সন্দেশখালি: এই মুহূর্তে সন্দেশখালি যেন আগ্নেয়গিরি, যা রুদ্ররূপ নিয়েছে। এক শাহজাহানেই জ্বলছে, পুড়ছে বসিরহাটের এই এলাকা। গত ৫ জানুয়ারি ঘটনার সূত্রপাত। তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডি গিয়েছিল রেশন দুর্নীতির তদন্তে। ইডির টিমকে ঘিরে ফেলে কয়েকশো মানুষ। মার খেতে হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের। একজন রক্তাক্তও হন। প্রথমে বলা হয়েছিল, ‘শাহজাহান ভাই’কে ভালবেসে এমন প্রতিবাদ। কিন্তু সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই ঘুরেছে হাওয়া। শেখ শাহজাহানের সাগরেদ শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক সব অভিযোগ সামনে এসেছে।
শাহজাহান সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’। গ্রামের লোকেরা বলছেন, বাদশা নিজে ময়দানে এসে কিছু করতেন না। তার জন্য ছিলেন শিবু, উত্তম বা তাঁদের মতো আরও কয়েকজন। তাঁদের দাপটে এলাকা ত্রস্ত হয়ে থাকত। বাড়ির মেয়ে-বউরা ঘর থেকে বেরোতে ভয় পেতেন বলে অভিযোগ। এমনও অভিযোগ, তাঁদের রাত হলে তুলে নিয়ে যাওয়া হত পার্টি অফিসে। রাতভর রেখে ভোরে ছাড়ত। অকথ্য অত্যাচার চলত বলে সংবাদমাধ্যমের সামনে জানিয়েছেন গ্রামের মহিলারা।
মেয়েদের সম্ভ্রম, জমিজমা দখল, এলাকায় ক্ষমতা কায়েম আরও অনেক অনেক অত্যাচার এত বছর সন্দেশখালি সরবেড়িয়ার মানুষ মুখ বুজে সহ্য করেছেন বলে অভিযোগ করেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’ জেগে ওঠে। লাঠি, ঝাঁটা, বাঁশ নিয়ে পথে নামেন মহিলারা। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরাল হয়ে ওঠে, পুলিশ তা সামাল দিতে হিমশিম খায়।
শিবু হাজরা স্থানীয় পঞ্চায়েত নেতা। উত্তম সর্দার আবার জেলা পরিষদের সদস্য। শিবু দু’ একবার সংবাদমাধ্যমের সামনে এলেও, আচমকাই উধাও হয়ে যান। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতারের দাবিতে শিবুর পোলট্রি ফার্ম, বাগানবাড়িতে রীতিমতো ভাঙচুর চলে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী, স্ট্র্যাকো থেকে হোমগার্ড, কী নামানো হয়নি? কিন্তু সমাধান অধরাই থেকেছে। বরং আরও বেড়েছে সেই আগুনের তাপ।
অন্যদিকে ইতিমধ্যেই ৬ বছরের জন্য উত্তম সর্দারকে তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশের হাতে। তবে বিরোধীরা উত্তমের এই গ্রেফতারিকে ‘সেফ শেল্টার’ হিসাবে দেখছে। তবে এই আবহে আরও দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন। বিজেপি নেতা বিকাশ সিং ও সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দার। নিরাপদের বিরুদ্ধে শিবু হাজরা অভিযোগ করেন। আর প্রথম দু’জনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগ।
যে কোনও জ্বলন্ত ইস্যু মানে তাতে রাজনীতির পদচারণ অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রেও তেমনটাই চলছে। বিজেপি, সিপিএম একযোগে শাসকশিবির তৃণমূলকে বিঁধে ফালা ফালা করছে। অন্যদিকে তৃণমূলও নাছোড়। তাদের যুক্তি, সন্দেশখালি বিধানসভার মধ্যে সন্দেশখালিতে ১৬টি গ্রামপঞ্চায়েত। তার মধ্যে একটি সন্দেশখালি গ্রামপঞ্চায়েত। ২০১১, ২০১৬, ২০১৯ প্রতি নির্বাচনেই সেখানে তৃণমূল হেরেছে। শাসকশিবিরের যুক্তি, কাদের ক্ষমতা সেখানে চলে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস সন্দেশখালি ঘুরে এসেছেন। সেখান থেকে সোজা দিল্লি। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় মানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছেই রিপোর্ট যায়। এক্ষেত্রেও তেমনটাই হতে চলেছে বলে খবর। দিল্লি থেকে মহিলা কমিশনের একটি টিম গিয়েছে সন্দেশখালি। কলকাতা হাইকোর্টও সন্দেশখালি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সন্দেশখালির গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন ডিআইজি সিআইডি সোমা দাস মিত্র, ডিআইজি এসটিএফ দেবস্মিতা দাস, অ্যাডিশনাল এসপি সদর সুন্দরবন চারু শর্মা, এসটিএফের অনুরাধা মণ্ডল, বারুইপুর মহিলা থানার আইসি কাকলি ঘোষ-সহ ১০ সদস্যর একটি দল। এসপি হোমগার্ড পাপিয়া সুলতানা তো আগে থেকেই ঘুরছেন বাড়ি বাড়ি। কিন্তু সন্দেশখালি এখনও অশান্তই। বিরোধীরা বলছে, কোথাও কোথাও আগুনে ছাই চাপা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ছাই চাপা আগুন যে আরও সাংঘাতিক, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে তারা।