মুর্শিদাবাদ: “সিঙ্গুরে যেভাবে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছিল, আমরা সেভাবে করব না। আমরা প্রথমে নিজেদের জমি দিয়ে শুরু করব। তার পর প্যাকেজটা এজন্য বলে দিলাম। জমি দিলে দেওয়া হবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও বাড়ি।” ডেউচা পাচামি কয়লা ব্লক প্রকল্প নিয়ে এদিন বিধানসভায় এমনই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)। মুখ্য়মন্ত্রীর সেই ঘোষণার বিরুদ্ধে এ বার বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী।
অধীর এদিন বলেন, “বিজনেস সামিটের নামে কোটি কোটি টাকার মোচ্ছব করেছেন মুখ্য়মন্ত্রী। আর দেউচা পাচামি প্রকল্প হল কুমিরের ছানা। আগে বলেছিলেন বাংলায় শিল্প হবে। কোথায় হয়েছে! দেউচা পাচামি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন। তামিলনাড়ু, বিহার, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক, আরও অনেকগুলো রাজ্যে কোল মাইনিং প্রজেক্টের কথা বলা হয়েছিল। কোনও রাজ্য এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। কারণ তা লাভজনক হবে না। পশ্চিমবঙ্গ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। কেন গ্রহণ করল? এর কি কোনও বাণিজ্যিক লাভ রয়েছে? মুখ্য়মন্ত্রী কি তথ্য় দিতে পারবেন একটা কয়লাখনি তৈরি হলে সেইখানে কয়লার পরিমাণ কত হবে? এক কুইন্টাল কয়লা তুলতে কত খরচ হবে তা কি জানা আছে, কতজনকে খনির কাজে নিয়োগ করা যাবে, তার তথ্য কি মুখ্য়মন্ত্রী দিতে পারবেন?”
কংগ্রেস নেতা আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আপনার কাছে অনুরোধ, বেকার যুবকদের ললিপপ দেখাবেন না। যতটুকু কর্মসংস্থান করা সম্ভব, ততটুকু করুন। যা যা কাজ করা যায়, সেগুলো করুন। খামখা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেন না। বিজনেস সামিটে যে এত এত টাকা বিনিয়োগের কথা হয়েছে, কোথায় সেই বিনিয়োগ! কোথায় সেই শিল্প! মুখ্য়মন্ত্রীকে সে হিসেব দিতে পারবেন!”
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিয়ে খুশি নয় বীরভূমের খনি অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষরা। তাঁদের দাবি, আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে রাজ্য সরকারকে। তাছাড়া কী কী ক্ষতিপূরণ থাকছে তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক সরকার। কিন্তু, এই ঘটনায় অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, তিনি এমন কিছু শোনেননি। তাঁর আরও সংযোজন, “কাজ হবে। আর এক বছর ধরে টাকা পাবে। আদিবাসী লোকেরাই এই প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে। তাদের কথা ভেবেই এই প্যাকেজ করা হয়েছে।”
পাশাপাশি, মোহাম্মদ বাজার ডেউচা পাচামি এলাকার আদিবাসী সংগঠন, আদিবাসী গাঁওতার সম্পাদক তথা জমিদাতা রবিন সোরেন সম্পর্কে অনুব্রত বলেন, “রবিন খুব কাজের ছেলে। দুর্দান্ত ছেলে। উন্নয়নের জন্য পোক্ত কাজ করে। ও কোনও প্রতিবাদ করবে না। ও এমন কথা বলতেই পারে না।”
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা খনির সন্ধান পাওয়ার সুবাদে বীরভূমের ডেউচা পাচামি কোল ব্লক এলাকার নাম এখন অনেকেরই জানা। বীরভূমের দেউচা পাচামি কয়লা খনির কাজ শুরুর বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। প্রায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত ডেউচা পাচামি কোল ব্লক এলাকা। প্রাথমিক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৩০১০টি পরিবার এই খনি অঞ্চলে বসবাস করেন যার মধ্যে ১০১৩টি আদিবাসী পরিবার। ৩০৭ একর জমি বনভূমি রয়েছে এখানে। এদিন মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে প্যাকেজের ঘোষণা করেছেন।
বলা হয়েছে, প্রায় ১৭ জন খাদান মালিক বাড়ির দাম ও ক্ষতিপূরণ পাবেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজের অধীনে বাড়ি দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের। ওই এলাকায় থাকা বাসিন্দা, যাঁদের বাড়ি সহ জমি রয়েছে, তাঁরা পাবেন ১০ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সুবিধা দিতে আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া বাড়ি বা জমি হারানো অথবা বর্গদাররা পরিবার পিছু জুনিয়র পুলিশ কনস্টেবল পদমর্যাদার চাকরি পাবেন। সব মিলিয়ে এই ত্রাণ পুনর্বাসন প্যাকেজের মোট আর্থিক মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা।
যদিও এদিন বিধানসভায় এই প্রকল্প ঘোষণার পর খুশি নন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। মুখ্যমন্ত্রীর প্যাকেজ ঘোষণার পর খুশি নন আদিবাসীরা। আবার গ্রাম ছাড়তেই নারাজ আদিবাসী পরিবারগুলি। তাই প্যাকেজ ঘোষণার পরই প্রাথমিক সংশয়ে ডেউচা পাচামি কয়লা প্রকল্প ।
বীরভূমের মোহাম্মদ বাজার এলাকায় দেউচা পাচামি বৃহৎ কয়লা প্রকল্পের আগেই ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। এবার এই প্রকল্পের দরুণ প্যাকেজের ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের মতো জমি অধিগ্রহণ নয়। আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হবে। থাকছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, চাকরি ও পুনর্বাসনের মতো সুবিধা।
কিন্তু, এত ঘোষণার পরও আদৌ কি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে? সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এদিন এলাকার আদিবাসী মানুষদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়। তাঁরা কেউ কেউ স্পষ্ট জানাচ্ছেন, গ্রাম ছাড়বেন না। প্রকল্প করতে হলে সরকারি ভেস্ট জমি ও ফাঁকা জমিতে করা হোক। একই সঙ্গে দাবি জানাচ্ছেন, প্যাকেজের সরকারিভাবে শ্বেত পত্র বের করা হোক। এবং জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা সেই নিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে আলোচনায় বসুক।
মোহাম্মদ বাজার ডেউচা পাচামি এলাকার আদিবাসী সংগঠন, আদিবাসী গাঁওতার সম্পাদক তথা জমিদাতা রবিন সোরেন বলেন, “আমরা চাই গ্রামের পাশের সরকারি থাকা ল্যান্ড ও ভেস্ট ল্যান্ডের ওপর প্রকল্প হোক। আমরা কোনভাবেই গ্রাম উচ্ছেদ চাইছি না।”
আদিবাসী জমিদাতা সোমনাথ হেমব্রম ও শ্যামল মুর্মু জানান, “আমরা কোনও ভাবেই গ্রাম ছাড়তে রাজি নই। আমরা চাই, মুখ্যমন্ত্রী যেমন ঘোষণা করেছেন সেই মতই সরকারি কাগজ প্রকাশ করা হোক। তারপর প্রশাসন আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসুক। পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।”
সরকার পুনর্বাসন দেওয়ার কথা বললেও সেই পুনর্বাসনের আগে ব্যবস্থা করলে তারপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানাচ্ছেন। তবে তাঁদের একটাই কথা, “আমরা কোনভাবেই বাপ-মার ভিটে গ্রাম উচ্ছেদ হোক চাই না।”
যদিও এ বিষয়ে বীরভূম জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, “আমরা আগেও চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রাথমিকভাবে, ভেস্ট ল্যান্ডের উপরেই কাজ শুরু করা হবে। তার পরে, পরবর্তীতে বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষ।” তিনি আরও বলেন, “এই এলাকায় তিন ধরনের ল্যান্ড (জমি) রয়েছে। ফরেস্ট লান্ড, ভেস্ট ল্যান্ড ও প্রাইভেট ল্যান্ড। আমরা সকল প্রকার মানুষের সাথে কথা বলে কাজ শুরু করব।” একইসঙ্গে রাজ্য সরকার পরবর্তীতে যেমন নির্দেশিকা দেবেন সেই মোতাবেক কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: Post Poll Violence: হিংসা তদন্তে আইএসএফ কর্মী খুনে সিবিআইয়ের জালে ৩ দুষ্কৃতী