PPE পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিত্‍সা করে কোন-কোন রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন কোভিড যোদ্ধারা, খোঁজ নিয়েছেন?

কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা কমার কোনও লক্ষণ নেই। দেশের কোনও হাসপাতালেই যেন করোনা রোগীদের ঠাঁই দেওয়ার পর্যাপ্ত বেড নেই। আকাল অক্সিজেনেরও। তার মধ্যেই সব কোভিড রোগীদের সুস্থ করে তোলার ব্রত নিয়েছেন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা।

PPE পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিত্‍সা করে কোন-কোন রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন কোভিড যোদ্ধারা, খোঁজ নিয়েছেন?
কোভিড যোদ্ধারা কেমন আছেন?
Follow Us:
| Updated on: May 15, 2021 | 12:05 PM

এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা নিয়ে যুদ্ধ করে চলার পর ধীরে-ধীরে কমছে চিকিত্‍সক-নার্সদের সংখ্যা। সরকারি ও বেসরকারি, যেখানে-যেখানে কোভিড হাসপাতাল রয়েছে, সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। রুগ্ন স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর মধ্যেই চলছে করোনার চিকিত্‍সা। প্রতিদিন রোগীদের মৃত্যুমিছিলে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন চিকিত্‍সক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। খবরে কোভিড রোগীদের অবস্থা, করোনা ভাইরাসের দৌরাত্ম্য নিয়ে আলোচনা হলেও করোনার প্রকৃত যোদ্ধাদের পরিস্থিতি জানার অবকাশ নেই। তাঁরা ভাল থাকলে তবেই সুষ্ঠুভাবে চলবে স্বাস্থ্য-ব্য়বস্থা। অতিমারি পরিস্থিতিতে চিকিত্‍সক-স্বাস্থ্যকর্মীরা কেমন আছেন, তার তল পাওয়ার চেষ্টা করল TV9 বাংলার সাংবাদিক দীপ্তা দাস

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে কোভিড রোগীদের সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন চিকিত্‍সক-নার্সরা। অনেকেই ইতোমধ্যে অভিযোগ জানিয়েছেন, করোনার রোগীদের ঠিকমতো দেখভাল করছেন না তাঁরা। করোনা দেশে আসার পর চিকিত্‍সকেরা দু’বেলা রাউন্ড দিতেন, বর্তমানে একবার করে রাউন্ড দিয়েই চলে যাচ্ছেন। সঠিক পরিষেবা পাচ্ছেন না বলে অনেক রোগীর পরিবার অভিযোগ জানিয়েছেন। এমনকী হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও কোভিড রোগীদের সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরানোর গোটা দায়িত্ব যাঁদের উপর, তাঁরা কেমন আছেন, কীভাবে ৬ ঘন্টা ধরে পিপিই-কিট পরে সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তা কখনও ভেবে দেখেছেন? পিপিই-কিট পরে যে-যে রোগ শরীরে নতুন করে বাসা বাঁধে অথবা বাঁধতে পারে, সেগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। কারণ কোভিড ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে গেলে পিপিই-কিট পরা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক একটি জিনিস। কোভিড ওয়ার্ডে চিকিত্‍সকদের করুণ অবস্থার কথা শোনালেন বাঁকুড়ার ওন্দা সুপার স্পেশ্য়ালিটি হাসপাতালের চিকিত্‍সক নিশা সমাদ্দার

– কোভিড ওয়ার্ডে প্রবেশ করার আগে ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরতে হয় পিপিই পোশাক। বাইরে থেকে রেন কোট-এর মতো মনে হলেও এই বিশেষ পোশাক যেমন মোটা, তেমনিই বদ্ধ। প্রায় ত্রিপলের মধ্যে দমবন্ধ করা অবস্থা। সঙ্গে রয়েছে গ্লাভস, ফেস শিল্ড, দু’টি করে ফেস মাস্ক (অবশ্যই এন৯৫ মাস্ক), মাথায় ক্যাপ। ভিতরে থাকে আরও একটি পোশাক, যা অপারেশন থিয়েটারের জন্য। প্রসঙ্গত, কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি চলাকালীন কোনও চিকিত্‍সক আন্ডারগার্মেন্টস বা অন্তর্বাস পরতে পারেন না।

আরও পড়ুন: সর্বনাশা ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি মিলবে কবে? স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আকুল মানুষ

-কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসে চিকিত্‍সা করার জন্য চিকিত্‍সক-নার্সরা এই পিপিই-কিট পরেন তো বটে। কিন্তু এই পোশাক পরার পর থেকে যতক্ষণ না সুরক্ষিত জায়গায় যাচ্ছেন, ততক্ষণ জল খেতে পারেন না। নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে, সেই ঘর স্যানিটাইজ় করে, পিপিই-কিট বদলে, ওয়াশ রুমে শ্যাম্পু ও সাবান দিয়ে স্নান না-করা পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে বের হতে পারেন না কোনও করোনা যোদ্ধার। খিদে পেলে বা জল তেষ্টা পেলেও কোনও উপায় থাকে না। কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিজেদের শরীরের খেয়াল রাখা হয় না অনেক সময়ই। যাঁদের ব্লাড সুগার রয়েছে, তাঁদের বারবার টয়লেট পাওয়া স্বাভাবিক। তাঁদের ক্ষেত্রে অ্যাডাল্ট ডাইপার পরা আবশ্যিক। তা না হলে বারবার ওয়াশ রুমে যাওয়া মানেই ফের নতুন করে পিপিই-কিট পরতে হবে এবং ওয়ার্ড ছেড়ে বের হওয়ার কারণে স্নানও করতে হবে।

-মহিলা চিকিত্‍সক ও নার্সদের অবস্থা অনেকটাই শোচনীয়। যাঁদের লম্বা ও ঘন চুল রয়েছে, তাঁরা এই কোভিড ডিউটি পালন করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাঠে নামেন। প্রতিদিন কোভিড ডিউটি শেষে স্নান করার পর ফের সকালে হাসপাতালে পৌঁছে কোভিড ওয়ার্ডে যাওয়া বেশ কঠিন। এ ছাড়া দীর্ঘক্ষণ ঘণ্টা ধরে ইউরিন চেপে থাকার কারণে বহু চিকিত্‍সক ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের শিকার হচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের চিকিত্‍সকদের এখন কমন বাথরুম ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে সেখান থেকেও সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। শুধু তাই নয়. কিডনিতে স্টোন, কিডনির সমস্যাও দেখা দিচ্ছে অনেকের।

আরও পড়ুন: International Nurses Day 2021: কোন ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক ‘নার্সেস ডে’- র আড়ালে

-অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে পিপিই-কিট পরা মহিলা চিকিত্‍সকেরা পিরিয়ড চলাকালীন কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হন? শারীরিক ও মানসিক সমস্যাকে অতিক্রম করেই চলছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। পিরিয়ড চলাকালীন এখন মহিলা চিকিত্‍সকেরা নিজেদের সুবিধের জন্য স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করছেন। তাতে নিজেদের চিকিত্‍সা করার পাশাপাশি অনেকটাই সাবধান ও সুরক্ষিত পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

-অন্য দিকে এত ঘণ্টা ধরে পিপিই-কিট পরে থাকার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম নির্গত হচ্ছে। ডিহাইড্রেশনের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম বের হওয়ায় শারীরিক অস্থিরতা ও অসুবিধের সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘামে ভিতরের জামাকাপড় ভিজে থাকায় ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন অনেকে।

পুরুষদের থেকে মহিলা চিকিত্‍সকদের অসুবিধার অন্ত নেই। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিদিন পিপিই কিট পরা মহিলা ডাক্তারদের পিরিয়ডস চলাকালীন নানা অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে তাঁদের কী কী করণীয় ও চিকিত্‍সা করার সময় মাথায় রাখতে হবে কোন কোন বিষয়গুলি, সেগুলি নিয়ে কথা বললেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর পল্লব মিস্ত্রী

১. ৫-৬ ঘন্টা ধরে পিপিই কিট পরে মহিলা ডাক্তাররা কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। পিরিয়ডসের সময় অসুবিধা তৈরি হয় অনেকটাই। সেক্ষেত্রে কী করা উচিত?

– স্বাভাবিক ঋতুকালীন সময়ে একটি স্যানিটারী প্যাড মোটামুটি তিন থেকে চার ঘণ্টা ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, বড় ও অধিক শোষণ ক্ষমতা রাখে এমন প্যাড বাজারে পাওয়া যায়, তাই ব্যবহার করা যাবে। তাহলে বেশিক্ষণ প্রোটেকশন পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন: কোভিড থেকে রক্ষা পেতে মাস্ট ‘ডবল মাস্কিং’! কী করবেন, কী করবেন না, তা নিয়ে নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের

২. গ্রামের দিকে কোভিড হাসপাতালে মাসের পর মাস কাটানোর পর মেনস্ট্রুয়াল কাপ কেনা বা অর্ডার দেওয়া হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে পিপিই কিট পরে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা কতটা সুরক্ষিত?

– ট্যাম্পন বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার না করে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার যুক্তিযুক্ত। এতে ইনফেকশন কম হয়।

৩. দীর্ঘক্ষণ ধরে টয়লেট না করা, জল না খাওয়ার জন্য শারীরিক অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। ইউটিআইয়ের প্রকোপ বাড়ছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়?

– এটি একটি সত্যিই অসুবিধা। PPE পরে কাজকর্ম যদি এসি রুমে হয়, তাহলে কিছুটা হলেও ভালো। এছাড়া, হাইজিন মেনে চলা এবং পরে যথোপযুক্ত জলের প্রয়োজন মেটানো ছাড়া কিছু করণীয় নেই। ইনফেকশন হয়ে গেলে চিকিৎসা দরকার।

৪. এই সময় কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে। পিরিয়ডস চলাকালীন কি আদৌও কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে যাওয়া উচিত?

– উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে কোভিড রোগীর সেবা দিতে কোনও বাধা নেই।

আরও পড়ুন: শুধু ফুসফুসে সংক্রমণ নয়, কোভিডের জেরে রক্তে জমাট বেধে মৃত্যুর সম্ভাবনাও বাড়ছে!

কোভিড অতিমারিতে যাঁরা মারণভাইরাস মোকাবিলার জন্য প্রথম সারিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন, তাঁরাও মানুষ। তাঁদেরও রয়েছে পরিবার। অসুস্থকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব যাঁদের উপর, তাঁদের উপর ভরসা না হারানোই কাম্য। রুগ্ন পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে নানা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। শুধু শারীরিক উন্নতিই নয়, কোভিড রোগীদের মানসিক জোর বাড়ানোর চেষ্টাও করে চলেছেন। প্রতিদিন অগুণতি মৃত্যু দেখার পর কারোরই মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকে না। চিকিত্‍সার পাশাপাশি মৃত্যুমিছিলের দৃশ্য দেখে মানসিক হারসাম্য হারাচ্ছেন বহু চিকিত্‍সক-নার্সরা। তাঁদের সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব কে নেবে? তাঁরা ভাল আছেন কি না, তার খোঁজ কে রেখেছে? পরিবারের সঙ্গে দেখা করা, দীর্ঘ কয়েকমাস সন্তানের মুখ না-দেখা, বাড়ি ফিরলেও চার দেওয়ালের মধ্যে ঘরবন্দি থাকা, নিজের শখ-ইচ্ছেকে বিসর্জন দেওয়া চিকিত্‍সক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন করোনা যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের এই আত্মবলিদানের মর্যাদা যেন সমাজ দেয়, সেটাই একমাত্র কাম্য।