কোপেনহেগেন: জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাবগুলি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর এর সবথেকে অশুভ লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম হল বিশ্বব্যাপী হিমবাহগুলির দ্রুত গলে যাওয়া। একসময় এই বরফের নদীগুলিকে চিরন্তন বলে মনে করা হত। মনে করা হত, কোনওদিনই সেগুলি গলবে না। কিন্তু, এখন সেগুলি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার প্রভাবে ব্যাপকভাবে গলে যাচ্ছে। যা সামগ্রিভাবে গোটা পৃথিবীর সামনে অস্তিত্ব সংকট তৈরি করেছে। এতদিন পর্যন্ত মনে করা হত, আমাদের হাতে বোধহয় কিছুটা সময় আছে। কিন্তু, ‘নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে’ প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, দ্রুত হারে হিমবাহ গলনের ফলে, ২০২৫ সালের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে গাল্ফ স্ট্রিম বা উপসাগরীয় স্রোত। এই স্রোত বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে, উত্তর গোলার্ধের একটা বড় অংশে নেমে আসবে তুষার যুগ।
গাল্ফ স্ট্রিম বা উপসাগরীয় স্রোত তৈরি হয় পশ্চিম উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে। মেক্সিকো উপসাগর থেকে এই উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত, ফ্লোরিডার উপকূল বরাবর উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে উত্তর ক্যারোলিনা থেকে পূর্ব দিকে মোড় নেয় এবং আটলান্টিক জুড়ে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ উত্তরে উষ্ণ, নোনা জল বহন করে আনে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকাগুলি থেকে উচ্চ অক্ষাংশের এলাকাগুলিতে তাপ বয়ে আনে। অর্থাৎ, এই স্রোত উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর উষ্ণ জল একটি প্রাকৃতিক তাপ পরিবাহী বেল্ট হিসাবে কাজ করে। বিষুবরেখা থেকে মেরু অঞ্চলে উষ্ণতাকে বহন করে। পথে যে এলাকাগুলি পড়ে, সেখানকার আবহাওয়াকেও প্রভাবিত করে। কাজেই এই স্রোত বন্ধ হয়ে গেলে উত্তর গোলার্ধের এক বিস্তীর্ণ অংশে ভয়ঙ্কর শীত নেমে আসবে।
উপসাগরীয় স্রোতের তাপ ছাড়া, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু অংশের গড় তাপমাত্রা কয়েক দশকের মধ্যে, স্বাভাবিকের থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। যার ফলে বিশ্বজুড়ে গুরুতর ‘ক্যাসকেডিং এফেক্ট’ দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। অর্থাৎ, বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের একটি ক্রম তৈরি হতে পারে। লাগাতার ঝড়-বৃষ্টি, অতি বৃষ্টি বা কম বৃষ্টির কারণে ফসলের গুরুতর ক্ষতি, উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো একের পর এক ঘটনা আঘাত হানবে মানব সভ্যতার উপর।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন যদি না কমানো যায়, তবে ২০২৫ থেকে ২০৯৫ সালের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে উপসাগরীয় স্রোত। তবে, বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৫০ সালের বেশি সময় পাওয়া যাবে না। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পিটার ডিটলভসেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের সামনে গভীর চিন্তার কারণ রয়েছে। এটা অত্যন্ত বড় পরিবর্তন হতে চলেছে। ১২,০০০ বছর ধরে এই স্রোত কখনও বন্ধ হয়নি।”
এই গবেষণায় ১৮৭০ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় এক মিনি তুষার যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল। গবেষকরা তারপরে সেই তথ্য ব্যবহার করে উপসাগরীয় স্রোতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছেন। এই স্রোত যদি বন্ধ হয়ে যায় বা এর গতি ধীর হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমাদের আরও চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে হবে। কৃষি, পরিকাঠামো এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি বাড়ে, বিশ্বের যে শহরগুলি ডুবে যেতে পারে, সেই তালিকায় কিন্তু রয়েছে কলকাতার নামও।