ঢাকা: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে, বাংলাদেশ জুড়ে চলছে চূড়ান্ত অরাজকতা। জায়গায় জায়গায় হত্যা করা হচ্ছে আওয়ামি লিগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। হামলার মুখে পড়ছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও। আর শোনা যাচ্ছে, এই বেনজির হিংসার পিছনে হাত রয়েছে ‘ছাত্র শিবির’ বলে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মূলত তারাই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে বলে অভিযোগ। এই ছাত্র শিবির হল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামি দল, জামাতে ইসলামির ছাত্র শাখা। যে দলকে পিছন থেকে সমর্থন করে, পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। ১ অগস্টই এই জামাতে ইসলামি এবং ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর দেশত্যাগের পর বাংলাদেশ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে এই কট্টরপন্থী দল, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কারা এই জামাতে ইসলামি? আসুন জেনে নেওয়া যাক –
দল হিসেবে জামাতে ইসলামির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪১ সালের ২৬ অগস্ট, লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৈয়দ আবুল আ’লা মৌদুদি। পরবর্তী সময়ে কট্টরপন্থী ধর্মীয় দলে পরিণত হলেও, শুরুতে মূলত ভারতের কমিউনিজম বিরোধী শক্তি হিসেবেই জন্ম হয়েছিল জামাতের। ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যও পেয়েছিল। মজার বিষয় দেশভাগের সময়, জামাতে ইসলামি কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তান আমলে দুবার নিষিদ্ধও হয়েছিল সংগঠনটি। তবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধর সময়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল জামাত এবং এই দলের নেতারা। তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। জামাতের নেতৃত্বেই এই দলটির নেতৃত্বেই বাংলাদেশে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করেছিল পাকিস্তানি সেনা। যারা যুদ্ধের সময় নির্বিচারে গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুঠপাট চালিয়েছিল। ১৯৭২ সালে লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন জামাত নেতা গোলাম আজম।
কোনও দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও পরবর্তীকালে সেই দেশের রাজনীতিতে টিকে আছে কোনও রাজনৈতিক দল, এমন ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল বললেই চলে। জামাতে ইসলামির ক্ষেত্রে কিন্তু এই বিরল ঘটনাই ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করার পরও, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে বেশি সময় লাগেনি জামাতে ইসলামির। স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জামাতে ইসলামির রাজনীতি দাঁড়িয়েই আছে ধর্মের উপর। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশে শুরুত এই দলের অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবের শাসনাকালে, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাতে ইসলামির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু, অবস্থা বদলে যায় মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর।
১৯৭৬-এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির চেয়ারে ছিলেন এএসএম সায়েম। তবে, ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতেই। এই সময় বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তাতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশের রাস্তা খুলে গিয়েছিল জামাতে ইসলামির। দেশের বাইরে থাকা জামাত নেতারা দেশে ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু, রাজনীতিতে শুরুতে তারা কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামাতে ইসলামির বাধার স্মৃতি তখনও সবার মনে টাটকা। তাই সেই সময় জামাতে ইসলামি নামে সামনে না এসে, তারা এক ভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল। ওই বছরের ২৪ অগস্ট, আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলকে নিয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ বা আইডিএল গঠন করেছিল জামাতে ইসলামি। এই প্ল্যাটফর্মের আড়ালেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন জামাত নেতারা।
১৯৭৮-এ অসুস্থ মাকে দেখার অছিলায়, পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন গোলাম আজম। তারপর আর ফিরে যাননি। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আইডিএল-এর ব্যানারে ছয়টি আসনে জিতে, সেই প্রথম বাংলাদেশি সংসদে পা রেখেছিলেন জামাতে ইসলামি নেতারা। ওই বছরের ২৭ মে চার দফা কর্মসূচিকে সামনে রেখে আত্মপ্রকাশ করে ‘জামাতে ইসলামি বাংলাদেশ’। জামাতের অ্যাজেন্ডা ছিল শরিয়া আইনি ব্যবস্থা-সহ একটি ইসলামী রাষ্ট্র তৈরি করা এবং অ-ইসলামিক সকল আচার ও আইনকে নিষিদ্ধ করা। তখনও বিদেশি নাগরিক, তাই গোলাম আজমকে গোপনে আমির পদ দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে ভারপ্রাপ্ত আমির ঘোষণা করা হয় আব্বাস আলি খানকে। এরপর থেকে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ করা শুরু করে জামাতে ইসলামি। নয়ের দশকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় হয়ে ওঠে তাদের ছাত্র সংগঠন, ছাত্র শিবির।
১৯৮৬ সালে, তৎকালীন এরশাদ সরকারের অধীনে হওয়া বাংলাদেশ সাধারণ নির্বাচনে দশটি আসন জিতেছিল জামাত। পরে বিএনপি ও আওয়ামি লিগের জোটের পাশাপাশি, আলাদাভাবে জামাতও এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তবে তাদের সবথেকে বড় নির্বাচনী সাফল্য এসেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। সেবার আঠারোটি আসনে জয় পায় তারা। তাদেরই সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। তবে, এরপরই ধাক্কা খেতে হয়েছিল জামাতকে। ১৯৯২ সালের গণআদালতে জামাতের সর্বোচ্চ নেতা গোলাম আজমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৯৪-তেই আবার সেই রায় বাতিল হয়। নাগরিকত্বও ফিরে পান গোলাম আজম। জামাতও দল হিসেবে ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামি লিগ যখন আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন জামাতও আলাদাভাবে একই দাবি জানিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ফের তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করে।
২০০০ সালে দলের শীর্ষ পদ থেকে অবসর নেন গোলাম আজম। তাঁর জায়গায় আসেন মতিউর রহমান নিজামি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামাত জোট সরকার গঠন করেছিল। প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারে অংশ নিয়েছিল জামাত। দুই জামাত নেতা মন্ত্রীও হন। কিন্তু, ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েচিল জামাত। ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল হাসিনার আওয়ামি লিগ। আর জামাতে ঝুলিতে দুটি আসন যায়। এরপর তারা আর কোনেও ভোটে অংশ নিতে পারেনি। ওই বছর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ‘জামাতে ইসলামি বাংলাদেশ’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ জামাতে ইসলামি’।
এরপর, তাদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। নির্বাচন পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো, ২০১০ সালে আওয়ামি লিগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যে, বিএনপির দুই নেতা, জাতীয় পার্টির এক নেতা এবং জামাতের আটজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৩-র মার্চে তিন জামাত নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। প্রতিক্রিয়ায়, সারা দেশ জুড়ে বড় মাপের ধর্মঘট ও বিক্ষোভ করেছিল জামাত। যার জেরে প্রাণ যায় ৬০ জনেরও বেশি মানুষের। ক্ষতি হয় বহু সম্পদের। এরপরই শুরু হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলন। সরকারের কাছে জামাতকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় বিক্ষোভকারীরা। ওই বছরই জামাতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী বলে জামাতে ইসলামির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।
এর মধ্য়ে ২০১৪-র অক্টোবরে জেলেই মৃত্যু হয় গোলাম আজমের। বয়সের কারণেই তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। তবে,নব্বই বছরের করাদণ্ড হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলাতেই ২০১৫ সালে জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মহাম্মদ মুজাহিদ এবং ২০১৬ সালে আমির মতিউর রহমান নিজামির ফাঁসি হয়। দল নিষিদ্ধ হওয়া এবং নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের কারণে চাপে পড়েছিল জামাত। তবে, তাদের নিবন্ধন বাতিলের যে রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট, তাকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে তারা। ২০২৩-এর নভেম্বরে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। আর, তারপর সাম্রপ্রতিক আন্দোলনের জেরে ২০২৪-এর ৩১ জুলাই জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল হাসিনা সরকার। ফলে, পাকিস্তানে দুবার এবং বাংলাদেশে দুবার – মোট চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে দলটি। তবে বারবারই রক্তবীজের বংশধরের মতো ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই উগ্রপন্থী ইসলামি দল।
বাংলাদেশে আইএসআই-সমর্থিত জামাতে ইসলামির পুনরুত্থান সেই দেশের প্রগতিশীল এবং ভারতের জন্য মোটেই ভাল খবর নয়। গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশে লাগাতার উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও, বাংলাদেশে তাদের ভালই সমর্থন আছে। বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরির জন্যও তাদেরই দায়ী করা হয়। জামাত সদস্যরা বিশেষ করে তাদের ছাত্র শাখা, ছাক্র শিবির সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য হিংস্র উপায় গ্রহণের জন্য বিশেষ পরিচিত। বাংলাদেশের নয়া সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনাতেও অংশ নিয়েছে জামাত নেতৃত্ব। কাজেই সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তারা বেশ বড় ভূমিকা নেবে বলেই মনে রা হচ্ছে। যা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদলে,রক্ষণশীল এবং উগ্র ইসলামি শাসন ডেকে নতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জামাতের আমির পদে বর্তমানে আছেন পেশায় চিকিৎসক, শফিকুর রহমান। এখন তাদের অত্যাচারের ভয়েই কাঁপছে বাংলাদেশী সংখ্যালঘুরা।