শিলিগুড়ি: ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি আর জমির কারিবার একেবারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। হাতে দামি বিদেশি ঘড়ি, অট্টালিকাসম বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ির টাকা নাকি আসে ওই কারবার থেকেই। স্বয়ং মমতার নির্দেশে দলেরই ব্লক সভাপতি গ্রেফতার হতেই সকলের নজরে নবীন এই বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১১ সালে তৈরি হয় এই বিধানসভা আসন। দু দু’বার শাসক নেতাদের ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। এখান থেকে জিতেই মন্ত্রিত্বের স্বাদ পান গৌতম দেব। কিন্তু, দিন যত গড়িয়েছে ততই ঘুরেছে খেলা। ভোটারাও ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। অনেকেই বলছেন জনতার রোষের নেপথ্যে নেতাদের দুর্বিষহ বাহুবলী শাসন আর জমির কারবার। এরইমধ্যে এলাকার রাজনীতির পাড়ায় পায়ের তলার জমি শক্ত করেন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শিখা চট্টোপাধ্যায়।
২০১৪ নাগাদ কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে এসেই ব্লকের সভাপতি হন দেবাশিস প্রামাণিক। দীর্ঘ সময়ে তারই নেতৃত্বে এলাকায় চলেছে দল। মাঝে কিছুটা সময় সুধা সিং ও সাগর মোহন্ত ব্লক সভাপতি হলেও ফের সভাপতির পদ দখল করতেন দেবাশিস। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিসদের ওই আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় তিনি ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। গৌতম ঘনিষ্ট দেবাশিসকে ফের ব্লক সভাপতি করা হয়।
ডাবগ্রাম ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে দু’বারের প্রধান এবং ২০২৩ এ ব্লক সভাপতি ছিলেন সুধা সিং। অভিযোগ, কলকাঠি নেড়ে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্লক সভাপতি হন দেবাশীস। সূত্রের খবর, সুধাকে দেবাশিস গোষ্ঠী গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট দিতে চাননি। তবে শেষমেষ টিকিট নিয়ে লড়ে জেতেন সুধা সিংহ। কিন্তু সুধার গোষ্ঠীর সঙ্গে দেবাশিস গোষ্ঠীর লড়াইয়ের জেরেই ডাবগ্রাম ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি জিতে যায়। তৃণমূলকে বিরোধী আসন নিতে হয়।
এখন গ্রেফতার হয়ে গিয়েছেন দেবাশিস। এক ব্যক্তির জমি দখলের চেষ্টা ও খুনের হুমকির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। কিন্তু একা দেবাশিস কেন? তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে পরপর দুবারের প্রধান সুধার দাবি, “দল সবটা তখন থেকেই জানত। বেশ কিছু জমি আমি রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলাম। বহু অভিযোগ এসেছে। কিছুটা দলকে তখন থেকেই জানাতাম। সংবাদমাধ্যমকেও বলতাম। দল সব জানে তখন থেকেই। মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করেই সবটাই তো বলেই দিয়েছেন। এখন আমি আর কি বলব?”
শোনা যায়, দেবাশিস গোষ্ঠীর চক্ষুশূল সুধাকে হটাতে উঠেপড়ে লাগে দলেরই একটা অংশ। তাদের ইন্ধন দেন দেবাশিস। দলের অন্দরেই দেবাশিস প্রামাণিক ও তার অনুগামীরা সুধাদের কোনঠাসা করার চেষ্টা শুরু করেন। ২০২৩ সালে ব্লক সভাপতি হন সুধা। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় দ্রুত। সুধার আক্ষেপ গ্রাম পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়। বলেন, “আমার ব্লক সভাপতি পদ চলে যায়। দেবাশিস সভাপতি হয়ে নির্দেশ দেন দলের সভায়, মিটিং, মিছিলে আমাকে ডাকা যাবে না। আমি এখন একঘড়ে। সবই তো চলত দেবাশিসের ইচ্ছায়। তাই জেতা পঞ্চায়েত সদস্য হিসেবে কাজটুকু করা ছাড়া দলের কাজে আমাকে ডাকে না প্রামাণিক গোষ্ঠী।”
আরও আক্রমনাত্মক এলাকার আরেক প্রাক্তন ব্লক সভাপতি ও বর্তমানে জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূলের সম্পাদক সাগর মোহান্ত। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতে জমির কারবারে নেতাদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ক্যানসার ব্যাধির সমতুল্য। তার দাবি, এটাই ভবিতব্য ছিল।
সাগরের দাবি, নিজেদের কারবার চালাতেই বিগত সময়ে এলাকায় যুব সভাপতি ও ব্লক সভাপতির পদ থেকে সাগরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চান দেবাশিস। অন্যের গর্ত খুড়ে আজ সেই গর্তেই জেলবন্দী শাসক নেতা। তাঁর দাবি, যখন এসব হচ্ছে সে সময়ে সব জেনেও দল ওদের পাশেই ছিল। সোজা কথায় দুই প্রাক্তন ব্লক সভাপতির দাবি, দলের পদ সামনে রেখেই তৃণমূল সরকারের আমলের শুরু থেকেই নানা সরকারি প্রকল্পে কাজের টেন্ডার পেত দেবাশিসের ঠিকাদারি সংস্থা। ফুলে ফেঁপে উঠত প্রামাণিক ভিলার ভাণ্ডার। সাগর বলছেন, ২০১১ সালে এই বিধানসভা আসন তৈরি হয়। পরপর দু’বার জিতে মন্ত্রী হন গৌতম দেব। কিন্তু নেতাদের বাহুবল, আস্ফালন আর টাকার লোভ, জমির কারবারে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা জেনেও নিয়ন্ত্রন করতে পারেননি গৌতম। ফলে ২০২১ এ হারতে হয় গৌতম দেবকে। ২০২৪ সালেও কার্যত একই ফল।