বিয়ে মানেই লাল টুকটুকে বেনারসি, মাথায় লাল ওড়না, কপালে চন্দের সাজ, লাল টিপ। কোথাও কালোর লেশমাত্র নেই। কিন্তু কেমন হয় যদি বিয়ের দিন মেয়েরা লালের পরিবর্তে সাদা, হলুদ, গোলাপি বা অন্য কোনও পছন্দের রঙে সাজিয়ে নেন নিজেকে? সোনার পরিবর্তে যদি থাকে রুপো বা অন্যকোনও কাস্টমাইজ়ড গয়না! পাশের বাড়ির কাকিমা হয়তো বলতে পারেন, ‘মেয়ের আবার ট্রেন্ড ভাঙার ঢং হয়েছে‘, কিংবা পিসতুতো দিদি চুপি-চুপি ফোনে মেয়ের মাকে বলতেই পারে, ‘ও আবার ফেমিনিস্ট (Feminist)হল কবে থেকে?’। বন্ধুরা বলতে পারেন, ‘ইশ…বিয়ের দিন লাল ছাড়া অন্য রঙে কনেকে মানায় নাকি! আমি তো নিজের বিয়েতে লাল বেনারসিই পরব‘। কথায় বলে, ‘যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’। আর এই প্রবাদ যে কতখানি সত্যি, তা কিন্তু ঠিক সময়েই টের পাওয়া যায়। পছন্দ-অপছন্দ বা মিথ-ভাঙার প্রসঙ্গ উঠলেই তখন সকলে শাস্ত্রের দোহাই দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আদতে যার কোনও ব্যখ্যা শাস্ত্রেও থাকে না।
বাড়িতে কিংবা কোনও বন্ধুর বিয়ে নিয়ে আমাদের মধ্যে উৎসাহের অন্ত থাকে না। কোন দিন কেমন সাজগোজ হবে, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ের নানা প্ল্যানিং নিয়েই সকলে ব্যস্ত থাকেন। বরং এটুকু দেখার প্রয়োজনবোধ করেন না যে, যার বিয়ে, যাকে ঘিরে এত আয়োজন সে সবকিছুতে খুশি তো? ‘আমার বিয়ে, আমার দিন, আমার ইচ্ছেমতো আমি সাজব’—একথা কিন্তু এখনও জোর গলায় বলতে পারেন না অনেকেই। আর এই কথাটা বলতে পারার মতো তাঁর হাতে যথেষ্ট শিক্ষা, অর্থ, পুঁজি, চাকরি সব থাকলেও কোথাও গিয়ে আবেগ দিয়ে তাঁকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বিয়েতে নিজের পছন্দের রঙের শাড়ি পরা বা কন্যাদানের বিরুদ্ধে তর্জনী তোলাটা কিন্তু কোনওভাবেই প্রথা ভাঙা কিংবা নারীবাদী (Feminism) হয়ে ওঠা নয়। বরং নিজের ভেতরে থাকা ইচ্ছেটাকে আরও বেশি করে প্রশ্রয় দেওয়া।
তবে আজকাল অনেক মেয়েই তাঁর জীবনের বিশেষ এই দিনটি নিজের মতো করেই উদযাপন করছেন। এর জন্য তাঁদের প্রচুর প্রশ্ন, কটাক্ষ, উপেক্ষার সম্মুখীন হতে হলেও কিন্তু তাঁরা থেমে থাকেননি। বরং ঠাণ্ডা মাথায় গৃহযুদ্ধ সামলে নিজের স্বপ্নের পথে পা রাখছেন। কুঁদঘাটের বাসিন্দা ২৪ বছরের তরুণী সহেলী চক্রবর্তী। সদ্য বিবাবিত জীবন শুরু করেছেন সহেলী। প্রথম দিন থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিল বিয়েতে লাল শাড়ির পরিবর্তে সাদা অথবা প্যাস্টেল শেডের লেহঙ্গা পরবেন। বিয়ের দিন এমন সাজের ভাবনা শুনে বাড়িতে সকলেই রে রে করে তেড়ে এসেছিলেন। বেশ কিছু বন্ধু তাঁকে সাবধানবাণীও শুনিয়েছিলেন। মহিলা পুরোহিতরা এসে যখন বাড়িতে বুঝিয়েছিলেন, ‘বিয়ের শুভ লগ্ন বলে আদতে কিছু নেই, দুটি মানুষের মনের মিলই সেখানে মুখ্য’। তা শুনে চিরাচরিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার একটু অবাকই হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের দিন যখন নিজের পছন্দের লুকে সহেলীর স্বপ্নপূরণ হল, সেদিন সকলেই কিন্তু তার সাজের প্রশংসা করেছেন। আর নিজের বিশেষ দিনে এমন স্বপ্নপূরণ হওয়ার ভাললাগাটা সহেলী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন।
বিয়ের দিনে কেমন সাজ পছন্দ,ট্র্যাডিশন্যাল (Traditional)নাকি অন্যরকম (Unconventional Look)কিছু, নিজের বিয়েতে মনের মত সাজার আদৌ সুযোগ ছিল কি? যাঁরা অন্যরকম কোনও সাজ বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের কী-কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই তিনটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ফেসবুকে ‘Women Untamed’-সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত একটি গ্রুপে। সেখানে অসংখ্য মহিলা তাঁদের মনের কথা তুলে ধরেছেন। বিয়ের দিন অনেকেই নিজেকে ট্র্যাডিশন্যাল লাল বেনারসিতে দেখতে চেয়েছিলেন। রিসেপশনে কেউ কাঞ্জিভরম কেউ বেনারসি কেউ লেহঙ্গা নানা ভাবে সেজেছিলেন। অধিকাংশই বিয়ের দিন মনের মত করে সাজার সুযোগ পেয়েছেন।
প্রথা-নিয়মের বাইরে গিয়ে শুধুই সই-সাবুদে বিয়ে সেরেছেন এবং লাল রঙের বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দের পোশাকে সেজেছেন। সাতপাকে ঘোরা, সিঁদুর দান, কন্যাদান, মালাবদলের বাইরে গিয়ে পছন্দের সাদা শাড়িতে সেজে বিয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন অনেকেই। আবার কিছুজন এরকম বলেছেন যে, অন্যরকম সাজার ইচ্ছে থাকলেও সাহস করে তা বাড়িতে বলে উঠতে পারেননি।
এখনকার মেয়েরা বিয়ের দিন কোন লুক পছন্দ করছেন, কী ভাবেই বা সাজতে চাইছেন এই বিষয়ে আমরা বেশ কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম ডিজ়াইনার অনুপম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। অনুপম বলেন, “সব মেয়েই এখন তাঁর বিয়ের দিনের সাজগোজ নিয়ে ভীষণ রকম সচেতন। প্রায় একবছর আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দেন। বিয়ের চেনা লাল বেনারসির পরিবর্তে অনেকেই সোনালি-সাদা কিংবা লাল-পাড় সাদা বেনারসিতে সাজছেন। সেই তালিকায় রয়েছে আরও একাধিক রং। এমনকী বিয়ের জন্য সীতাহার, দুল, টায়রা-টিকলি, মানতাসা, কোমরবন্ধ… সবকিছুই নিজের মত কাস্টমাইজ় করে রুপোতে বানাচ্ছেন। বিয়ের দিন শুধু রুপোর গয়না পরতেও পছন্দ করছেন অনেকে। মেয়েদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাসও রয়েছে। নিজের বিশেষ দিনে সকলেই যে নিজের ইচ্ছেমতো সাজবেন এটাই তো স্বাভাবিক!”
আরও পড়ুন: International Woman’s Day 2022: ‘পাত্র চাই’, ফেসবুক কমিউনিটিতে সিঙ্গল নারীদের বিবাহ অভিযান