Saudi Arab-Iran Conflict: দুটিই মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র, তাহলে কেন সাপে নেউলে সম্পর্ক সৌদি আরব-ইরানের?
Saudi Arab-Iran Conflict: ১৯৭০-র দশক পর্যন্ত দুই দেশের অর্থনীতিই তেল নির্ভর ছিল। আমেরিকার সমর্থন ছিল দুই দেশের প্রতিই। কিন্তু দুই দেশের চিন্তাধারার বিরোধে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় ইসলামিক রেভেলিউশন। রাজতন্ত্র শেষ করে রেভেলিউশনারি ইসলামিক সরকার গঠিত হয়। ১৫ বছরের নির্বাসন শেষ করে দেশে ফেরেন আয়াতোল্লাহ খোমেইনি।
বছর পার করতে চলল ইজরায়েল-হামাসের যুদ্ধ। সীমান্তের লড়াই পৌঁছে গিয়েছে দেশের অন্দরে। মিসাইলের হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না স্কুল, হাসপাতালও। ত্রাণশিবিরে গোলাবর্ষণে প্রতিনিয়তই মৃত্যুর খবর মিলছে। রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ে হাজার হাজার প্রাণ গিয়েছে। বিপন্ন লক্ষাধিক প্রাণ। শুধু তো ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনই নয়, লেবানন, সিরিয়া সহ মধ্য প্রাচ্যের একাধিক দেশেই যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, ক্ষমতার টানাপোড়েন লেগে রয়েছে। আইসিস, আল কায়েদা, হিজবুল্লার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি গোটা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এরা পুরোপুরিভাবে নিজে থেকেই লড়ছে, তা বলা যায় না। এদের পিছন থেকে টান দিচ্ছে অদৃশ্য সুতো। যার কলকাঠি দুই দেশের হাতে। কারা এরা?
মধ্য প্রাচ্যের দুই দেশ, যারা উচ্চাকাক্ষ্মায় ভরপুর। একদিকে সৌদি আরব, অন্যদিকে দিকে ইরান। ইজরায়েল-হামাসের মধ্যে এই বিরোধের পিছনেও রয়েছে সৌদি আরব ও ইরানের হাত। তবে এই যুদ্ধ কিন্তু আজকের নয়। এর আগেও একাধিক দেশের মধ্যে যুদ্ধে বহুবার নাম জড়িয়েছে দুই দেশের। কেন এত বিরোধ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে?
সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আগেই জানা দরকার দুই দেশের অবস্থান। মধ্য প্রাচ্যের এই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আজকের নয়, বহু বছর ধরে চলছে ঠান্ডা যুদ্ধ। তবে মজার বিষয় হল, কেউ কারোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে না। একই অঞ্চলে অবস্থিত পড়শি দেশগুলির মধ্যে ভাগাভাগি, যুদ্ধ বাধাতে সদা প্রস্তুত। সিরিয়ার সিভিল ওয়ার হোক বা লেবাবন, ইরাকের মতো দেশে সমস্যা। সবেতেই দুই বিরোধী পক্ষে অবস্থান করে সৌদি আরব ও ইরান। এভাবেই ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধ চলছে। তবে এই লড়াই শুধু ভৌগলিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার নয়, ধর্মীয় শক্তি এবং সর্বোপরি মধ্য প্রাচ্যের আধিপত্য নিয়ে টানাপোড়েন। আর এই আধিপত্য বা প্রভাব বজায় রাখাকে ঘিরেই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ। এই সংঘাত যে কতটা চরমে, তা বোঝা যায় দুই দেশের নেতাদের কথা শুনেই। আয়াতোল্লাহ খোমেইনিকে “মধ্য প্রাচ্যের হিটলার” বলেছিলেন সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মহম্মদ বিন সলমন। অন্যদিকে ইরানের বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফ বলেছেন যে কোনও বিপদের খোঁজ করলে, সৌদি আরবের দিকে দেখুন।
সাধারণভাবে সকলে জানে যে ঠান্ডা যুদ্ধ হয়েছিল আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে। ৪০ বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু সৌদি ও ইরানের মধ্যেও যুদ্ধ বহু পুরনো। আমেরিকা-রাশিয়া যেমন সরাসরি যুদ্ধ না করলেও, বিভিন্ন বিরোধী দেশকে সমর্থন করে ছায়াযুদ্ধ চালিয়েছে, একইভাবে ইরান ও সৌদি আরবও যুদ্ধ করে যাচ্ছে অবিরাম। আমেরিকা ও রাশিয়া লড়েছিল বিশ্বের সবথেকে ক্ষমতাবান দেশ হবে কে, তা নিয়ে। সৌদি আর ইরানের লড়াই তেলের খনি মধ্য প্রাচ্যে কার আধিপত্য থাকবে, তা নিয়ে।
সৌদি ও ইরানের উত্থান-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওটোম্যান রাজত্বের পতন হয়। কয়েকটি শক্তিধর রাজ পরিবারের উত্থান হয়, এর মধ্যে আল সাদ সৌদি আরবের অধিকাংশ জায়গা দখলে সক্ষম হয়। ১৯৩২ সালে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬ বছর পরে সৌদিতে তেলের খনির খোঁজ মেলে। রাতারাতি বদলে যায় দেশের অবস্থা। রাতারাতি বিশ্বের অন্যতম ধনী পরিবার হয়ে ওঠে সৌদির রাজারা। মরুভূমির শহরে তৈরি হতে থাকে রাস্তাঘাট, শহর। সেই সময়ই পূর্ব দিকে আরও একটি দেশের উত্থান হচ্ছিল। তা হল ইরান। এই দেশেও বিপুল তেলের ভান্ডার এবং তুলনামূলকভাবে বেশি জনসংখ্য়া থাকা সত্ত্বেও তাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছিল বারবার। বৈদেশিক শক্তির হামলা, বিশেষ করে ব্রিটেন ও রাশিয়া দুইবার ইরানে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিল। ১৯৫৩ সালে আমেরিকার মদতেই অভ্যুত্থান হয় ইরানে। প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসায়েদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই মোয়াসেদ ইরানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু তার দুর্নীতি ও গোপন বাহিনী সাভাকের দাপট, অত্যাচারেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করে।
১৯৭০-র দশক পর্যন্ত দুই দেশের অর্থনীতিই তেল নির্ভর ছিল। আমেরিকার সমর্থন ছিল দুই দেশের প্রতিই। কিন্তু দুই দেশের চিন্তাধারার বিরোধে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় ইসলামিক রেভেলিউশন। রাজতন্ত্র শেষ করে রেভেলিউশনারি ইসলামিক সরকার গঠিত হয়। ১৫ বছরের নির্বাসন শেষ করে দেশে ফেরেন আয়াতোল্লাহ খোমেইনি। এই সময় থেকেই ইরানকে থ্রেট বা বিপদ হিসাবে দেখতে শুরু করে সৌদি আরব। ইরানের এই অভ্যুত্থানে ভয় পেয়েছিল সৌদি আরব। তাদের শঙ্কা ছিল, যদি ইরানের তো তাদের দেশেও সামরিক বা গণ-অভ্যুত্থান হয়।
ধর্মীয় টানাপোড়েন-
ধর্মও দুই দেশের সঙ্কটের অন্যতম কারণ ছিল। ইরানের প্রতিষ্ঠার আগে মুসলিম দেশ হিসাবে একাধিপত্য় ছিল সৌদি আরবেরই। দুই দেশই মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হলেও একদিকে রয়েছে ইরান, যাদের দেশে শিয়া মুসলিমদের বাস। অন্যদিকে সৌদি আরবে ক্ষমতায় রয়েছে সুন্নি মুসলিমরা। তবে এই দুই দেশের মধ্য়ে কোনও দেশেই বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক মুসলিম বসবাস করে না। তবুও মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পরিচয় গড়ার লড়াই চলছে এই দুই দেশের মধ্যে বহু দশক ধরেই।
সৌদি আরবেই রয়েছে মক্কা ও মদিনা, যা ইসলাম ধর্মের সবথেকে পবিত্র স্থান। প্রতি বছর হজ আয়োজন করে সৌদি আরব। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরব কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকে। সৌদিতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জনসংখ্যা শিয়া।
২০১৬ সালে শিয়া নেতা তথা সৌদি রাজাদের অন্যতম সমালোচক নিমর আল নিমরকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর সৌদি দূতাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে সৌদিতে রাজতন্ত্রের পতনের জন্য শিয়া গোষ্ঠীগুলিকে আর্থিক ও সামরিক মদত দিচ্ছে তারা। এরপরই সৌদি তাদের মসনদ বাঁচাতে আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে শুরু করে।
সামরিক শক্তি ও যুদ্ধে মদত-
অন্যদিকে সামরিক প্রভাব বিস্তারে সৌদির থেকে অনেক গুণ এগিয়ে ইরান। লেবাননে রয়েছে হিজবুল্লা বা হেজবোল্লা, যা ইরানের সেনা দ্বারা সমর্থিত। একইভাবে গাজা স্ট্রিপে হামাসও ইরানের সমর্থন পায়। সিরিয়া ও ইরাকেও বিভিন্ন সংগঠনকে পরোক্ষে সমর্থন করে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড। এর পিছনে বড় কারণও রয়েছে। ইরানের নিজস্ব সেনাবাহিনী এত শক্তিশালী নয়। ইরানের জেনারেল কাশেম সোলেমানি দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশের মাটিতে অভিযান চালাচ্ছিল। আমেরিকা গুপ্ত অভিযান চালিয়ে হত্যা করে সোলেমানিকে।
উল্টোদিকে, মহম্মদ বিন সলমন ক্ষমতায় আসতেই ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায় সৌদি। এই হুথিদেরও সমর্থন করে ইরান। এই যুদ্ধ থেকেই আরও প্রকট হয় ইরান-সৌদির বিরোধ। হুথির দস্যুরা আক্রমণ করেছিল সৌদির তৈল শোধনাগারে। গাল্ফ ও লোহিত সাগরে বিভিন্ন সময়ে যে তেল বা পণ্য বহনকারী জাহাজ যায়, তার উপরেও হামলা চালায় হুথিরা। এই হামলা এখনও জারি রয়েছে। হামলার পিছনে ইরান যুক্ত, এমন অভিযোগ বারবার উঠলেও, তা বরাবরই অস্বীকার করেছে ইরান। কিন্তু এই হামলার প্রভাব পড়ে বিশ্বের সমস্ত দেশেই, কারণ পেট্রোলিয়াম পণ্য ও তেলের দাম ওঠানামা করে এই জোগানের উপরে। সিরিয়ায় আবার হেজবুল্লাকে মদত দেয় ইরান।
তবে এই ক্ষমতার লড়াই আগে প্রচ্ছন্ন ছিল। ইরাকের পতনের পর তা প্রকট হয়। ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাকে হামলা চালায়। হত্যা করে সাদ্দামকে। ইরান বা সৌদি আরব- কেউই এটা হোক, চায়নি, কারণ দুই দেশের মধ্যে বাফার জোন হিসাবে কাজ করত ইরাক। সাদ্দামের অবর্তমানে একাধিক সামরিক গোষ্ঠী তৈরি হয়। শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীগুলিকে আলাদাভাবে মদত দিতে থাকে দুই দেশ। সেখান থেকেই স্পষ্ট হয় দুই দেশের বিরোধ।
আমেরিকা-রাশিয়ার দোস্তি-
সৌদি আরবকে সমর্থন করে আমেরিকা। এটাই সৌদির সবথেকে বড় ট্রাম্প কার্ড। সুদান, মিশর এবং কিছুটা ইজরায়েলেরও সমর্থন পায়। অন্যদিকে, ইরান তাদের পাশে পায় চিন, রাশিয়াকে। বন্দর, সামরিক শক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে এই দুই দেশ। শত্রু দেশগুলির এই সম্পর্কও প্রভাব ফেলে দুই দেশের উপরে।
ইরান বা সৌদি আরব-কেউই সরাসরি যুদ্ধ করতে না চাইলেও, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতেই দুই দেশ একে অপরকে নানা যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দোষারোপ করে। ইরান ও সৌদির এই বিরোধে ক্রমশ্য অস্থির হচ্ছে সমগ্র মধ্য প্রাচ্য। এই ছায়া যুদ্ধ কতদিন চলে এবং কোথায় পৌঁছয়, তা-ই দেখার।