হাওড়া : খাগড়াগড় কাণ্ডের পরেও প্রায় কিছুই বদলায়নি এ রাজ্যের চিত্র। এখনও ছড়াচ্ছে জঙ্গি জাল। আর তার কেন্দ্র হয়ে উঠছে বাংলা। অনায়াসেই সেফ প্যাসেজ পেয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা। নবান্নের নাকের ডগায় ডোমজুড় থেকে আনিরুদ্দিন আনসারির গ্রেফতারি সামনে এনে দিচ্ছে সেই বিপদ বার্তাই। দু’দিন আগেই হাওড়ার ডোমজুড় এলাকা থেকে জঙ্গি যোগে গ্রেফতার করা হয়েছে (Arrest in Terror Link) আনিরুদ্দিন আনসারিকে। পরনে ছিল নিতান্তই সাধারণ লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি। স্থানীয় এক মসজিদে শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিল। দেখে বোঝার উপায় নেই, সে জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক পরিচয় দিয়েই থাকছিল ডোমজুড়ে। কিন্তু তলে তলে যে আনিরুদ্দিন অন্য ফন্দি আঁটছিল, তা কেউই বুঝে উঠতে পারেনি।
কয়েকদিন আগেই ভোপালে ধরা পড়ে চার বাংলাদেশি জঙ্গি। ভোপাল এসটিএফের গোয়েন্দারা গ্রেফতার করেন ওই জঙ্গিদের। পরবর্তী, তদন্তে জানা যায়, এক বছর ধরে ভোপালে ঘাপটি মেরে ছিল জঙ্গিরা। ধৃত ওই জঙ্গিদের মধ্যে দুই জন ইসলামিক ছাত্র শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। ভোপালে ধরা পড়া ওই জঙ্গিরা বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল বাংলা টিমের সদস্য ছিল। বাংলাদেশের এই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটি আল কায়দার একটি শাখা। ধৃত ওই জঙ্গিদের জেরা করেই আনিরুদ্দিন আনসারির নাম প্রথম সামনে আসে গোয়েন্দাদের।
কিন্তু কে এই আনিরুদ্দিন আনসারি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমে গোয়েন্দাদের হাতে এমন কিছু তথ্য উঠে আসে, যা দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের জঙ্গিদের এ রাজ্যে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে সিদ্ধহস্ত আনিরুদ্দিন আনসারি। গত পাঁচ বছর ধরে শিক্ষক পরিচয়ে ডোমজুড়ে থাকছিল সে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা জঙ্গিদের নথিপত্র তৈরি করে দিত আনিরুদ্দিন। ভোপালে ধৃত চার জঙ্গিও প্রথমে আনিরুদ্দিনের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল। ইতিমধ্যেই ধৃত আনিরুদ্দিন আনসারির মোবাইল থেকে প্রচুর ডেটা উদ্ধার করতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। মোবাইলের ইন্টারনাল মেমোরিতে পাওয়া গিয়েছে জেহাদি নথির ১২ জিবি পিডিএফ ফাইল। এই পিডিএফগুলি জোগাড় করার জন্য বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেলের ব্যবহার করত সে। জানা গিয়েছে, ভোপালে চার জঙ্গি গ্রেফতার হতেই টেলিগ্রাম অ্যাপটি ডিলিট করে দেয় আনিরুদ্দিন। কিন্তু তারপরেও সেই ডেটার খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
গত সাত মাসে আনিরুদ্দিনের ডোমজুড়ের বাড়িতে দুইবার এসেছিল ভোপালের জঙ্গিরা। আনিরুদ্দিনের বাড়িতে প্রায় চার মাস ছিল তারা। ছাত্র পরিচয় দিয়েই আনিরুদ্দিন তাদের নিজের কাছে রেখে দিত। পরবর্তী সময়ে ভুয়ো আধার কার্ড বানিয়ে দিয়েছিল তাদের এবং সেই আধার কার্ড নিয়েই ভোপালে পাড়ি দিয়েছিল জঙ্গিরা। আরও জানা গিয়েছে, গত এক বছরে মোট নয় জন বাংলাদেশি জঙ্গিকে এ দেশে এনে আশ্রয় দিয়েছিল আনিরুদ্দিন।
এনআইএ এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ সহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অফিসাররা জেরা করতে চান আনিরুদ্দিনকে। সূত্রের খবর, গোয়েন্দারা মূলত দেখার চেষ্টা করছেন যে দেশের তথা রাজ্যের কোথায় কোথায় জঙ্গি জাল বিস্তার করেছে এই সংগঠনটি। সেই সমস্ত হাতে পেলেই এই জঙ্গি জাল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে ডোমজুড়ের ঘটনার পর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কবে স্লিপার সেলের ঘুম ভাঙবে, তার অপেক্ষাতেই বসে থাকবেন গোয়েন্দারা? এরই মধ্যে সন্ত্রাস ডালপালা মেলে মহীরূহ হয়ে উঠবে না তো? জঙ্গি জাল যে ছড়াচ্ছে, তার প্রমাণ রয়েছে একাধিক। কিন্তু এদের আটকাবে কে? গোয়েন্দা ব্যর্থতাই কি ডেকে আনছে বড় বিপদ? সূত্রের খবর, আনিরুদ্দিন আনসারি একা নয়, একটা বিশাল নেটওয়ার্কের অংশ মাত্র। এর শিকড় এতদিনে কোথায় পৌঁছে গিয়েছে, তার উত্তর জানা নেই। এরই মধ্যে যে ছবিটা উঠে আসছে, তা চিন্তা বাড়াচ্ছে রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। বাংলায় জঙ্গিযোগ নিয়ে যখনই কথা হয়, তখনই উঠে আসে খাগড়াগড়ের নাম। তারপরও জেহাদি সংগঠনগুলিকে আটকাতে পারছেন কি গোয়েন্দারা?
জেএমবির পরে এবার আল কায়দার বিভিন্ন শাখা সংগঠন জাল ছড়াচ্ছে ভারতে। আল কায়দা ইন সাব কন্টিনেন্ট বা আকিস – এই নামে এক ছাতার তলায় বেড়ে উঠছে সমমনোভাবাপন্ন সংগঠনগুলি। ২০২০ সালেও আল কায়দা মডিউলের হদিশ মিলেছিল মুর্শিদাবাদে। বাংলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ছড়াচ্ছে জঙ্গি নেটওয়ার্ক। অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশি জঙ্গিদের ট্রানজ়িট হাব হয়ে উঠেছে বাংলা। বাংলার মাটি থেকেই ছড়াচ্ছে জঙ্গি মডিউল। চিন্তা বাড়ছে রাজ্যের। এর জন্য দায়ী কি গোয়েন্দাদের ব্য়র্থতাই? প্রশ্ন উঠছে, এই জঙ্গিদের রুখতে যে কড়া গোয়েন্দা নজরদারি প্রয়োজন, তা কোথায়? এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আগামী দিনে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে? এমন প্রশ্নগুলিই বার বার ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন : Terror link in Howrah: হাওড়ার আমিরুদ্দিনের মোবাইলের ১২ জিবি জুড়ে জিহাদি বই, বিস্ফোরক তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে