মাদারিহাট: ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ঘাস ফুল সরকার। কিন্তু সেবারও আলিপুরদুয়ারের একটা প্রত্যন্ত এলাকা, মাদারিহাট বিধানসভার মানুষ বরাবরই তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন, যেখানে ল্যান্ড স্লাইড ভিক্ট্রি পেয়েছে, সেবারও মাদারিহাট ঝুলিতে পুরতে পারেনি তৃণমূল। কিন্তু এবারের উপনির্বাচনে মাদারিহাটে ফুটল জোড়া ফুল।
মাদারিহাটের জয়ের মধ্যে দিয়েই চা বলয়ের মাটি শক্ত করল তৃণমূল। জয়প্রকাশ টোপ্পোর হাতেই মাদারিহাটে এত বছরে উড়ল সবুজ আবির। ব্লক সভাপতি হিসাবে মাদারিহাটের মাটি চষে খেয়েছেন তিনি। তাই তাঁর জনসংযোগও প্রবল। আর সেই ফ্যাক্টরই কাজ করে গিয়েছে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
মাদারিহাট এক সময়ে ছিল আরএসপি-র শক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতে ২০১৬ সালে প্রথম পদ্ম ফোটে। তারপর থেকে একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাদারিহাটে বিজেপির ভোটে অল্প অল্প করে থাবা বসাতে শুরু করে তৃণমূল। উপনির্বাচনে তা ছিনিয়ে নিল।
জন বার্লা ফ্যাক্টর?
কিন্তু কেন হার বিজেপির? তাহলে কি জন বার্লার ক্ষোভ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াল? উপনির্বাচনের বাকি পাঁচ কেন্দ্র নিয়ে আত্মবিশ্বাসী না থাকলেও মাদারিহাট নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল বিজেপি। কারণ বরাবরই উত্তরবঙ্গের মাটিতে গেরুয়া শিবিরের ভিত মজবুত ছিল। ‘২৪ এর নির্বাচনেও সাতটি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে ফুল ফোটাতে পেরেছিল তৃণমূল। বাকি সবতেই ফোটে কানন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খেলা ঘুরাতে শুরু করেছিল তৃণমূল। ২০২৩ সালে পদ্ম শিবির ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন সুমন কাঞ্জিলাল। উপনির্বাচনের আগে থেকেই বেসুরো হয়ে উঠেছেন জন বার্লা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, উত্তরবঙ্গ নিয়ে বিজেপি কোথাও ‘ওভার কনফিডেন্ট’ হয়ে গিয়েছিল। তাই জন বার্লার মনে যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল, তা বিশেষ তোয়াক্কা করেনি বিজেপি।
জন বার্লা নাম না করে মনোজ টিগ্গার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন একাধিকবার। প্রকাশ্য সভা থেকে শরু করে সাংবাদিকদের সামনেও। বারবার এলাকায় নাম না করে মনোজের উদ্দেশে আক্রমণ শানিয়েছেন, একনায়কতন্ত্রের তত্ত্ব খাঁড়া করেছেন। গত লোকসভা নির্বাচনেও ভোটের প্রচারে সেভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি জনকে। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রচারে এলেও, সেই মঞ্চে আনা যায়নি জন বার্লাকে। যদিও সব ছাপিয়ে আলিপুরদুয়ারে ভালো ফল করে বিজেপি। কিন্তু মাদারিহাটের উপনির্বাচন, যেখানে এটিমাত্র বিধানসভায় মুখ রক্ষার বিষয়, সেখানে বিজেপি মুখ রক্ষা করতে পারল না।
এবারের দলের হারের পরও জন বার্লাকে বিস্ফোরক কথা বলেছেন। দল তাঁকে ব্যবহারই করেনি বলে দাবি করেছেন জন। যদিও মনোজ টিগ্গা হারের জন্য ব্ল্যাকমেইলের রাজনীতির কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, তৃণমূল নাকি ভয় দেখিয়ে, লক্ষ্মীর ভান্ডারের ভয় দেখিয়ে ভোট করিয়েছে। কিন্তু তাতে চেপে থাকেনি বার্লা-বিতর্ক।
তৃণমূলের প্রেস্টিজ ফাইট
বিজেপি-র এই কলহকে কাজে লাগিয়েছে তৃণমূল। উপনির্বাচনেও উত্তরবঙ্গকে একেবারে পাখির চোখ করে এগিয়েছে তৃণমূল। ভোটের কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গ গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাগান ঘুরেছেন তিনি। করেছেন জনসংযোগ। বাগান শ্রমিকদের জন্য কয়েকটি প্রকল্পও কাজ করে গিয়েছে। জয়প্রকাশের কথায়, “বিজেপি দশ বছর শুধু ছিল। কিন্তু কোনও কাজ করেনি। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছে। ওদের সুখে দুখে আমরাই ছিলাম।” আর এদিন যেন তারই প্রমাণ দিল মাদারিহাট।
একটা উপনির্বাচনে মাদারিহাটে প্রথম দাঁত ফোটাল তৃণমূল। যেটা তৃণমূলের কাছে ছিল একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। এবারের নির্বাচনই ছিল তৃণমূলের কাছে সুবর্ণ সুযোগ, বিজেপির হাত থেকে মাদারিহাট ছিনিয়ে নেওয়ার। আর সেই সুযোগকে ভীষণভাবে কাজে লাগিয়েছে ঘাসফুল। তবে এই প্রথম নয়, এরকম এর আগেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে জিত হয়েছে তৃণমূলের। যেমন ধূপগুড়ি। বিজেপির হাত থেকে ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্র এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়েছিল শাসক তৃণমূল।শাসকদলের নির্মলচন্দ্র রায়ের হাত ধরে ধূপগুড়িতে ওড়ে সবুজ আবির। তাই উত্তরবঙ্গে আরও এক ইতিহাস গড়ল তৃণমূল।