জয়িতা চন্দ্র
সরস্বতী পুজো মানেই মেয়েদের অঙ্গে প্রথম শাড়ি, সরস্বতী পুজো মানেই প্রথম কাউকে ভাললাগা, ক্ষণিকের প্রেম। সরস্বতী পুজো মানেই পাকা হাতে পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া, আর দিনভোর হুল্লোড়। কলকাতার বুকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ঢুকে সবটা ভীষণ অচেনা লাগে, ‘গৌরী এলো’ ধারাবাহিকের গৌরী মোহনা মাইতির। আজও তাঁর স্মৃতির ভাঁজে তরতাজা ক্লাস ওয়ান থেকে নাইন। TV9 বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মোহনা জানালেন, সবস্বতী পুজো মানেই তার কাছে নস্ট্যালজিয়া—মন পড়ে থাকে বহরমপুরে। কর্মসূত্রে সেখান থেকে করোনাকালে কলকাতায় চলে আসা তাঁর। প্রথমে ‘ডান্স বাংলা ডান্স’, সেখান থেকেই ধারাবাহিকে কাজ পাওয়া, দেখতে-দেখতে কলকাতার বুকে দু’টো সরস্বতী পুজো কাটালেন তিনি। করোনার সময় যদিও কোথাও সেভাবে সেলিব্রেশন হয়নি। তবে মোহনার কাছে আজও সরস্বতী পুজো মানেই কাকভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের উদ্দেশে দৌড়।
সরস্বতী পুজো বললেই প্রথমে কী মনে পড়ে?
ওরে বাবা, স্কুল-স্কুল (ফোনের ওপারে ভীষণ উত্তেজিত শোনায় মোহনার গলা; আর সেই সঙ্গে হাসি)। ভীষণভাবে স্কুল, আর আমার স্কুলের বন্ধুরা।
আর সরস্বতী পুজোর প্রেম?
দেখুন আমি বা আমার বন্ধুরা প্রেম থেকে দূরেই থাকতাম। প্রেমে খুব একটা আগ্রহ ছিল না আমাদের। তবে সবস্বতী পুজোর একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ উৎসাহী থাকতাম, সেটা হল পুজোর সাজ। কী সাজব, তা নিয়ে প্রতিটা মুহূর্তে চিন্তায় থাকতাম আমরা।
সরস্বতী পুজোর দিনটা কেমন কাটত?
আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়তাম বহরমপুরের মহারানী কাশীশ্বরী গার্লস হাই স্কুল-এ। ওই স্কুলে থাকাকালীন প্রত্যেক বছর সবস্বতী পুজো দারুণভাবে সেলিব্রেট করেছি। আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত সারা বছর অপেক্ষার থাকতাম ওই একটা দিনের জন্য। সকাল-সকাল স্কুলে পৌঁছে যেতাম। ম্যামদের সে দিন কোনও কাজ করতে দেওয়া হবে না। সব কাজ আমরা নিজে হাতে করব। এক কথায় যাকে বলে পাকামি (ফোনের ওপারে হাসি)। পারি বা না-পারি, কাজ সে দিন করতেই হবে। ভক্তির সঙ্গে, নিষ্ঠাভরে পুজো দিতাম। ফল কাটা থেকে শুরু করে, পুজোর জোগাড় করা… স-অ-অ-অ-ব-টা। শিক্ষিকাদের জিজ্ঞেস করে নিতাম, কীভাবে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। কোন ফল কোথায় রাখব? কোন জিনিস কীভাবে সাজাতে হয়, সবটা খুব গুছিয়ে করতাম। খুব বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, হাভভাবটা এমনই থাকত সকলের।
ওই একটা দিনে তাহলে মোহনা দাপিয়ে বেড়াত?
আরে না, না। দাঁড়ান, আরও একটা গল্প রয়েছে তো। শুধু সরস্বতী পুজোর দিন নয়, এরপর একটা দিন থাকত খাওয়া-দাওয়ার জন্য। সে দিনের ব্যাপার-স্য়াপার তো আরও আলাদা। পুজোর দিন যেমন শাড়ি, সে দিন আবার থাকত ওয়েস্টার্ন ড্রেস। বাপ রে, যাচ্ছি স্কুলে সেই খিচুড়ি খেতে… সকাল-সকাল তার কী সাজের বাহার… কে, কাকে টেক্কা দিতে পারে। আসলে আমাদের স্কুল তো ভীষণ কড়া ছিল, ইউনিফর্ম বাদ দিয়ে ক্যাসুয়াল পোশাক পরার কোনও অনুমতি ছিল না। তাই এই দু’টো দিনে একেবারে হইহই-রইরই পড়ে যেত।
আর একটু বড় হওয়ার পর…
তখন তো আবার দিদিগিরি (হাসি)। একটু যারা ছোট, তাদের শাসন করা, ‘এই এটাতে হাত দিবি না’, ‘ওদিকটায় যাবি না’, ‘এটা এগিয়ে দে’, ‘ওটা এনে দে…’। তখন আর আমাদের, মানে সিনিয়রদের, দেখে কে? আর একটু বড় হওয়ার পর একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করতাম। আমাদের তো মূলত মেয়েদের স্কুল। এই একটা দিন বিভিন্ন স্কুলের ছেলেও আসত পুজো দেখতে। কার্ড দিয়ে দিয়ে যে সব স্কুলে নিমন্ত্রণ করা হত পুজোর আগে, তারা আসত। ফলে অনেকেরই মনে মনে ভাললাগা চলত।
আর বাঙালির ভ্যালেনটাইন্স ডে?
দাঁড়ান, গল্প এখানেও শেষ নয়, এ তো সবে গেল সকালের গল্প। এবার পালা বিকেলের। স্কুলে-স্কুলে যে কত কপোত-কপোতি দেখতাম… চারিদিকে শুধু জোড়া-জোড়া। ওই একটা দিনই যেন ছাড়পত্র। কিন্তু আমি বরাবরই খুব ঘরকুনো। বাবা-মায়ের সঙ্গেই বেরতে পছন্দ করি। ওই স্কুলে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আমি বাবার সঙ্গে বেরিয়ে ঠাকুর দেখতাম। বাবা তখন আমায় আরও অনেক স্কুলের ঠাকুর দেখাত।
কলকাতায় আসার পর, এখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সরস্বতী পুজোটা কেমন?
গত বছর (২০২৩) আমি সরস্বতী পুজোটা ভালই কাটিয়েছি। বন্ধুদের ভীষণ মিস করেছি। তা-ও যিনি ‘গৌরী এলো’-র প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন,তিনি সরস্বতী পুজোর আয়োজন করেছিলেন স্টুডিও-য়। সেখানে গিয়েছিলাম, খুব মজা করে পুজো করেছি। এই বছরটা কোথায় কাটবে, এখনও জানি না। আর কলকাতায় চলে আসার পর একবছর ধরে যে স্কুলে আমি পড়ছি, সেখানে তো পুজো হয় না। মানে আমি ঠিক জানিও না সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে আদপে কিছু হয় কি না। কারণ আমি তো ভর্তি হয়েছিলাম গতবছর পুজো হয়ে যাওয়ার পর। দেখা যাক এই বছরটা কেমন কাটে। তবে আমি তো খুব একটা স্কুলে যাই না। আমার সেভাবেই অনুমতি নেওয়া আছে। অনলাইনে ক্লাস করি। তবে গ্রুপে সেভাবে কাউকে তো কিছু বলতেও শুনছি না এখনও। মানে সেই উত্তেজনাটা নেই গো।
আর এখন তো মোহনা সেলিব্রিটি… জীবনে সরস্বতী পুজোর প্রেমটা কি করা হবে না?
আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান অনেকেই। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কাজ দেখে পছন্দ করেছেন। কিংবা কোনও বন্ধু মারফৎ যোগাযোগ করতে চাইছেন। এগুলো তো হয়েই চলেছে। কেউ হয়তো কাউকে বলে, ‘এই, মোহনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিবি? আমার ওকে খুব ভাল লাগে। আমি ওর খুব বড় ফ্যান।’ এগুলো ঠিকই আছে।
কেন প্রেমটা হচ্ছে না?
ওই যে বললাম, এখন বিষয়টা নিয়ে ভাবছি না। আমি প্রেমের বিষয় নিয়ে এখনই খুব একটা ভাবিনি, সত্যি বলছি । আর একটা ব্যাপার হল, আপনারা যেমন জানেন, আমি খুব কথা বলতে পছন্দ করি, আড্ডা দিয়ে থাকি, অনেকেই মনে করেন আমি খুব অহংকারি। কম কথা বলি, তাই সামনে থেকে এসে কিছু বলতে বা আলাপ করতেও খুব একটা সাহস দেখান না অনেকেই। ওই ধীরে, আস্তে কথা বলা, একটা-দু’টো মেসেজ, ব্যস… ওখানেই ইতি (হাসি)।
তাহলে সরস্বতী পুজোকে এখন ভীষণ ‘মিস’ করা হয়?
হুমমম… তবে নতুন জগত, শেষবারটা ভালই কেটেছে। এবারটা কেমন কাটবে, জানি না। কোনও প্ল্যান না থাকলে বন্ধুদের ভিডিয়ো কল করব। তবে একটা জিনিস মনে হয়, এখন তো দু’-একজন আমায় চিনেছে… এখন যদি স্কুলে যেতে পারতাম, অনেকেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসত, অনেকেই কথা বলতে চাইত, এটা মনে-মনে ভেবে বেশ মজা পাই।