Bhabadighi: ‘গ্রিন সিগন্যাল’ মিললেও ট্রেন কি চলবে ভাবাদিঘির উপর দিয়ে?
Hooghly: ইতিমধ্যেই ভাবাদিঘির ৬০০ মিটার বাদ দিয়ে গোঘাট ও কামারপুকুর পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তারকেশ্বর থেকে গোঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলছে ও অন্যদিকে বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি পর্যন্ত রেলের সিআরএস হয়ে গিয়েছে।

রেলমন্ত্রী থাককালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল। আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রী। তাও দেখতে দেখতে দেড় দশক হয়ে গেল। অর্থাৎ ২০০১ সালে যে প্রকল্পের শিল্যানাস হয়েছিল, আজ ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে এখনও দিনের আলো দেখতে পায়নি। কথা বলছি, তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্প নিয়ে। গত ২৪ বছর ধরে স্লথ গতিতে এই রুটের কাজ একটু একটু করে এগিয়েছে, কিন্তু একটা দিঘির সামনে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। সে দিঘির নাম ভাবাদিঘি। এই ভাবাদিঘি এখন বেশ জনপ্রিয়। লোকের মুখে মুখে ফেরে। রেল বলছে ভাবাদিঘি বুজিয়ে প্রজেক্ট হবে, গ্রামবাসীরা বলছে, হবে না। আর এই রেল ও সাধারণ মানুষের তরজা গিয়ে পৌঁছয় আদালতের দোরগড়ায়। শেষমেশ আদালতের হস্তক্ষেপে একটা রাস্তা বেরয়। কী সেই রাস্তা? কী ভাবে হবে এই রেল প্রজেক্ট? আদৌ ভাবাদিঘির ক্ষতি হবে না তো?
ভাবাদিঘির ভৌগোলিক অবস্থান
রবি ঠাকুরের ‘আমাদের পাড়া’ কবিতায় আছে না…
ছায়ার ঘোমটা, মুখে টানি/ আছে আমাদের পাড়া খানি/ দিঘি তার মাঝখানটিতে/ তালবন তারি চারি ভিতে
অথবা শরৎ কবিতায়…
দিঘি ভর জল, করে টলমল। নানা ফুল ধারে ধারে কচি ধান-গাছে, খেত ভরে আছে হাওয়া দোলা দেয় তারে।।
বাংলা কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে এমন দিঘির উল্লেখ অহরহ পাই। আসলে গ্রাম বাংলার জীবনে দিঘি একটা ফুসফুস। যা কেড়ে নিলে সেই গ্রামটাই মৃত হয়ে যায়।
হুগলির গোঘাটে অবস্থিত এই ভাবাদিঘি। দিঘিটির আয়তন ৫২ বিঘারও বেশি। যার অংশীদার রয়েছেন ২৬৮ জনের। তবে এই দিঘি ব্যবহার করেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। এনারা অধিকংশই দিনমজুর বা খেতমজুর। ফলে তাঁদের জীবন-জীবিকায় এই দিঘির ভূমিকা কী তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
সালটা ২০০১
সালটা ২০০১। তখন এনডিএ সরকারের রেলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিনতিনি ঘোষণা করলেন তারকেশ্বর-বিষ্ণপুর রেলপ্রকল্পের। হয় শিলান্যাসও। এই রেল প্রকল্প চালু হলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া সঙ্গে হাওড়ার দূরত্ব অনেকটাই কমবে। ফলত, সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে ধাপে ধাপে শুরু হয় রেল প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পরবর্তীতে মাটি ফেলার কাজ।
কিন্তু বাধ সাধল ভাবাদিঘিতে এসে। রেল প্রায় ৫২ বিঘার ওই দিঘির উত্তর দিকের একাংশ বুজিয়ে রেলপথ পাততে চায়। কিন্তু তা হতে দেবেন না এলাকার বাসিন্দারা। আগেই বলেছি, এই দিঘির উপর নির্ভর করে চলে তাঁদের জীবন-জীবিকা। ফলে দিঘি বুজিয়ে রেলপথ যদি তৈরি হয় তাহলে তাঁদের পেট চলবে কীভাবে? এখান থেকেই শুরু হয় যত সমস্যা।
দিঘি কিছুতেই বুজিয়ে রেলপথ তাঁরা বানাতে দেবেন না বলে স্থির করেন গ্রামবাসীরা। নিজেদের আন্দোলনে পাশে পেয়ে যান পরিবেশবীদদেরও। গ্রামবাসীদের বক্তব্য,দিঘির উত্তর দিকের জমি দিয়ে রেলপথ হোক। কারণ সেখানে ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে। কিন্তু অনড় রেলও। তারা দিঘি বুজিয়েই রেলপথ গড়তে চায়। ফলে, সাধারণ মানুষের আরও বাড়ে জেদ। বাড়ে দিঘি বাঁচানোর তাগিদ। শুরু হয় আন্দোলন-বিক্ষোভ। তৈরি হয় ‘দিঘি বাঁচাও কমিটি।’ রাগ ক্রমেই বাড়ে ভাবাদিঘির মানুষের।
২০১৭ সাল
সালটা ২০১৭। রেলের তরফে খানিক কাজ এগোতেই রণংদেহি মূর্তি ধারণ করেন মহিলারা। সেই সময় ময়দানে আবার নামেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যরা। গ্রামবাসীরা পাশে পান তাঁকে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মার খেতে হয় বর্ষীয়ান আইনজীবীকে। অভিযোগ ওঠে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি সেখানে যেতেই উল্লাসপুরের কাছে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁদের পথ আটকে মারধর করেন। খবর চাউর হতেই আরও ক্ষুব্ধ হন একাংশ মানুষজন।
এরপর এই জট কাটাতে এগিয়ে আসেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাধের প্রকল্প যে বাস্তবায়িত হবেই সে কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকী প্রশাসনিক সভা থেকে মমতা বলেছিলেন ভাবাদিঘি নিয়ে সিপিএমের যারা বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে। তবে এরপরও আন্দোলন দমেনি।
২০১৯ সাল
সালটা ২০১৯। এবার ভাবাদিঘি-জট কাটাতে সুর নরম করেন মমতা। আলোচনায় জোর দেন তিনি। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীদের কাছেও আবেদন করেন তিনি। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গ্রামবাসীদের দেওয়া হবে ক্ষতিপূরণ। তবে ‘দিঘি বাঁচাও কমিটি’ অভিযোগ করে ভুল বুঝিয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
এত বছরে কতটা কাজ এগিয়েছে ভাবাদিঘির?
ইতিমধ্যেই ভাবাদিঘির ৬০০ মিটার বাদ দিয়ে গোঘাট ও কামারপুকুর পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তারকেশ্বর থেকে গোঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলছে ও অন্যদিকে বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি পর্যন্ত রেলের সিআরএস হয়ে গিয়েছে। কামারপুকুর ও জয়রামবাটির মধ্যে রেললাইনের কাজ জোরকদমে চলছে। তৈরি হয়ে গিয়েছে কামারপুকুর রেল স্টেশনও। কাজ আটকে শুধু এই ভবাদিঘিরই।
২০২৫ সাল
হুগলির এই দিঘির জল গড়িয়ে ঢুকে পড়ে কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত। দিঘি বাঁচাও কমিটি দ্বারস্থ হয় কোর্টের। তারা যে নিজেদের অবস্থান থেকে সরছে না,সে ইঙ্গিতও দেয়। তবে বিশেষ সুবিধা হয়নি। কোর্টও জানিয়ে দেয় ভাবাদিঘির জমি তুলে দিতে হবে রেলকেই।
২০২৫ এর ৩ সেপ্টেম্বর এই মামলার শুনানি ছিল কোর্টে। প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়,আগামী ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ভাবাদিঘির ব্রিজের কাজ শুরু করতেই হবে। কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে হুগলি জেলা পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, আগামী ১৭ নভেম্বর উভয়পক্ষকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে কাজ কতদূর এগিয়েছে। আদালত এও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, রেললাইন বন্ধ করা নিয়ে কোনও ধরনের বিক্ষোভ বরদাস্ত করা হবে না। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করতে হবে। কোর্টের পর্যবেক্ষণ, আড়াইশো জনের জন্য আড়াই লক্ষ মানুষের স্বার্থে আঘাত দেওয়া যাবে না। তবে কি জমি জটে কাটল ভাবাদিঘির ইস্যু?
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না! না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তাই যতক্ষণ কাজ পুরোপুরি হচ্ছে, ততক্ষণ বলা কঠিন এই প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা!
তন্ময় বৈরাগীর রিপোর্ট
