বাঁকুড়া: অনেকেই আছেন যাঁরা সিগারেটের বদলে বিড়িতে সুখটান দিতেই বেশি ভালবাসেন। বিভিন্ন ব্রান্ডের বিড়ি সেবন করেন তাঁরা। কিন্তু এই বিড়ি বানানো যদি বন্ধ হয়ে যায়? কেন উঠছে এ প্রসঙ্গ? আসলে বিড়ি শ্রমিকরা বলছেন, সরকারি সাহায্যের অভাবে ধুঁকছে এই শিল্প।
সরকারিভাবে কেন্দু পাতার সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির কথা বারবার শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। কিন্তু সহায়ক মূল্যে যাঁদের এই কেন্দু পাতা কেনার কথা, সরকারি টালবাহানায় জঙ্গলমহলের সেই সমবায়গুলিতে গত এক দশকে একের পর এক তালা পড়েছে। ফলে জঙ্গলমহলে একপ্রকার বন্ধ কেন্দু পাতা সংগ্রহ। ভিন রাজ্য থেকে কেন্দু পাতা কিনে বিড়ি শিল্প চালাতে গিয়ে উৎপাদন খরচের ভারে ধুঁকছে বিড়ি শিল্প। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব মিলিয়ে শুধু বাঁকুড়া লোকসভা এলাকাতেই লক্ষাধিক মানুষের রুজি রুটিতে টান পড়ছে। স্বাভাবিক ভাবেই লোকসভা নির্বাচনের মুখে শাসক বিরোধী সকলের মুখেই উঠে আসছে বিড়ি শিল্পের সঙ্কটের কথা।
বাঁকুড়ার অন্যতম বড় কুটিরশিল্প বিড়ি বাঁধাই শিল্প। এই শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কেন্দু পাতা। একসময় বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে এই কেন্দু পাতা সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন হাজার হাজার আদিবাসী ও তপশিলি মানুষ। কেন্দু পাতা সংগ্রহ ও বাছাই করে তাঁরা সেই পাতা সহায়ক মূল্যে বিক্রি করতেন লার্জ এরিয়া মাল্টিপারপাস সোসাইটি নামের সমবায়গুলিতে। সরকারি অর্থ সাহায্যে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দু গাছগুলি কাটিংয়ের কাজ করত এই সমবায়গুলি। নিয়মিত গাছ কাটিং হওয়ায় ভাল মানের পাতাও মিলত। সেই পাতাই সমবায়গুলির মাধ্যমে নির্দিষ্ট দরে পৌঁছে যেত জেলার বিড়ি কারখানাগুলিতে। সেখান থেকে কাঁচামাল নিয়ে কখনো কারখানার ভিতরে আবার কখনো নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অবসর সময়ে বিড়ি বাঁধাই করতেন শিল্পীরা।
কেন্দু পাতা সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিড়ির বিপনন এই পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যে বাঁকুড়ায় যুক্ত আছেন লক্ষাধিক মানুষ। বাঁকুড়া শহরেই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার। অভিযোগ, কিন্তু গত এক দশকে বছরের পর বছর ল্যাম্পস নামের সমবায়গুলিতে পরিচালন সমিতির নির্বাচন না হওয়ায় ল্যাম্পস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে জটিলতা। অন্যদিকে কেন্দু গাছ কাটার জন্য সমবায়গুলিকে দেওয়া সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে থাকায় নিয়মিত গাছ কাটার কাজ বন্ধ কয়েক বছর। ফলে গাছে থেকে মিলছে না ভাল মানের পাতা। আর এইসব কারণে জঙ্গলমহলের অধিকাংশ ল্যাম্পস কার্যত নিষ্কৃয় হয়ে পড়েছে। জঙ্গলমহলে কেন্দু পাতা তুলে যে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের রুজিরুটি চালাতেন তাঁরা অধিকাংশই কাজ হারিয়েছেন।
সমবায় গুলি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বিড়ি বাঁধাই শিল্পে। স্থানীয় ভাল মানের পাতা না মেলায় ভিন রাজ্য থেকে আমদানি করা কেন্দু পাতার উপর ভরসা করতে হচ্ছে বিড়ি কারখানাগুলিকে। একদিকে বাড়তি দামে কাঁচামাল কেনা আর অন্যদিকে জিএসটির ভারে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে না পেরে বহু বিড়ি কারখানার দরজায় তালা পড়েছে। যেগুলি বেঁচে আছে সেগুলিও ধুঁকছে।
আশপাশে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, বিড়ি শিল্পের এই সর্বনাশ বাঁকুড়া লোকসভায় তৃণমূলের কাছে বড় কাঁটা। বিজেপি রাজ্য সরকারকে দুষে প্রচারে ঝড় তুলছে। রাজ্য সরকার ‘কেন্দ্রের বনধন যোজনা’ গ্রহণ না করাতেই হাজার হাজার বিড়ি শিল্পীকে এই সঙ্কটের মুখে পড়তে হচ্ছে দাবী বিজেপি প্রার্থীর। বেকায়দায় পড়ে ভোটের মুখে বিড়ি শিল্পের এই সমস্যা দ্রুত মেটানোর আশ্বাস দিয়ে ভোট চাইছেন তৃণমূল প্রার্থী। কিন্তু কবে মিটবে বিড়ি শিল্পের এই সমস্যা এখন সেদিকেই তাকিয়ে হাজার হাজার মানুষ।
বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরেই বলেছি রাজ্যের এই তৃণমূল সরকার আদিবাসী বিরোধী। বাঁকুড়ার অন্যতম বড় শিল্প হল বিড়ি বাঁধা সংগ্রহ। এই ব্যপারে রাজ্য এগিয়ে আসেননি। রাজ্য সরকারের কো-অপারিটেভের উপর কোনও নজর নেই। এর ফলে আদিবাসী ভাইদের যথেষ্ঠ কষ্ট হচ্ছে।” তৃণমূল প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “ওইগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা চারটে করে সদস্য করে দিয়েছে। আদিবাসীদের সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের।” বিড়ি কারখানার ম্যানেজার অশোক গড়াই জানান, “বিড়ি শিল্প খুবই সঙ্কটে রয়েছে। এর অদূর ভবিষ্যত নেই। পাঁচ-সাত হাজার মানুষ যুক্ত হবে। খুবই শোচনীয় অবস্থা। কারণ বিড়ি ব্যবসা করে আমাদের সংসার চলছে না। কাঁচামালের সংঙ্কট নেই। দাম বেড়ে গিয়েছে। অথচ বিড়ি দাম বাড়েনি।”