সরস্বতী পুজোর দিন আমি সেই শূন্যতাটা অনুভব করি: জয় গোস্বামী
Joy Goswami: সরস্বতী পুজোর স্মৃতিই বা কতটা তরতাজা? এই বিশেষ দিনে কী করেন কবি? কেন এই দিনটায় তাঁর শূন্য লাগে? TV9 বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে স্মৃতির পাতায় ফিরে যাওয়ার গল্প শোনালেন গৌঁসাইকবি।
জয়িতা চন্দ্র
‘কণ্ঠে সরস্বতীর বাস’, ‘কলমে সরস্বতীর আশীর্বাদ’—কথায় বলে। সাধারণের চোখে, তাঁরাই সরস্বতীর বরপুত্র বা বরকন্য়া। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম কলম ধরেন কবি জয় গোস্বামী। তখন তিনি স্কুলে। শহর কলকাতায় জন্ম হলেও পরবর্তীতে তাঁরা রানাঘাটে চলে যান। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকে তাঁরা লেখার জগতের সফর শুরু। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ভারতীয় ভাষা পুরস্কার, বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার… তাঁর ঝুলিতে। টানা ৫০ বছর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বাংলার সাহিত্য জগতকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। সেই কবির সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক ঠিক কেমন? সরস্বতী পুজোর স্মৃতিই বা কতটা তরতাজা? এই বিশেষ দিনে কী করেন কবি? কেন এই দিনটায় তাঁর শূন্য লাগে? TV9 বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে স্মৃতির পাতায় ফিরে যাওয়ার গল্প শোনালেন গৌঁসাইকবি।
সরস্বতীর সামনে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা পড়ি
আমার বাড়িতে পুজো হয়। আমি, আমার স্ত্রী (কাবেরী গোস্বামী) ও কন্যা (ডাকনাম: বুকুম) থাকি। সেই পুজোর শেষে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা পড়ি। আমার মেয়ে একটা গান করে। সেটাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেই। আমার স্ত্রী মন্ত্রপাঠ করেন। আর পুজো যেমন হয়, তেমন হয় প্রতি বছর। খুব সাধারণভাবেই পুজো হয়।
সকলেই কিছু না কিছু মায়ের উদ্দেশে পরিবেশন করতেন
আজ থেকে ধরা যাক ২৫ বছর আগে, আমাদের একজন বন্ধু ছিলেন। বর্তমানে তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই প্রয়াত। আমাদের থেকে বয়সে বড় ছিলেন তাঁরা। তাঁদের বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যায়, একটা অনুষ্ঠান হত। অনুষ্ঠান মানে সে বাড়িতে যাঁরা আসেন, তাঁদের নিয়েই। একান্নবর্তী পরিবার। তিন ভাই, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের থেকে বড়। তাঁরা, তাঁদের ছেলেমেয়েরা, এমনকি তাঁদের বৃদ্ধা মা, সকলেই কিছু না কিছু সরস্বতীর উদ্দেশে পরিবেশন করতেন। এমনকি যিনি কিছু পারতেন না, তিনিও সে দিনের খবরের কাগজ থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠ করতেন। মানে পড়ে শোনাতেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করতেন। আমরা তিনজনেই বাড়ির সকালের পুজো মিটিয়ে, সন্ধ্যার সময় সেখানে পৌঁছে যেতাম। তখন আমার মেয়ে অনেক ছোট। পর-পর কয়েকবছর গিয়েছি। ৪-৫ বছর তো গেছিই। বাড়ির যাঁরা ছোট সদস্য, তাঁরা কেউ গান করতেন, কেউ কবিতা পাঠ করতেন। এমনকি যিনি কিছুই পারেন না, যেমন: বাড়ির যিনি ঠাকুমা… তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধা, তিনিও সে দিন সংবাদপত্র থেকে কিছুটা অংশ পড়ে শোনাতেন। অর্থাৎ এই পরিবেশনাগুলোর মাধ্যমেই দেবীকে আরাধনা করা হত। আমিও সেখানে গিয়ে একটি কবিতা পাঠ করতাম। আমার মেয়ে একটা গান গাইত, এভাবেই কাটে কয়েকটা বছর।
আমি সেই শূন্যতা অনুভব করি
এটা তো ২৫-২৬ বছর আগের কথা, তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির যাঁরা বয়স্ক, তাঁরা একে-একে চলে গেলেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বিভিন্ন দিকে কর্মসূত্রে, পড়ার সূত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা তখন বাচ্চা ছিলেন, পরবর্তীতে চাকরি, বিয়ে, সবটা কেন্দ্র করে সেই জমায়েতটা আর হয়ে উঠত না। সেই ঠাকুমা মারা গিয়েছেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই ও তাঁদের স্ত্রীরাও এখন মারা গিয়েছেন। ফলে সেটা আর হয় না এখন। প্রতি সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় আমি সেই শূন্যতাটা অনুভব করি। এমন একটা সুন্দর পারিবারিক অনুষ্ঠান আমরা কত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেছি। একমাত্র আমার পরিবারই যা বাইরের। সেখানে বাইরের কেউ আসতেন না। বললাম না, একান্নবর্তী পরিবার, বাড়ির সদস্যই তো প্রচুর। বাইরের সদস্য বলতে শুধু আমরাই। মানে সম্পূর্ণ পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠান। যেখানে নাচে, গানে, পাঠে দেবী বন্দনা হত।
একটাই আগ্রহ ছিল যে, কখন খিচুড়ি খাওয়া হবে
এতো গেল কলকাতার স্মৃতি, আরও আগে যদি পিছিয়ে যেতে হয়, তবে মনে পড়ে যেখানে আমি বড় হয়েছি (রানাঘাট), বেড়ে উঠেছি, সেখানে সকলের মতোই আমিও স্কুলেই সরস্বতী পুজো উপভোগ করেছি। আর সেখানে একটাই আগ্রহ ছিল যে, কখন খিচুড়ি খাওয়া হবে। আমাদের স্কুলে লাবড়া আর খিচুড়ি দেওয়া হত, আর শেষ পাতে পড়ত বোঁদে। আমরা সব স্কুলের ছেলেরা দলবেঁধে বসে থাকতাম, কখন কলাপাতায় পেতে বারান্দায় লম্বা করে খেতে দেওয়া হবে। অদ্ভুত ব্যাপার আমাদের মাস্টারমশাইরা পরিবেশন করতেন। মাস্টারমশাইরা বসবেন, আমরা পরিবেশন করব, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মাস্টারমশাইরা আমাদের পরিবেশন করতেন। আবার যখন শিক্ষকেরা খেতে বসতেন, তখন উঁচু ক্লাসের ছেলেরা পরিবেশন করতেন। এটা ছয়ের দশকের কথা বলছি।
আমি আর আমার মন একেবারেই ঈশ্বরে সমর্পিত
১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমি আমার প্রথম কবিতা লিখি। লিখি ঠিক নয়, মানে চেষ্টা শুরু করি। তখন আমি স্কুলে। তবে লিখতে বসার আগে দেবীর আরাধনা করা, বা তাঁকে স্মরণ করে নেওয়া, তেমনটা আমি করেছি বলে মনে পড়ে না। আমি সম্পূর্ণ ঈশ্বরে বিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি নিয়মিত মন্দিরে যাই বা আমি যাবতীয় নিয়ম মেনে পুজো করি, এমনটা নয়। কখনও-কখনও গিয়েছি, নিশ্চয়ই গিয়েছি, যাইনি এমনটা নয়। তবে এর জন্য নিয়মিত যাওয়া এমনটা নয়। আমি প্রতিদিন আহ্নিক করি। তবে মনে-মনে জানি যে, ‘তাঁকে ডাকতে হয়’, ‘তাঁকে ডাকতে হয়’… আমি ডাকি, এই আর কী। এখন যখন আমি আমার নতুন লেখার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছি বা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেখানে শেষ দু’-তিনবছর তো আমি ও আমার মন ঈশ্বরেই শুধু সমর্পিত।
কবিতা কী করে লিখতে হয়, সেটা আমি শিখতে পারিনি
আমি একটা পুস্তক বার করেছি, বিনামূল্যে, সেটা কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যায়। সেখানে আমি বিস্তারিতভাবে লিখেছি, ৫০ বছর ধরে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। শুধু কবিতা নয়, গল্প উপন্যাস, কবিতা বিষয়ক আলোচনা, আরও অনেক বিষয়ে লিখেছি, ছোটদের জন্য লেখা, অনেক ধরনের লেখা ৫০ বছর ধরে ছাপিয়েছি। তারপর আমার মনে হয়েছে ৫০ বছর, যথেষ্ট একটা সময়। এই ৫০ বছর আমি লেখা ছাপিয়েছি ঠিক-ই, তবে কবিতা কী করে লিখতে হয়, সেটা আমি শিখতে পারিনি। এই উপলব্ধিটা আমার মনের মধ্যে জন্মেছে। আমি মুদ্রণ উপযোগী কিছু লাইন তৈরি করতে পারি, শিখেছি, যেটা ছাপা যায়, এই পর্যন্ত… কিন্তু কবিতা কীভাবে লিখতে হয়, আমি শিখতে পারিনি। এই ৫০ বছরে মুদ্রণ জগতের কাছ থেকে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। পত্র-পত্রিকার উৎসাহ, প্রকাশকদের উৎসাহ, পেয়েছি বলেই পেরেছি। এবার আমার মনে হয়েছে বন্ধ করে দেওয়া উচিত, তাই-ই বন্ধ করে দিয়েছি। আরও অনেক আবেগ রয়েছে, যা দু’কথায় বলা সম্ভব নয় বলেই ওটা, মানে বইটা, লেখা। এই বিষয় আরও বিস্তারিত ওখান থেকেই পাওয়া যাবে। তাই বলে তো লেখা ছেড়ে দিইনি। এখনও লেখা আসলে লিখি, কোনও ভাললাগার বিষয় পেলে লিখি, লিখে নিজের কাছেই রেখে দিই।