Russia-Ukraine Conflict: হাসিই যাঁর মূলধন, শেষ হাসি হাসতে পারবেন তো!
Russia Ukraine conflict: ২০১৯ ইউক্রেন নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ইউক্রেনের নাগরিক যেমন বোকা নয়, তেমনই জ়েলেনস্কিও শুধুমাত্র ভাঁড় নয়। ২০১৪ সালে রুশ সেনার জবরদস্তি ক্রিমিয়া দখলের পরেই জ়েলেনস্কির রাজনৈতিক উত্থানের বীজ বোনা হয়ে যায়।
ইহুদি পরিবারে জন্ম হওয়ায় তিনি জানেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। তাঁর ঠাকুরদা সিমন ইভানোভিচ সোভিয়েত রাশিয়ার ‘রেড আর্মির’ হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন। অপ্রতিরোধ্য অ্যাডলফ হিটলারের নৃশংসতায় মৃত্যু হয় তাঁর প্রপিতামহের। এই ঘটনার পর গত ৭৫ বছরে কিরভি রিহ শহরের বুকে ইনহুলেটস নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। আজও এ সব যন্ত্রণার স্রোত বইছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির ধমনীতে। রুশ সেনার প্রবল আগ্রাসনের মুখে তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, “আর ঠান্ডা যুদ্ধ নয়, গরম যুদ্ধ নয়, হাইব্রিড যুদ্ধ নয়।”
আজ যুদ্ধ বিধ্বস্ত কিয়েভে ‘একলা’‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’। চাইলেই পারতেন দেশ ছাড়তে। হোয়াইট হাউজের সেই প্রস্তাব ফুৎকারে ফিরিয়ে ইউক্রেনের মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন জ়েলেনস্কি। এটা যে সেলুলয়েডের মাটি নয় তিনি জানেন। সিরিয়াল ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপিল’-এ ইতিহাসের স্যর থেকে রাতারাতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়ে ভাসিলি পেত্রোভিচ যেদিন ভারখোভনা রাদায় (ইউক্রেন পার্লামেন্ট) পৌঁছন, সেটা ছিল জীবনের প্রথম ‘সিরিয়াস ডে’। ভাসিলি আর ভলোদিমির জীবন একে অপরের পরিপূরক। ভাসিলি যা চেয়েছেন ভলোদিমির তা পূরণ করেছেন। ভাসিলি যা পাননি, ভলোদিমির আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আর তাঁর এই অন্বেষণ দেশকে যুদ্ধের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনকে সদস্য করা ভলোদিমির জ়েলেনস্কির স্বপ্ন। ন্যাটোর নিরাপত্তা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহয়তায় নতুন ইউক্রেন গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। ক্ষমতায় বসার আগে দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইউক্রেনকে মুক্ত-স্বাধীনচেতা-শক্তিশালী দেশ গড়ে তুলবেন। স্বপ্ন আর বাস্তবে কতটা ফারাক, আজ ইউক্রেনের পরিস্থিতিই তার প্রমাণ। কাকতালীয়ভাবে, সিনেমার ভাসিলিও কোনও ত্রুটি রাখেননি ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত করতে। একবার ফোনও আসে তাঁর কাছে। ফোনের ওপ্রান্তে এক মহিলা (জার্মানির প্রাক্তন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের চরিত্রায়ন) তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “আপনার দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছে। ” এ কথা শুনে উচ্ছ্বসিত ভাসিলি। চিৎকার করে বলতে থাকেন, দারুণ খবর। ইউক্রেন এবং ইউক্রেনবাসী অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন এই দিনটির জন্য। তৎক্ষণাৎ ফোনের ও প্রান্তে ভদ্রমহিলা ভাসিলির কথা শুনে বলেন, “ইউক্রেন! সরি…সরি…রং নম্বর। অ্যাকচুয়ালি আমরা এ খবর জানাতে চাইছিলাম মন্তেনেগ্রোর প্রেসিডেন্টকে।” এই কথা শোনার পর ভাসিলির যে অসহয়তা বহিঃপ্রকাশ হয়, বাস্তবে ইউক্রেনবাসী নিজেদের অসহয়তার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন।
জ়েলেনস্কিকে বিশ্বের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলাই যায়, যিনি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার উপর ভর না করে প্রেসিডেন্ট পদে লড়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ছয় মাস আগে সিদ্ধান্ত নেন ভোটে লড়ার। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পোরোসেনকো ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি জ়েলেনস্কিকে। হতে পারে, জ়েলেনস্কি ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামে সিরিয়ালে অভিনয় করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ভাবমূর্তি পোক্ত করেছেন। হতে পারে, ওই সিরিয়ালের নামে রাজনৈতিক দলের নাম রেখে চমক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রথাগত রাজনৈতিক সভা-মিছিল না করে সোশ্য়াল মাধ্যমে নিজেকে অনন্য সাধারণ হিসাবে তুলে ধরেছেন। তা বলে, একজন কৌতুক অভিনেতার হাতে রাষ্ট্রের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ের দায়িত্ব তুলে দেবে, এতটা বোকা নয় ইউক্রেনের নাগরিক!
২০১৯ ইউক্রেন নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ইউক্রেনের নাগরিক যেমন বোকা নয়, তেমনই জ়েলেনস্কিও শুধুমাত্র ভাঁড় নয়। ২০১৪ সালে রুশ সেনার জবরদস্তি ক্রিমিয়া দখলের পরেই জ়েলেনস্কির রাজনৈতিক উত্থানের বীজ বোনা হয়ে যায়। কেউ বলতে পারেন, অদ্ভুত সমাপতন ছিল ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’-এ ইতিহাসের শিক্ষক থেকে আকস্মিক প্রেসিডেন্ট হওয়ার সঙ্গে তাঁর বাস্তব জীবনে প্রেসিডেন্ট হওয়া। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পোরোসেনকো ক্ষমতায় বসার পর থেকেই দুর্নীতি-প্রশসানিক ব্যর্থতার অভিযোগে ব্যাপক জনমতের বিরুদ্ধে যুঝছিলেন। ঠিক সেই সময়, ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’সিরিয়ালে ধারাবাহিকভাবে ইউক্রেনের নানা ই্স্যু নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মুখর ভাসিলি ওরফে জ়েলেনস্কি। একদিকে ইউক্রেনের নাগরিক রাজপথে নেমে পোরোসেনকোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, পাশাপাশি সিরিয়ালের ভাসিলিকে অবচেতনে প্রেসিডেন্ট হিসাবেই জায়গা দিয়েছেন তাঁরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়া থেকে দুর্নীতি, সরকারের ভূমিকার যথেষ্ট সমালোচনার প্রকাশ পায় ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’-এ। ওই সিরিয়াল এতটাই জনপ্রিয় হয় যে ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ পার্ট টু তৈরি করতে বাধ্য হয় ক্যাভার্টাল ৯৫ কোম্পানি। আমরা কিছুটা মিল পেতে পারি বলিউডের ‘নায়ক’ সিনেমায় অনিল কাপুরের চরিত্রের সঙ্গে। অমিল শুধু এই টুকুই জ়েলেনস্কি ছায়াছবিকে বাস্তব ছবিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তাঁর দল ৪৫০ আসনের মধ্যে ২৪১টি আসন জেতে। প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে ইউক্রেনের প্রথম ইহুদি প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন জ়েলেনস্কি।
প্রথম থেকেই ন্যাটো আর ইইউ-র ‘উস্কানিতে’পুতিনকে খেপিয়ে আসছেন জ়েলেনস্কি। আজ যখন পুতিন ইউক্রেনের তিন দিক থেকে আক্রমণ করে কিয়ভের প্রায় দরজায় কড়া নাড়তে বসেছে, ন্যাটো বা ইইউ কেউই তাঁর পাশে নেই। অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার হয়তো জ়েলেনস্কি পালিয়ে পোল্যান্ড বা কোনও ইউরোপীয় দেশে গা ঢাকা দেবেন। ততবারই ভিডিয়ো করে প্রমাণ দিয়েছেন শেষ দেখা না পর্যন্ত দেশ ছাড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে অভিনয় করার দরুণ যুদ্ধক্ষেত্রে ‘একলা’ জ়েলেনস্কি তাঁর বাকপটুতায় দেশবাসীকে উদ্বুধ করার চেষ্টাই শুধু করতে পেরেছেন। প্রেসিডেন্টের মুখের কথায় নাগরিকরাও অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাঁরা চলে গিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে, ফের কাতারে কাতারে এসে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছেন। পুতিন হয়তো ভেবেছিলেন দুই দিনেই কিয়েভ দখল হয়ে যাবে, সেখানে দশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এইটুকুই জ়েলেনস্কির জয় বলে মনে করা যেতে পারে। রুশসেনার কিয়েভ দখল হয়তো সময়ের অপেক্ষা। শেষ হাসি কি পুতিনের জন্যই তোলা রইল? কে জানে, জ়েলেনস্কির চিত্রনাট্যে আর কী লেখা আছে?