স্টকহোম: ইতিহাসের সবথেকে বিপজ্জনক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। গত ৩০ বছর ধরে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি তাদের ‘পারমাণবিক ওয়ারহেড’-এর (Nuclear Warhead) সংখ্যা কমাচ্ছিল। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ (Russia Ukraine War) শুরুর পর থেকে, পরমাণু অস্ত্র হ্রাসের এই প্রবণতার অবসান ঘটেছে এবং এখন বিশ্বজুড়ে ক্রমে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়ছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Stockholm International Peace Research Institute) বা সিপ্রি-র (SIPRI) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। গোটা বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রগুলির হিসেব রাখে এই সংস্থা। তাদের মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে কোনওদিন পৃথিবীর বুকে একসঙ্গে এতগুলি পারমাণবিক অস্ত্রছিল না। বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতির কারণেই পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমে বাড়ছে বলে দাবি করা হয়েছে এই রিপোর্টে। শুধু তাই নয়, কাদের হাতে কটি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, এই বিষয়ে প্রায় প্রতিটি দেশই আর স্বচ্ছ তথ্য দিচ্ছে না। আর পারমাণবিক অস্ত্র ভান্ডার বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবার আগে আছে চিন।
সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১২,৫১২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে! গত এক বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে ৮৬টি। এই সাড়ে বারো হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেডের মধ্যে সামরিক বাহিনীগুলির হাতে মজুদ রয়েছে ৯,৭৫৬টি পারমাণবিক ওয়ারহেড। যেগুলির একেকটি, মাত্র একটি বোতাম টিপেই যে কোনও মুহূর্তে ব্যবহার করা যাবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন যুদ্ধবিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্রে মোতায়েন করা পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা এখন ৩,৮৪৪টি। এক বছর আগেই এই সংখ্যাটা ছিল ৩,৭৩২। বিশ্বের এই পরমাণু অস্ত্রাগারের প্রায় ৯০ শতাংশই রয়েছে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। সবথেকে বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে মস্কোর হাতে, ৪,৪৮৯টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা, পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ৩,৭০৮টি। এর বাইরেও এই দুই দেশের হাতে আরও হাজারের বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এগুলি, এর আগে সামরিক বাহিনী থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, প্রয়োজনে সেগুলিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে, পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্বেগ তৈরি করেছে চিন। গত এক বছরে বিশ্বের বুকে যে ৮৬টি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র যোগ হয়েছে, তার মধ্যে ৬০টিই চিনের। এক বছর আগে বেজিং-এর হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ৩৫০। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১০-এ। তাইওয়ানের সঙ্গে বেজিং-এর উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বেজিং তার পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারকে ২০৩৫ সালের মধ্যে তিনগুণ, অর্থাৎ ৯০০-তে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সূত্রের খবর, ২০২৭ সালের মধ্যে পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা ৫৫০-এ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৯০০-তে নিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া বেজিং। এই বিষয়ে চিন পরিষ্কার জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ন্যূনতম পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করবে তারা। সেই পরিমাণটা কত, তা অবশ্য স্থির কিছু জানানো হয়নি।
বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার বাড়িয়েছে যে দেশগুলি, সেগুলি হল ভারত ও পাকিস্তান। ২০২২ সালে ভারতের মোট পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ১৬০, এই বছর চারটি বেড়ে হয়েছে ১৬৪। আর ২০২২-এ পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র ছিল ১৬৫টি, ২০২৩-এ ৫টি বেড়ে হয়েছে ১৭০টি। তবে, ভাত বা পাকিস্তান কোনও দেশই যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রে কোনও পারমাণবিক ওয়ারহেড মোতায়েন করেনি। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্পর্কে নিশ্চিত কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে, তাদেরও ভান্ডারে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বেড়েছে বলেই জানিয়েছে সিপ্রি।
২০২১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছিল, “পারমাণবিক যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না এবং এই যুদ্ধ কখনই করা উচিত নয়।” কিন্তু, সেই বিবৃতি যে শুধুই মুখের কথা, তা সিপ্রির সাম্প্রতিক রিপোর্টেই প্রমাণিত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে, একের পর এক পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি তৈরি হয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, মানব সভ্যতা বর্তমানে এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম সন্ধিক্ষণে রয়েছে। একটি ভুল পদক্ষেপ থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ, যা এই গ্রহ থেকে সমগ্র মানবজাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই, বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।