নয়া দিল্লি: চিনের এক লজিস্টিক সংস্থার কাছ থেকে একটি চালান যাচ্ছিল পাকিস্তানের শিয়ালকোটের এক সংস্থার কাছে। সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে কোনও কাদা নেই। প্রায় ২২০০০ কেজির এই চালানের মধ্যে ছিল ইটালির এক সংস্থার তৈরি একটি কম্পিউটার নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোল যন্ত্র এবং আরও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সেগুলির মধ্যেও সন্দেহজনক কিছু ছিল না। কিন্তু, প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বা ডিআরডিও-র একটি দল এই চালান পরীক্ষা করে জানিয়েছে, এই যন্ত্রপাতিগুলি দুই ভাবে ব্যহার করা যেতে পারে। সামরিক কাজে, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপমাস্ত্র তৈরির প্রকল্পে এই যন্ত্রপাতিগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে কি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য জলপথে সাহায্য পাঠাচ্ছে চিন?
কেন বাজেয়াপ্ত জাহাজটি?
শনিবার (২ মার্চ), সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, জাহাজটি ধরা পড়েছিল গত ২৩ জানুয়ারি। মুম্বইয়ের নাভা শেভা বন্দরে চিন থেকে আসা পাকিস্তানগামী ওই জাহাজটিকে আটকেছিলেন শুল্ক বিভাগের কর্তারা। জাহাজটিতে ছিল মাল্টার পতাকা, নাম – সিএমএ সিজিএম আটিলা। জাহাজটি পাকিস্তানের করাচি যাচ্ছিল। আগে থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জাহাজটিকে আটকায় শুল্ক বিভাগ। এরপর জাহাজটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাশি চালানো হয়। জাহাজে থাকা সরকারি নথি অনুযায়ী, ওই চালান পাঠিয়েছিল ‘সাংহাই জেএক্সই গ্লোবাল লজিস্টিক কোম্পানি লিমিটেড’ নামে এক চিনা সংস্থা। চালানটি যাচ্ছিল শিয়ালকোটের ‘পাকিস্তান উইংস প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থার কাছে। কিন্তু, তদন্ত করে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে চালানটি ‘তাইয়ুয়ান মাইনিং ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড’ পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের ‘কসমস ইঞ্জিনিয়ারিং’ সংস্থার উদ্দেশে।
কারা এই কসমস ইঞ্জিনিয়ারিং?
এই সংস্থা অত্যন্ত পরিচিত এক পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী। ২০২২-এর মার্চে, এই একই বন্দরে একটি থার্মোইলেকট্রিক যন্ত্রের চালান আটকেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সেই সময় থেকেই এই পাকিস্তানি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে ভারত। থার্মোইলেকট্রিক যন্ত্রটিও ইটালিতেই তৈরি করা হয়েছিল। বস্তুত, চিন থেকে প্রায়শই পাকিস্তানে এই ধরনের সামরিক স্তরের পণ্য অবৈধভাবে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। যেগুলি দুইভাবে ব্যবহার করা যায়। এই স্থানান্তর রোধ করার জন্য বিস্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। তারই অংশ হিসেবে এই জাহাজটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এই ধরনের চালান নতুন নয়
এর আগে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, একটি চিনা জাহাজ থেকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ড্রায়ার’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ড্রায়ার বলা হলেও, সেটি আসলে ছিল একটি অটোক্লেভ। যা সম্ভবত পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করা হত। যাতে, এইভাবে খোলাখুলি অন্য দেশের থেকে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সহায়তা না নেওয়া যায়, তার জন্যই ‘মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম’ বা ‘এমটিসিআর’ বিধান রয়েছে। এই ধরনের আন্তর্জাতিক বিধানগুলিকে এড়াতেই চিন থেকে ক্রমাগত এই দুই ধরনের ব্যবহার থাকা পণ্যগুলি আমদানি করছে পাকিস্তান, এমনটাই মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। কাজেই, পাকিস্তান ও চিনের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসারকে ঘিরে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক জাহাজটি ধরা পড়ার পর, পাকিস্তানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে চিনের সমর্থন নিয়েও উদ্বেগ তীব্রতর হয়েছে।
পাকিস্তানের পাশে চিন
প্রতিরক্ষা কর্তাদের মতে, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পণ্যগুলি আমদানির উপর প্রচুর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সেই নিষেধের বেড়া টপকে, সেগুলি দেশে আনার জন্য চিনকে বাহক হিসাবে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। তাঁদের মতে, দুইভাবে ইসলামাবাদকে সাহায্য করছে বেজিং। প্রথমত, তারা গোপনে সংবেদনশীল উপকরণ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে পাকিস্তানকে। দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বৈত-ব্যবহার বা সামরিক পর্যায়ের পণ্য ও সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য বাহক হিসাবে কাজ করা। এই দ্বৈত-ব্যবহারের পণ্যগুলি পাকিস্তান তাদের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করে। উপরন্তু, চিন পাকিস্তানকে অসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও সহায়তা করছে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপ বা এনএসজি-র নির্দেশ লঙ্ঘন করে চাশমায় চারটি ৩০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং করাচিতে দুটি ১০০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে চিন।