্রাগন ফলের চাষ। তিনি ওই জমিতে কোম্পানি খুলে মাছ চাষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন চাষাবাদ করছেন বলে জানা গিয়েছে।
প্রোকেটশন অব এসসি এসটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, তফসিল উপজাতিভুক্তদের জমি তফসিল উপজাতিভুক্তরা ছাড়া অন্যরা কিনতে পারেন না। তবে সরকার যদি কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য জমি নেয়, তবে তা গ্রহণ করতে হবে। আইনজ্ঞ মহলের একাংশ বলছেন, যদি উপজাতিভুক্তদের জমি অন্য সম্প্রদায়ের কেউ কেনেন, তা একপ্রকার বেআইনি। তাহলে কীভাবে নেতা দাবি করছেন, তিনি যা করেছেন আইনত করেছেন?
বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত জানার জন্য টিভি নাইন বাংলার প্রতিনিধি যোগাযোগ করেছিলেন অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের প্রোজেক্ট অফিসার কাম ডিস্ট্রিক্ট ওয়ালফেয়ার অফিসার সজল তামাংয়ের সঙ্গে। তিনি জানাচ্ছেন, “তফসিলি উপজাতিদের জমি কিনতে পারেন উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্তরাই। সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই। যদি সেই জমি নন-ট্রাইবালরা কেনেন, তবে সেক্ষেত্রে বিসিডব্লিউ সেকশন থেকে অনুমতি লাগে। আবেদন করতে হবে। সেটির শুনানি হবে। এর জন্য বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। আবেদনের পর দফতর পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে, তবেই কেনার অনুমতি মিলবে। তবে ওই নেতা জমি কবে কিনেছেন, তা বিএলআরও অফিসই বলতে পারবে। জেলা থেকে শুধু অনুমতি দেওয়া হয়।”
গ্রামবাসীদের এই ক্ষোভের বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিএলআরও-১ অপর্ণা মণ্ডলের সঙ্গেও। তিনি অবশ্য জানাচ্ছেন, কোথাও বলা নেই তফসিলি উপজাতিদের জমি অন্যরা কিনতে পারেন না। আইনের চ্যাপ্টার দুই অনুযায়ী, সেই অনুমতির জায়গা আছে। বিএলআরওকে পাতলাখাওয়ার গ্রামবাসীদের ক্ষোভের কথা জানাতে, তিনি বলেন, “এমন কোনও অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। তবে আদিবাসীদের জমি অন্যরা কিনতে পারেন না এমন তো কথা নেই। আইনের চ্যাপ্টার দুইয়ে এমন একটি জায়গার কথা উল্লেখ রয়েছে।” তবে যদি আগামীতে তাঁর কাছে এমন কোনও বিষয়ে কোনও অভিযোগ আসে, তিনি তা খতিয়ে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৫৫-র চ্য়াপ্টার ২-এ অনুযায়ী আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্তদের জমি কেনা সংক্রান্ত ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেখানে ১৪ বি ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যদি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনও ব্যক্তির জমি অন্য সম্প্রদায়ের কেউ কিনতে চান, তাহলে রেভিনিউ অফিসারের অনুমতি প্রয়োজন। যদি ওই জমি এলাকার ও সম্প্রদায়ের কোনও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলেই এই ব্যতিক্রম হতে পারে। সেখানে এও বলা হয়েছে, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে ওই জমি কিনতে দেওয়ার অনুমতি রেভিনিউ অফিসার তখনই দেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন, যখন দেখা যাবে ওই জমিটি তৎকালীন বাজারদর অনুযায়ী তফসিলি উপজাতির কেউ কিনতে চাইছেন না।
আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গতবছর ঝাড়গ্রামে এক সরকারি কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী কড়া ভাষায় বলেছিলেন, আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর করা যাবে না। আদিবাসীদের জমি আদিবাসীদেরই থাকবে। রাজ্য সরকার এই নিয়ে আইনও করেছে। আগামী দিনে গোটা দেশে যাতে এই নিয়ম চালু হয়, তার জন্যও সেদিন সওয়াল করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রামবাসীদের এই অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল তৃণমূলের আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি প্রকাশ চিক বড়াইকের সঙ্গেও। তিনি বলেন, “বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছেই শুনলাম। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি এরকম হয়, তাহলে ওই নেতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”