বাড়িতেও মাস্ক, কাছে আসায় বাধা, কীভাবে আদৌ উষ্ণ থাকবে সম্পর্ক; পড়ুন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

TV9 Bangla Digital | Edited By: দীপ্তা দাস

Jul 06, 2021 | 12:44 PM

ঘরেও মাস্ক পরার নিদান—উষ্ণ সম্পর্কের সমীকরণে অথবা সম্পর্কের উষ্ণতায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? ফেলা সম্ভব আদৌ? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা, পড়ুন।

বাড়িতেও মাস্ক, কাছে আসায় বাধা, কীভাবে আদৌ উষ্ণ থাকবে সম্পর্ক; পড়ুন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

Follow Us

স্নেহা সেনগুপ্ত

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশে। দেখা গিয়েছে অক্সিজেনের আকাল। হাসপাতালে বেড নেই। করোনায় মৃত মানুষকে সত্‍কারের জন্যে সঠিক পরিকাঠামো নেই। অনেক সময় করোনায় প্রাণ গিয়েছে বলে বাড়িতেই পড়ে থাকছে মৃতদেহ। এক বীভত্‍স পরিস্থিতির সম্মুখীন মানুষ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা দেখে বারবার আরও সতর্ক হতে বলছেন স্বাস্থ্য় দফতরের আধিকারিক থেকে শুরু করে জনস্বাস্থ্য গবেষক ও চিকিৎসকেরা। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ডাবল মাস্কও পরছেন অনেকে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার এই চেন (Chain) রুখতে আরও একটি সতর্কতার কথা বলেছেন ভারতের কোভিড-১৯ টাস্ক ফোর্সের প্রধান ডাঃ ভি.কে পাল। তিনি বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বাড়িতেও মাস্ক! বিষয়টিকে যদিও সতর্কতার খাতিরে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মেনে নিয়েছেন বহু মানুষ। কিন্তু কপালে ভাঁজ পড়েছে দম্পতি, প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা তাঁদের—যাঁরা নিছক ‘ফ্রেন্ডস ইন বেনিফিটস’-এ বিশ্বাসী অথবা ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’-এ স্বচ্ছন্দ্য। বেডরুমের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে মুখে মাস্ক পরে কীভাবে ঘটবে উষ্ণ আলিঙ্গন? চুম্বনের আদান-প্রদান? কীভাবে ‘স্পাইসড আপ’ হবে সম্পর্ক? অনেকের মনেই ঘোরাফেরা করছে এইসব প্রশ্ন। TV9 বাংলা কথা বলল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা সাইকো-অ্যানালিস্ট নীলাঞ্জনা সান্যাল ও জনস্বাস্বাস্থ্য বিশারদ সুবর্ণ গোস্বামীর সঙ্গে (মতামত ব্য়ক্তিগত)

প্রশ্ন: বাড়িতে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে ও যৌনজীবনে কী-কী প্রভাব পড়বে?

নীলাঞ্জনা: একশোভাগ প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমে বলব, বাড়িতে মাস্ক পরার যে প্রসঙ্গ উঠছে, সেই প্রসঙ্গটি কোনওভাবেই কাম্য নয়। তার কারণ, মাস্ক পরে থাকলে নিজের স্বাভাবিকত্ব একই অবস্থায় থাকতে পারে না। সুতরাং সেই দিক থেকে দেখলে কোনও মানুষের কাছেই সেটা কাম্য নয়। কেউ একা থাকুন, পরিবারের মধ্যে থাকুন—কোনও বয়সের কোনও মানুষের কাছেই সেটা কাম্য নয়। যেখানে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠছে, সেখানেও নিজের স্বচ্ছন্দ্য়  অবস্থা, নিজেদের ব্যবহারিক স্বাচ্ছল্য ব্যাহত হবে। যখন পরস্পরের ঘনিষ্ঠতার মধ্যে কোনও মানুষ যান, তখন তাঁর শরীর, তাঁর মুখের এক্সপ্রেশন, তাঁকে কাছে নেওয়ার আগ্রহ—গোটা বিষয়টিই আমাদের মুখায়বের মধ্যে ফুটে ওঠে হাতের ছোঁয়ায়। মুখের সেই এক্সপ্রেশনটাই যদি না আসে, না দেখা যায় কিংবা মুখ অর্ধেক ঢাকা থাকে, তাতে যৌন চেতনা, উত্তেজনা এবং যৌনতার সুখে যে অনুভূতি আছে, তার তৃপ্তি আসতে পারে না। অনেকসময় এরকমও হয় যে, শারীরিকভাবে রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ হচ্ছে, কিন্তু তৃপ্তির অনুভূতি আসছে না। তাতে মনের ভিতর তেতো ভাব থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। খারাপ লাগার বোধ আসতে পারে। অর্থাৎ এই মাস্কিংয়ের জন্য হতাশাব্যঞ্জক মানসিকতা আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই আমি মনে করি।

আরও পড়ুন: PPE পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিত্‍সা করে কোন-কোন রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন কোভিড যোদ্ধারা, খোঁজ নিয়েছেন?

সুবর্ণ: এটা ঘটনা, যিনি বাইরে বেরোচ্ছেন, তিনি যে ইনফেকটেড হয়েই আসছেন, সেটা সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। কারণ, ইনফেকশন হলে ম্যানিফেস্টেশন (উপসর্গ দেখা দেওয়া) হতে সময় লাগে। সংক্রমিত হওয়ার তিনদিন সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যতক্ষণ না ম্যানিফেস্টেশন হচ্ছে, কেউ জানতে পারেন না ব্যক্তি সংক্রমিত কি না। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত বাড়িতে মাস্ক পরে থাকা। কারও কাছে না-যাওয়া। বাড়িতেও দূরত্ববিধি মেনে চলা দরকার। এমনকী, প্রত্যেকের আলাদা-আলাদা ঘরে শোয়া দরকার। কিন্তু এত কিছু তো আর সবসময় বাড়িতে মানা সম্ভব নয়। সব মানুষের বাড়িতে অত সংখ্যক ঘরও থাকে না। এই পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যেককে ‘একসঙ্গে শোবেন না’ বা ‘আলাদা ঘরে শোবেন’ বলছি না। অথবা এটাও বলছি না ‘শোয়ার সময় মাস্ক পরে শুয়ে পড়ুন’। আমরা যেটা বারবার বলছি, ‘বাড়িতে যদি বয়স্ক মানুষ থাকেন, তাঁদের আলাদা ঘরে রাখুন’। যিনি বাইরে বেরোচ্ছেন, তিনি বয়স্কদের ঘরে যাবেন না। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করার সময় আলোচনা হয়েছিল। বাচ্চারা প্রথম ওয়েভে আক্রান্ত হচ্ছিল না। কিন্তু তারা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ক্যারিয়ার ছিল। যেমন স্কুল থেকে ফিরে তারা দাদু-ঠাকুমার কাছে যায়। তাই বাড়ির বয়স্কদের রিস্ক বেড়ে যায়। সেই জন্য আমরা তখন স্কুল বন্ধ করার কথা বলেছিলাম। একই রকম বিষয়, যিনি প্রতিদিন বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন, তিনিও বাড়ির বয়স্কদের কাছে যাবেন না—সেই পরামর্শই আমরা দিচ্ছি। এবার স্বামী-স্ত্রী এক ঘরে শোবেন—এটা তো স্বাভাবিক। আমরা বারণ করলেও সেটা সম্ভব হবে না। সেই সেট-আপও নেই প্রত্যেকের বাড়িতে। যে কারণে একজনের সংক্রমণ হলে অন্যজনও সংক্রমিত হতে পারেন। সুতরাং, কাপলদের মধ্যে সম্পর্ক, তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক জৈবিক সম্পর্ক আটকে থাকবে না। সেখানে মাস্কিংয়ের আলাদা ভূমিকাও নেই। বিষয়টা মেনে চলাও একপ্রকার অসম্ভব। বলছিও না সবকিছু থেকে বিরত থাকতে। তাতে সম্পর্কেও কোনও প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, কারও যদি কো-মর্বিডিটি (ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) থাকে, তাঁকে আলাদা রাখতেই হবে।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: তা হলে মানুষের স্বাভাবিক যৌনজীবন কীভাবে চলবে? আপনারা কী পরামর্শ দেবেন? প্রথমে যদি বিবাহিত দম্পতিদের কথা জিজ্ঞাসা করি, কী বলবেন?

নীলাঞ্জনা: প্রথম অবস্থায় বলব, যদি দেখি কারও নতুন বিয়ে হয়েছে, তাঁদের পারস্পরিক কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা খুব তীব্র। কিন্তু যে কোনও বয়সের মানুষকেই আমি সাজেস্ট করব সময়ের গতিতে আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, সেই দাঁড়ানোর ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে নিজেদের আত্মসংযমের জায়গাকে বড় করতে। কয়েকটা দিন যদি আমরা পারস্পরিক সম্পর্কে যৌনতার জায়গায় না-ও যেতে পারি, মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে আমাদের সুস্থ থাকাটা খুব বেশি প্রয়োজন। কোনও কারণে কিংবা মুহূর্তের কোনও তাগিদে যদি অন্য জন সংক্রমিত হয়ে পড়েন, সেই সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমার নিজের মনে হয়, যেহেতু আমরা সচেতন মানুষ এবং মানুষ কথাটার মধ্যেই হুঁশ শব্দটা রয়েছে, তাই-ই আমাদের বর্তমান সময়ের গুরুত্ব বোঝা দরকার। সচেতন থাকা দরকার। কী করছি, কীভাবে করছি, কেন করছি—তার ছাপ কী হবে, তার আউটপুট কী আসবে, সেটা যদি আমরা চিন্তা করি, তা হলে আমরা এখনকার মতো সেই তাগিদ থেকে সরে আসতে পারব। ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বলছি—একসময় কথায়-কথায় মানুষ রোল কিনে খেত। এটাকে তো আমরা অস্বাভাবিক বলতে পারি না। কিংবা ধরুন রাস্তা থেকে চপ কিনে খাওয়া। সেটা কি এখন আমরা খেতে বলব? এটাও তো একটা তাগিদ। শরীরটা দিয়ে আমরা যত রকমভাবে তৃপ্তি পেতে পারি, সবটার মধ্যেই আমরা ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ব অনুসারে বলব ‘সেক্স’। বডিকে কেন্দ্র করে যেখানেই তৃপ্তি, সেখানেই সেক্স। এখন যথেষ্ট গরম। এরকম সময়ে মানুষ সাঁতার কাটে। এখন কি আমাদের ইচ্ছে হলে সেই জায়গায় আমরা নিজেদের ছেড়ে দেব? অ্যালাউ করব? না, করব না। করা উচিতও না। তাই প্রথম পয়েন্ট হল, আত্মসংযমের জায়গায় নিজের মনকে যদি আমরা না-বাঁধতে পারি, তাহলে মানুষ হিসেবে বলা উচিত যে আমরা বিকৃত মনের। ইচ্ছের তাগিদকে এই সময় সংযমে রাখতে হবে, সেটাই আমার পরামর্শ।

আরও পড়ুন: কোভিড থেকে রক্ষা পেতে মাস্ট ‘ডবল মাস্কিং’! কী করবেন, কী করবেন না, তা নিয়ে নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের

সুবর্ণ: দেখুন, সম্পর্ক তো আর কেবল শারীরিক ক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে না। পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। এই সময় মানসিকভাবে পাশে থাকতে হবে অনেক বেশি। এখন আমরা প্রত্যেকেই আতঙ্কগ্রস্ত, প্রত্যেকেরই মন খারাপ। শারীরিক ইন্টিমেসির চেয়ে মানসিকভাবে কাছে আসার বিষয়টি অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইয়ং কাপল-রা স্বাভাবিকভাবেই ইন্টিমেট হবেন। সেখানে কোভিড কোনওভাবেই বাধা সৃষ্টি করবে না। উপসর্গ দেখা দিলে একজনকে আলাদা থাকতে হবে, সেটাই নিয়ম।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: আত্মসংযমের বিকল্প কী হতে পারে?

নীলাঞ্জনা: এর বিকল্প আছে। সেক্সের বিষয়টা যদি দেখি, ফিজ়িক্যালি যদি একজন আর একজনের সঙ্গে যুক্ত না-ও থাকেন, অন্য ভাবে কাছাকাছি আসতে পারেন। একে-অপরের জন্য খাবার তৈরি করতে পারেন। যেহেতু বাড়ির ভিতরেই আছেন, একসঙ্গে কোনও অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। এখন যদি দু’জনে ক্যারাম কিংবা লুডো খেলেন, তা হলেও তো সংযুক্ত হয়েই থাকছেন। আমার বলার বক্তব্য, একসঙ্গে দু’জনের যুক্ত হয়ে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাস্ক পরেও গল্প করা যেতে পারে। সুন্দর-সুন্দর কথা আলোচনা করা যেতে পারে। নিজের জীবনের ছোটবেলার কথা, কোনও জায়গার কথা, ভাল স্মৃতি রোমন্থন—এগুলোও তো কথোপকথনের মধ্যে আসতে পারে। যদি পুরো বিষয়টিকে কথা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে পারি, অ্যাকশনস দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে পারি, তা হলেও সম্পর্কের মাধুর্য্য হারায় না। আপনি খুব কাছাকাছি গেলেন না, কিন্তু রাতে শুয়ে পরস্পরের চুলে বিলি কেটে দিতে পারেন, পিঠেও সুড়সুড়ি দিতে পারেন। একে-অন্যের দু’টো হাতও তো ধরে থাকতে পারেন। সেখানেও তো তৃপ্তির জায়গা আছে। অর্থাৎ, কমিউনিকেশন খুব জরুরি বিষয়। যেভাবেই হোক, সেটা চালু রাখতেই হবে। পার্টনারকে নিজের মনের কথা জানাতে হবে। মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল সাইকেল চললেও তো সেক্স থেকে বিরত থাকাই নিয়ম। অনেক উপায় আছে। কিন্তু এই সময় আমরা ফোরপ্লে করতেও বারণ করছি। আমি আর একটা বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিই। যেমন ধরুন বাড়ি সাজানো। ধরুন বসার ঘরের সাজগোজকে যদি মাঝেমধ্যেই পাল্টানো যায়। তা হলে কেমন হয়? এতে কিন্তু মন ভাল থাকে। নিত্যদিনের খাবার-দাবারের মধ্যেও এই পরিবর্তনগুলো আনা যায়, তার মধ্যেও তৃপ্তি খুঁজে পেতে পারেন।

সুবর্ণ: বাড়িতে যদি কোনও বয়স্ক মানুষ না থাকেন, আমি-আপনি বললেও কোনও দম্পতি সারাক্ষণ, সারাবছর বাড়িতে মাস্ক পরে থাকবেন না। যদি না কারও একজনের উপসর্গ দেখা যায়।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: অর্থাৎ, মানসিকভাবে কাছাকাছি এলে শারীরিক চাহিদা অনেকটাই অবদমিত হয়। আর যাঁরা লিভ-ইন পার্টনার তাঁদের ক্ষেত্রে কী বলবেন?

নীলাঞ্জনা: একই কথা বলব। এক্ষেত্রে আমার চোখে বিবাহিত কাপল আর লিভ-ইন কাপলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, যেহেতু একই বাড়িতে বসবাস করছেন এঁরা।

সুবর্ণ: বিবাহিত দম্পতি ও লিভ-ইন পার্টনারদের জন্য আমি আলাদা কোনও পরামর্শ দিতে চাই না। দু’টো বিষয়ই এক। একই বাড়িতে থাকছেন তাঁরা। বিষয়টা পৃথক নয়।

আরও পড়ুন: করোনা জয়ীদের শরীরে থাবা বসাচ্ছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’, কীভাবে সতর্ক হবেন?

প্রশ্ন: আর যাঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা, তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?

নীলাঞ্জনা: আমি বলব, ফোনে কথা বলো। ভিডিয়ো কলে কথা বলো। গুগল মিট, গুগল হ্যাংআউট, জ়ুম… এখন তো প্রযুক্তি উন্নত। কত বিকল্প আছে আমাদের সামনে। ফোন-সেক্সেও তো কাছাকাছি আসা যায়। আমরা এখন টেলি-কাউন্সেলিং করছি। সেটা একটা প্রোফেশনাল কমিউনিকেশন। সেটা করতে গিয়েও তো অনেক অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আপনাকে একটা ছোট্ট কথা বলি, আমি অনেকগুলো বছর ধরে এই ফিল্ডে কাজ করছি, ফোনেও তো মানুষের সমস্যার সমাধান করি, তাঁদের কাউন্সেলিং করি। ফোন ছাড়ার আগে তাঁরা আমার মঙ্গল কামনা করেন। এই যে ইমোশনটা আসছে, এটার জন্যে তো আমাকে সশরীরে সামনে যেতেও হচ্ছে না। ফলত ফোন বা ডিজিটাল মাধ্যমেও মানসিকভাবে কাছাকাছি আসা যায়।

সুবর্ণ: প্রেমিক-প্রেমিকারা দেখা-সাক্ষাত্‍ করলে মাস্ক পরেই করবেন। তবে এর জন্য টেকনোলজির সাহায্য নিতে পারেন। ভিডিও-কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে হবে।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: আপনাদের কথা শুনে কুনাল বসু রচিত ও অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘দ্য জাপানিজ় ওয়াইফ’-এর স্নেহময় ও মিয়াগির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেবল চিঠিতে কথা বলেই মানসিকভাবে কাছাকাছি এসেছিল তারা।

নীলাঞ্জনা: একেবারেই তা-ই। সঠিক উদাহরণ। সুতরাং যাঁরা দেখাই করতে পারছেন না, কাছে আসতে পারছেন না, একে-অপরকে হাতে লিখে চিঠিও পাঠাতে পারেন। আমাদের তো এখন চিঠি লেখার অভ্যাস চলে গিয়েছে। চিঠি লেখার সেই অভ্যাসকে যদি আবার ফিরিয়ে আনা যায়, বেশ হয়। একে-অপরকে কীভাবে পেতে ইচ্ছে করছে, সেটা আমরা চিঠিতে বর্ণনা করতেই পারি। কাছে থাকলে কীভাবে পেতাম, দেখা হলে কী দিয়ে ভরিয়ে দিতাম… এই কথাগুলো যদি পরস্পরের মধ্যে চিঠির মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়, সেটা থেকেও তৃপ্তি আসতে পারে।

সুবর্ণ: সত্যি বলতে কী, এই প্রজন্ম ই-মেলে, হোয়াটসঅ্যাপে যতখানি স্বচ্ছন্দ্য়, ততখানি বোধহয় চিঠিতে নয়। অথচ, চিঠির মতো রোম্যান্টিক আদান-প্রদানের মাধ্যম বোধহয় আর হয় না। এই করোনাকালে চিঠিকে ফিরিয়ে আনা যেতেই পারে। হাতে লেখা আবেগ! সেই লেখার স্পর্শে মিশে থাকে অনেকটা ভালবাসা। চিঠি লিখে আবেগ প্রকাশ করুন। একটা নতুনত্বও আসবে। যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্পাইসড আপ’ হবে সম্পর্ক।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: যাঁদের অনেক পার্টনার, কিংবা যাঁরা ‘ফেন্ডস উইথ বেনিফিটস’-এ বিশ্বাস করেন, তাঁদের কী বলবেন এই সময়ে?

নীলাঞ্জনা: যে মানুষ একাধিক পার্টনারে বিশ্বাসী, আমার মতে সে মানুষ নিজের কাছে নিজেই পরিষ্কার নন। তিনি কনফিউজ়ড। তিনি কী খুঁজছেন, কী চাইছেন, সেটা নিজেই জানেন না। আর অতিরিক্ত চাহিদাপ্রবণ মানুষ, নিত্যনতুনের তাগিদে এর থেকে ও, ওর থেকে তার কাছে ছুটে-ছুটে বেড়ান। এটাকে বলা হয়, অপরিণত মনন। অনেকে মনে করেন সেক্স বিষয়টি খাওয়া-দাওয়ার মতো স্বাভাবিক। তাই-ই যদি হয়, তবে আমাদের সঙ্গে জীবজন্তুর কোনও তফাৎ নেই। আমি কিন্তু বন্ধুত্ব করতে বারণ করছি না। কারও সঙ্গে যদি মন মেলে, তাঁর সঙ্গে কথা বলে যদি ভাল লাগে, সেই জায়গায় কিন্তু কোনওভাবেই বারণ করব না। কিন্তু একাধিক সেক্স-পার্টনার রাখার বিরোধিতা করছি। কারণ, একাধিক সেক্স-পার্টনার রাখলে অন্যান্য শারীরিক অসুখের সম্ভাবনা তৈরি হয়। করোনা তো আছেই। তাই এই ধরনের সম্পর্কে যাঁরা বিশ্বাস করেন, বিরত থাকুন।

সুবর্ণ: এই ধরনের সম্পর্ক খুবই হাই রিস্কি বিহেভিয়র। অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শুধুমাত্র কোভিড সংক্রমণই নয়, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ় (যে সংক্রমণ যৌন ক্রিয়া থেকে ছড়ায়) ছড়ানোর ভয়ও থাকে। তাই এই ধরনের সম্পর্কে লিপ্ত বা বিশ্বাসী মানুষকে বলব, এখন একটু বিরতি নিন।

আরও পড়ুন: ইমিউনিটি বাড়াতে বিভিন্ন বয়সে পোস্ট-করোনা ডায়েট কতটা জরুরি?

প্রশ্ন : যে সব কাপল ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ অথবা একজনকে অফিসে যেতে হচ্ছে কিন্তু অন্যজনকে হচ্ছে না, তাঁদের চুম্বনের ক্ষেত্রে কী কোনও বিধিনিষেধ থাকতে পারে এই পরিস্থিতিতে?

নীলাঞ্জনা: এমন কোনও দেশ হতে পারে না, যেখানে আইন ব্যবস্থায় বলা থাকবে যে এই পরিস্থিতিতে একে অপরকে চুম্বন করা যাবে না। কেউ বাইরে যাতায়াত করলে তাঁকে সবসময় পরিচ্ছন্ন হতে বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে চুম্বনের কোনও সম্পর্ক নেই। ভাইরাসটিকে এখন বলা হচ্ছে এয়ার বোর্ন (বাতাসে ছড়ানো)। অর্থাৎ‍, নাক-মুখ দিয়ে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। ফলত, মাস্কিংয়ের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই বৈজ্ঞানিক কারণে চুম্বন করা উচিত না।

সুবর্ণ: বাইরে বেরোলেই কোভিড হয়ে যাচ্ছে, এরকমটা যেমন নয়, আবার ঘরে থাকলে হচ্ছে না, এরকমটাও নয়। সুতরাং মানুষ স্বাভাবিক জীবনই পালন করবেন। কোনও রকম উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে চুম্বনের বিষয়টা এড়িয়ে চলাই ভাল। তা না হলে অযথা আতঙ্কিত হয় কোনও কিছু থেকে বিরত থাকার দরকার নেই।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: মাল্টিপল পার্টনার মানে তো সম্পর্কের কম্পার্টমেন্টালাইজ়েশনও (একই সঙ্গে একাধিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা। মানসিক ও শারীরিক সম্পর্ক দু’টোই তৈরি হতে পারে সেক্ষেত্রে)। সেক্ষেত্রে আপনাদের কী পরামর্শ?

নীলাঞ্জনা: আমাদের সব সম্পর্কই কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড। সেটা ওভারল্য়াপিং হওয়ার কথা নয়। যখন একজন মানুষ একাধিক মানুষের সঙ্গে শারীরিক সঙ্গ খোঁজেন, তখন তিনি মানসিকভাবে একটি ইমেজকে খোঁজেন। কোনও একজন মানুষ তাকে শারীরিকভাবে সেই সুখ দিতে পারে না বলেই এক থেকে অন্য একজন মানুষের সন্ধান করে বেড়ান। কিন্তু বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনও সম্পর্ক থাকবে না, সে রকম কথা আমি একবারও বলছি না। মানসিকভাবে সেটা থাকতেই পারে। তবে এই পরিস্থিতিতে একাধিক মানুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত না হওয়াই ভাল।

সুবর্ণ: কে কোন সম্পর্কে বিশ্বাস করেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়ে যদি আসি, সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়ে কারও যদি উপসর্গ আসে, যে কোনও মানুষের থেকেই ৬ ফুট দূরত্ব রাখতে হবে। ঘনিষ্ঠ হওয়া তো অনেক দূরের কথা।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

Next Article