West Bengal Flood: পশ্চিমে বেনজির বৃষ্টিতে ভাটির জেলায় ‘৭৮-এর দুঃস্বপ্ন ফেরার আশঙ্কা
West Bengal Flood: প্রকৃতির খ্যাপামিতে দুয়ারে "ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি"। আর কবে তৈরি হব আমরা?
কমলেশ চৌধুরী: সাঁড়াশি-সন্ত্রাস। আকাশভাঙা বৃষ্টির পর বাঁধ-জলাধারের ছাড়া জলে বন্যার বিপদ (West Bengal Flood)। আটাত্তর ফিরতে পারে, ভাটির জেলা হাওড়া-হুগলিতে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আতঙ্ক। মাথায় উঠেছে পুজোর প্রস্তুতি। বোধনের আগেই বিসর্জনের ভয়!
অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বড় বিপর্যয় ডাকছে প্রকৃতির এই খ্যাপা প্রবণতা। এই সেপ্টেম্বরেই পুরী জেলার অস্তরঙে একদিনে বৃষ্টি হয়েছিল ৫৩০ মিলিমিটার। এ বার নিম্নচাপের চোখরাঙানিতে অতিবৃষ্টির সাক্ষী বাংলার পশ্চিমাঞ্চল। আসানসোল শহরে একদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৪৩৪ মিলিমিটার। আসানসোলের লছিপুরে ৪১৫ মিলিমিটার। বাঁকুড়ায় বৃষ্টির পরিমাণ ৩৫৪ মিলিমিটার। বুধবার রাত ১১টা থেকে রাত দুটো, তিন ঘণ্টার মধ্যেই ঝরেছে ২০৯ মিলিমিটার বৃষ্টি। দুই জায়গাতেই ভেঙেছে সর্বকালীন রেকর্ড। সেপ্টেম্বরের গড় ধরলে, দেড় থেকে দু’মাসের বৃষ্টি ঝরেছে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়। আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯২২ সালের ২২ জুন ২৯২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল বাঁকুড়ায়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে একদিনে বৃষ্টি হয়েছিল ২৭৪ মিলিমিটার। প্রবল বর্ষণে ভেসেছে সে সব রেকর্ড। দুর্গাপুরে বৃষ্টির পরিমাণ ১৯৯ মিলিমিটার। মুষলধারা ঝাড়খণ্ডেও।
ফল? বৃহস্পতিবার রাতেই হলুদ সতর্কতা ডিভিসিতে। এক লক্ষ ২৫ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া হচ্ছে। শুধু মাইথন-পাঞ্চেত নয়, আসানসোল-দুর্গাপুরের স্থানীয় অতিবৃষ্টির জলও ছাড়তে হচ্ছে দুর্গাপুর ব্যারাজকে। রাতের সর্বশেষ রিপোর্ট, জল ছাড়া হচ্ছে দু’লক্ষ ৩১ হাজার কিউসেক হারে। জুলাইয়ের শেষে ডিভিসি-দুর্গাপুরের ছাড়া জলে বন্যার কবলে পড়েছিল হাওড়া-হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকা। সে সময় সর্বোচ্চ এক লক্ষ ৫৫ হাজার কিউসেক হারে জল ছেড়েছিল দুর্গাপুর। ইতিমধ্যেই তার দেড় গুণ বেশি জল ছাড়া হচ্ছে। তাছাড়া, সেপ্টেম্বর জুড়ে পরপর নিম্নচাপে টানা বৃষ্টি হয়েছে। নদী-নালা-খাল-বিল জলে টইটম্বুর। বিপুল জলরাশি নামতে থাকলে যাবে কোথায়? দু’কূল ছাপিয়ে প্লাবন অবশ্যম্ভাবী। বাঁধ ভেঙে হড়পা বানও হয়ে যেতে পারে।
এত বৃষ্টি কেন? মৌসম ভবনের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছনোর পর খুব ধীরে এগিয়েছে নিম্নচাপ। গতি কমে যাওয়াতেই কয়েকটি অঞ্চলের উপর একটানা বৃষ্টি হয়েছে।” অতিবৃষ্টি এবং তার পরবর্তী জল ছাড়ার পরিমাণের অঙ্ক দেখে আশঙ্কিত সেচ দফতরের প্রাক্তন কর্তা রাজকাপুর শর্মা। তাঁর আশঙ্কা, “বিপুল পরিমাণে জল ছাড়া হচ্ছে। চার মাসের বর্ষা চলার পর এমন বৃষ্টি হলে বন্যা ঠেকানো কঠিন। আটাত্তরের মতো পরিস্থিতি না হয়ে যায়!” একই উদ্বেগ পূর্ব বর্ধমান, হাওড়া, হুগলিতেও। শুধু বৃষ্টি নয়, এই পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনকেও দায়ী করছেন নদী বিশেষজ্ঞ জয়া মিত্র। তাঁর স্পষ্ট কথায়, “বৃষ্টি হবেই। বৃষ্টির পর জল মাটি শুষে নেবে অথবা জল বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দুটোর কোনও পরিস্থিতিই নেই। সর্বত্র কংক্রিট! জল শুষে নেবে মাটি, সে উপায় নেই। নদীর ধারে বাড়ির পর বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। জল যাবে কোথায়? বাড়ি-ঘরই ভাসবে!”
বৃহস্পতিবারই চার মাসের বর্ষার সরকারি মরসুম শেষ হয়েছে। যদিও দেশের কোনও প্রান্ত থেকেই বর্ষার বিদায়-পর্ব শুরু হয়নি। আরব সাগরে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘শাহিন’, ঝাড়খণ্ডের উপর থাকা নিম্নচাপ– মৌসুমি বাতাসকে জোর করেই আগলে রাখছে। রাজস্থান থেকে মৌসুমি বাতাস বিদায় নেওয়া শুরু করতে পারে ৬ অক্টোবর নাগাদ। দিন কুড়ি দেরিতে। মৌসম ভবনের তথ্য বলছে, দেশে বর্ষা স্বাভাবিক। সেপ্টেম্বরে ৩৫% অতিবৃষ্টি। গোটা মাসে পাঁচটি নিম্নচাপ, তার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়, আর একটি অতি গভীর নিম্নচাপ। মাসের একদিন বাদে রোজই কোনও না কোনও নিম্নচাপ ছিল দেশে বা লাগোয়া সাগরে। তার প্রভাবে শুধু সেপ্টেম্বরেই ৪৪৯টি অতি ভারী বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেশে। ৮৯টি চরম ভারী বর্ষণের ঘটনা। অর্থাত্, একদিনে ২০৫ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি। যেমন হয়েছে আসানসোল বা বাঁকুড়ায়।
সেই নিরিখে এ যাত্রায় অনেকটাই রক্ষা কলকাতার। ১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়েছিল মহানগরও। ২৭, ২৮, ২৯ সেপ্টেম্বর বৃষ্টি হয়েছিল যথাক্রমে ২২৩, ৩৬৯ ও ১২৯ মিলিমিটার। তিন দিন মিলিয়ে ৭২১ মিলিমিটার। এ বার সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হয়েছে ৬১৩ মিলিমিটার। ৯৬% বেশি বৃষ্টি। গোটা বর্ষা মিলিয়ে ১,৭৬৯ মিলিমিটার। হওয়ার কথা ১,৩২৬ মিলিমিটার। দমদমে বৃষ্টি হয়েছে আরও বেশি– ১,৯৫৭ মিলিমিটার। পাহাড়ি দার্জিলিঙের (১,৯১৩ মিলিমিটার) চেয়েও বেশি। সেপ্টেম্বরের অতিবর্ষণে একাধিকবার জলমগ্ন হয়েছে কলকাতা, দমদম। কিন্তু নিম্নচাপের রক্তচক্ষু উপকূল আর পশ্চিমাঞ্চলের উপর বেশি পড়ায় কান ঘেঁষে বড় বিপদ থেকে বেঁচেছে মহানগর।
আরও পড়ুন: West Bengal Flood: রেকর্ড পরিমাণ জল ছাড়ছে DVC, বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে সেনা নামাচ্ছে নবান্ন
কিন্তু সার্বিক ভাবে রাজ্যের রেহাই নেই। দক্ষিণে বাঁধ-জলাধারের ছাড়া জলের বিপদ। শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর, কেলেঘাই, কপালেশ্বরী– সব নদীই বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। ভাসতে পারে দুই মেদিনীপুরের একাধিক এলাকাও। আর উত্তরবঙ্গে নিম্নচাপের বিপদ। টানা দুর্যোগের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রমী ঘটনারও সাক্ষী হতে চলেছে বাংলা। ঝাড়খণ্ডের উপরে থাকা নিম্নচাপ উত্তরপ্রদেশের দিকে সরবে। কিন্তু আবার ফিরে আসবে বাংলার দিকে। তার প্রভাবে এ বার দুর্যোগের আশঙ্কা উত্তরবঙ্গে। ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা মালদা ও দুই দিনাজপুরে। পরে একই আশঙ্কা তরাই, ডুয়ার্সেও।
নিম্নচাপের এহেন প্রত্যাবর্তন কেন? সঞ্জীববাবু বলছেন, “একটি পশ্চিমি ঝঞ্ঝা ঢুকেছে কাশ্মীরের দিক থেকে। সেই বায়ুপ্রবাহে ঢুকে পড়বে নিম্নচাপ। ফলে ঝঞ্ঝার ঠেলায় উত্তরপ্রদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিমের ভারতের দিকে যেতে পারবে না নিম্নচাপ। সরে আসবে উত্তরবঙ্গের উপরে।”
প্রকৃতির খ্যাপামিতে দুয়ারে “ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি”। আর কবে তৈরি হব আমরা?
আরও পড়ুন: Weather Update: নিম্নচাপের ইউ-টার্ন! এবার বিরামহীন বৃষ্টিতে ভিজতে চলেছে উত্তরবঙ্গ