আরও সুরেলা গাইতেই ঋতুদা বলে উঠলেন ‘রেকর্ডিং বন্ধ করো’, ভাবলাম সব শেষ: চান্দ্রেয়ী ঘোষ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি ছবি ‘দোসর’। অত্যন্ত স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী চান্দ্রেয়ী ঘোষ। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাটানো শুটিংয়ের ওই দু’টো দিন আজও ভোলেননি চান্দ্রেয়ী। TV9 বাংলাকে কী বললেন অভিনেত্রী?
অনেক ছোটবেলায় এক পুরনো জমিদার বাড়িতে পিকনিকে গিয়েছিলাম। ছোট থেকেই চাপা স্বভাবের আমি। পিকনিকে গিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লে বাড়ি ঘুরে দেখতে থাকি একা একাই। দোতলাতে উঠেই অন্ধকার একটা করিডোর, ভয় লাগে আমার। করিডোর দিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখি একটা মস্ত জানলা। সেটা যে আমাকে কষ্ট করে হলেও খুলতেই হতো। খুলতেই সমস্ত অন্ধকার যেন হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ল সেই জানলা দিয়ে আর আমি সেই ছোট্ট চান্দ্রেয়ী অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম সেই শীতের রোদ গায়ে মেখে…
‘দোসর’ ছবির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের? ওই ছবির প্রথম দৃশ্যে একটা করিডোরের শেষে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে গান করেছিলাম আমি… ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ গান…’ ঋতুদা ছিলেন ওই বন্ধ জানলার ওপারের পৃথিবী। তাঁর সঙ্গে কাজ করা, তাঁর সংস্পর্শে আসা যেন ওই বন্ধ দরজা ও খোলার মতোই। ‘দোসর’-এর শুটিংয়ের সময় ওই কয়েকটা দিন আমি যে কত কী শিখেছি… নিজেকে নতুন করে চিনেছি।
শুটিংয়ের আগে গান আর কবিতা (‘তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁলো/যদিও এ প্রথমবার নয়/চুম্বন তো আগেও বহুবার/এবার ঠোঁটে মিলেছে আশ্রয়’) রেকর্ডিং ছিল। এত নার্ভাস ছিলাম, মনে হচ্ছিল স্টুডিয়োতে উপস্থিত সবাই বুঝি শুনতে পারছে আমার হৃদস্পন্দন। আমি বরাবরই পাংচুয়ালিটিতে বিশ্বাস করি, আর সে দিন তো আরও বেশি সতর্ক হয়ে গিয়ে পাঁচ মিনিট দেরিই হয়ে গেল পৌঁছতে। কপাল আর কী! মনে হচ্ছিল নিজেকে মেরে ফেলি। কিন্তু স্টুডিয়োতে পৌঁছতেই ঋতুদা আমাকে এমন করে আপন করে নিলেন যে কী বলব… গানের রেকর্ডিং দিয়ে শুরু হল। প্রথম টেকে আমি স্বাভাবিকভাবেই খুব সুরেলা গাওয়ার চেষ্টা করলাম। ঋতুদা বললেন, ‘‘হয়নি রে একদম। আর একবার ভাল করে গা।’’
আমি ভয় পেয়ে আরও সুরেলা গলায় গাইলাম। হঠাৎ ঋতুদা বললেন, ‘‘রেকর্ডিং বন্ধ করো।’’ আমি তো ভেবেই নিয়েছি, সব শেষ! কিন্তু উনি আমাকে আলাদা ডেকে, খুব নরম করে কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘‘তুই যদি কখনও বাড়িতে একা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বা নিজের মতো গান করিস, তখন যেভাবে গাইবি, এখানেও আমি চাইছি তুই ঠিক সেইভাবেই গা। তোর গানের গলা খুব ভাল, কিন্তু আমি গায়িকার গান শুনতে চাই না। আমি তোর মনের কথা শুনতে চাই।’’ এরপর প্রথম যে টেক হল, সেটাই ‘ওকে’ হয়ে গেল।
আমার এখনও মনে আছে কবিতা রেকর্ডিংয়ের আগে আমাকে বললেন, ‘‘ছোট থেকে নিশ্চয়ই অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের আবৃত্তি শুনেছিস, কিন্তু আমি চাই আজ সব ভুলে যা। এক নতুন কবিতা প্রথম বার একা-একা, মনে মনে পড়লে যেমন শোনাতে পারে, ঠিক সেভাবে পড়।’’ এখন ভাবি কতটা সহজ করে দিয়েছিলেন সব কিছু।
১৪ এপ্রিল ২০০৬। ‘দোসর’ রিলিজ় করেছিল। বাবা আমাকে একটা ‘গীতবিতান’ উপহার দিয়েছিলেন, সেটার প্রথম পাতায় লিখেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান তোমার দোসর থাকুক চিরকাল’’। বাবা ২০০৮-এ চলে যান। ওটাই বাবার দেওয়া শেষ উপহার।
৩১ অগস্ট। আজ তোমার জন্মদিন ঋতুদা। তোমার সঙ্গে কাটানো ওই দু’টো দিন আমি ভুলিনি… ভুলতে পারব না। তবে জানো তো, তোমার সঙ্গে যখন কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম, একটু ছোট ছিলাম তো… তাই-ই তখন অতটা বুঝিনি। কিন্তু আজ যখন মনে পড়ে, তুমি কতটা ইমোশনাল হয়ে, প্রতি মুহূর্তে, প্রত্যেক পরিস্থিতিতে, প্রত্যেক সংলাপ বোঝাতে, এখন বুঝতে পারি জানো? কতটা ভালবাসা তোমার মধ্যে ছিল। তোমার মন, তোমার গভীরতা, আদৌ কেউ পেয়ছেন কি না কে জানে! প্রতিদিনই তোমার জন্মদিন ঋতুদা। তুমি দারুণ থাকো… ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, তেমন করেই গাও গো…’।
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস