জলপাইগুড়ি: ‘চাপে পড়ে ভর্তি করেছি’, সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পাঠিয়ে বলছেন সরকারি শিক্ষকরা
সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সন্তানরা আদৌও কি পড়ে সরকারি স্কুলে? কী বলছেন শিক্ষকরা?
জলপাইগুড়ি: শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষাসামগ্রী মূলত এই নিয়েই শিক্ষা। অনটনের তৃতীয় বিশ্বে এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও একটি বিষয়- ইস্কুলেই পেট ভরা খাবার, পোশাকি নাম মিড ডে মিল (Mid Day Meal)। বুনিয়াদি শিক্ষার (Education) সঙ্গে জড়িত এই সবকটি বিষয়েই অনিময়-বেনিয়ম-দুর্নীতি। যিনি শিক্ষাদান করছেন তিনি আদৌ কি যোগ্য? যে পড়ুয়ার কথা ভেবে এত আয়োজন, তাঁরা কি আদৌ আগ্রহী? রূঢ় বাস্তবতা বলে খাবার লোভ দেখিয়ে টেনে আনতেই মিড ডে মিলের বন্দোবস্ত। কিন্তু, সেই মিড ডে মিলের পাতেও তো সাপ-ব্যাঙ-আরশোলা-টিকটিকির সিদ্ধ অথবা অর্ধসিদ্ধ অবস্থায় আনাগোনা। এমতাবস্থায়, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অঙ্গ সরকারি শিক্ষক-শিক্ষিকারা (School Teacher) তাঁদের উত্তর প্রজন্মকে কি আদৌ সরকারি স্কুলে পাঠ নিতে পাঠাচ্ছেন? এসব তথ্য়-তালাশ করতেই বাংলাজুড়ে স্কুলগুলির দুয়ারে দুয়ারে টিভি-৯ বাংলা। আজ টিভি-৯ বাংলা (TV-( Bangla) ডিজিটাল টিম গিয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলার কয়েকটি স্কুলে। প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম জলপাইগুড়ি জেলার একটি শতাব্দী প্রাচীন স্কুলে। যেই স্কুলে বর্তমান শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট সংখ্যা ৫০। যাঁদের মধ্যে ২৭ জনের সন্তান বেসরকারি স্কুলে পড়ে। সরকারি স্কুলে পড়ে ১৫ জন। বাকি ৮ জনের মধ্যে ২ জন অবিবাহিত। বাকি ৬ জনের সন্তানের বয়স ৩ বছরের নীচে। তারা এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তবে ওই ৬ জনের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা জানাচ্ছেন আগামীতে তাঁরা তাঁদের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলেই ভর্তি করবেন। কেন এরকম ভাবনা তাঁদের?
ওই স্কুলের বাংলার শিক্ষক ( তিনিই আবার স্কুলের প্রধান শিক্ষক) জানালেন, একসময় তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক চাপে তাঁর সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু, এখন তাঁর উপলব্ধি কাজটা মনে হয় ঠিক করেছেন। কারণ হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নামকরা সরকারি স্কুলগুলিতে বাছাই করে ভাল ছাত্র নেওয়ার আর সুযোগ নেই। পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল উঠে যাওয়ায় ছাঁকনি প্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যার ঠিক উল্টোটা বেসরকারি স্কুলে। ফলে সংসার চালিয়ে আর্থিক টানাটানি থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বেসরকারি স্কুলেই পড়াচ্ছি।”
ওই স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষিকা জানালেন, তাঁর শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিল সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর। তিনি বলছেন, “ইংরেজি ভাল করে লেখার পাশাপাশি যদি বলতে না পারে তবে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা বা রাজ্যের বাইরে চাকরি পেতে অসুবিধায় পড়তে হতে পারে। সে কারণে সন্তানকে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছি।” তবে তিনি এও জানাচ্ছেন,সরকারি স্কুলেই যদি উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ থাকত, তবে সরকারি স্কুলেই তাঁর বাচ্চাকে পড়াতেন।
স্কুলের বাণিজ্য শাখার এক শিক্ষকের সন্তান সরকারি স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি এখন পিএইচডি করছেন। তিনি আবার বলছেন, সন্তান সরকারি বা বেসরকারি যেই স্কুলেই পড়ুক বাড়িতে তাঁর যদি সঠিক পরিচর্যা না হয় তবে খুব মুশকিল।
স্কুলের এক শিক্ষাকর্মীর সন্তানও পড়ে বেসরকারি স্কুলে। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, পাশ-ফেল প্রথা উঠে যাওয়ায় পর থেকে সরকারি স্কুলের মান নেমে গিয়েছে। রাজ্যে তেমনভাবে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি নেই। যদি ভিন রাজ্যে কাজে যায় তখন ইংরেজি ভাল বলতে ও লিখতে না পারলে সমস্যায় পড়বে। এই ভাবনা থেকে তিনি সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছেন।
আমরা খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম জলপাইগুড়ি শহরের মধ্যেই ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়া আরও একটি সরকারি স্কুলে। সেখানে আবার দেখা গেল উল্টো চিত্র। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের জানালেন তাঁদের স্কুলের শিক্ষক, প্যারা টিচার ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট সংখ্যা ৪১। যাঁদের মধ্যে ৩২ জনের সন্তান সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে বা এখনও করছে। বাকি ৯ জন শিক্ষকের সন্তানরা বেসরকারি স্কুলে পড়ে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্পষ্টতই জানালেন, তিনি সরকারি স্কুল থেকে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই তাঁর সন্তানকেও সরকারি স্কুলে পড়িয়েছেন। এখন ভিন রাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। পঠন-পাঠনে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না।
ওই স্কুলের এক বিজ্ঞানের শিক্ষক জানালেন, তাঁর সন্তান প্রথমে সরকারি স্কুলে পড়ত। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল থেকে বেশ কিছু সমস্যা আসতে শুরু করে। স্কুলের পরিবেশও ঠিকঠাক ছিল না। সে কারেণ সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিবর্তিতে তিনি তাঁকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেন।
ওই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক জানালেন, তিনি প্রথমে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চাকরি করতে যেতেন। ফলে স্কুলে যাতায়াত করার পর তাঁর সন্তানকে বাড়িতে পড়াবার মতো সময় পেতেন না। তাঁর এক আত্মীয় যেহেতু শহরের বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিক ছিলেন তাই তাঁর কথা মতো বেসরকারি স্কুলে তাঁর সন্তানকে ভর্তি করেছেন।
এরপর আমরা শহরের শেষ প্রান্তে থাকা আরও একটি সরকারি স্কুলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা জানতে পারলাম ওই স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট সংখ্যা ৪০ জন। এদের মধ্যে ১০ জন অবিবাহিত। বাকি ৩০ জনের মধ্যে ১২ জনের সন্তান বেসরকারি স্কুলে পড়ে। ১২ জন সরকারি স্কুলে পড়ে। ৬ জনের সন্তানের বয়স ৩ বছরের নীচে।
ওই স্কুলের বায়োলজি শিক্ষক জানালেন তাঁর দুই সন্তান। দুজনেই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ইংরেজি লেখা ও বলায় সাবলীল না হলে উচ্চশিক্ষা এবং ভবিষ্যতে রাজ্যের বাইরে কিংবা দেশের বাইরে পড়াশোনা বা চাকরি করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সেই ভাবনা থেকে আমার সন্তানদের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছি।”
ওই স্কুলের মিউজিক শিক্ষক জানালেন, তাঁর সন্তান সরকারি স্কুলেই পড়ে। তাঁর আবার সাফ বক্তব্য, তিনি যদি সরকারি স্কুলে পড়ে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন তবে তাঁর সন্তানেরা সরকারি স্কুলে পড়ে কেনও প্রতিষ্ঠিত হবে না? এই ভাবনা থেকে সরকারি স্কুলে দেওয়া।
ওই স্কুলের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক জানালেন, তিনি সন্তানকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। তাঁর দাবি, পাশ-ফেল উঠে যাওয়ার ফলে সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষার মান নেমে গিয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ের পরিকাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এই সব ভাবনাচিন্তা থেকেই তিনি তাঁর সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।