Sigmund Freud: গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল কোকেনের নেশা, কী হল ‘খলনায়ক’-এর?

শিশুদেরও যৌনতা? লিবিডো, ফিক্সেশন? বিকৃতকাম, গাঁজাখুরি রূপকথা আরও কত কী বাছা-বাছা সমালোচনা ধেয়ে আসে মনোসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দিকে।

Sigmund Freud: গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল কোকেনের নেশা, কী হল 'খলনায়ক'-এর?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: May 06, 2022 | 6:10 AM

পায়েল মজুমদার

বৈপ্লবিক চিন্তাধারা, বিতর্ক, বিদগ্ধ আলোচনা, আপাত বৈপরীত্যে ভরা জীবন। সবটা নিয়েই সিগমুন্ড ফ্রয়েড। আজ থেকে ১৬৬ বছর আগে এ দিনেই তৎকালীন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের মোরাভিয়ার ফ্রেইবার্গে জন্মেছিলেন সাইকো-অ্যানালিসিসের জনক। তোলপাড় ফেলা সে সমস্ত কর্মকাণ্ডকে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আরও একবার ফিরে দেখা…

মারকাটারি কিছু একটা করে তাক লাগিয়ে দিতে হবে। যেন এক ডাকে সকলে চেনে। ইচ্ছেটা মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছিল। এটা, ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু সেখান থেকেই। তারপর… সেই গবেষণাপত্র! প্রকাশ হতেই তুমুল শোরগোল। কিন্তু নাহ, হিসেব মিলল না। চেয়েছিলেন খ্যাতি, জুটল নিন্দা। শেষমেশ কোকেনের মতো মাদকের ইতিবাচক দিক নিয়ে গবেষণাপত্র? সালটা ১৮৮৪। গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই ইউরোপ থেকে আমেরিকায় অতিমারির মতো ছড়িয়ে পড়ল কোকেনের নেশা। মূল খলনায়ক কে? সিগমুন্ড ফ্রয়েড, তীব্র সমালোচনা ভিয়েনার চিকিৎসকমহলে।

কী করবেন ২৮ বছরের যুবক? ভিয়েনায় তো মুখ পুড়েছে। এবার ডাক্তারিতে পসার জমাবেন কী করে? কিন্তু হাল ছাড়ার বান্দা তিনি নন। ১৮৮৫। নিউরোপ্যাথোলজি নিয়ে আরও লেখাপড়া করতে চলে গেলেন প্যারিস। সেখানেই টার্নিং পয়েন্ট। ‘হিস্টেরিয়া’, ‘হিপনোসিস’, শারীরিক রোগের কারণ যে শরীরেই কোথাও লুকিয়ে থাকবে এমন না-ও হতে পারে, জানছেন যুবক সিগমুন্ড। কনশাসনেস বা মনের সচেতন অংশ থেকেও ‘আনকনশাস’ বা অবচেতনের রহস্য বেশি করে হাতছানি দিচ্ছে তাঁকে। কী আছে ওই আঁধারে?

১৮৯৩! জোসেফ ব্রিউওয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে লিখলেন ‘স্টাডিজ় অন হিস্টেরিয়া।’ তোলপাড় শুরু মনোবিজ্ঞানের দুনিয়ায়। কী সব বলছেন ওঁরা? সমালোচনা, নিন্দা, ধিক্কার, সবই আছড়ে পড়তে শুরু করল। ফ্রয়েড-ও নাছোড়। সবার উপরে অবচেতন সত্য… বাকি সব পরের কথা। মানবমন নিয়ে যতটুকু জানা, তার ষোলো আনাই ঠিক নয়, আরও দাবি মনসমীক্ষণের জনকের। কে বলেছে মানুষ সব কিছুই ভেবেচিন্তে, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে করে? আসলে অবচেতনের আঁধারে থাকা আদিম প্রবৃত্তির হাতেই সব আচরণের চাবিকাঠি। সহজ করে বললে যৌনতা ও আগ্রাসী প্রবৃত্তি—এই দুই নিয়েই অবচেতনের কারবার। সময়, অসময়, স্থান, কাল, পাত্রের পরোয়া করে না আদিম প্রবৃত্তিগুলো। এদের সঙ্গে তাই সমাজের নিয়মকানুন, বিধিনিষেধের যুদ্ধ চলে লাগাতার। দু’পক্ষের দড়ি টানাটানি সামলাতে কার্যত মোড়লের কাজ করে Ego। ভাবনাচিন্তা, যুক্তিবুদ্ধি, সব কিছুই Ego দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার অন্য ধরনের কিছু সেপাইসান্ত্রীও রয়েছে Ego-র, যাদের defense mechanism বলে চিহ্নিত করে গিয়েছেন ফ্রয়েড। কিন্তু এত সব দিয়েও যখন দু’পক্ষের যুদ্ধ পরিস্থিতি সামলানো যায় না, তখনই গণ্ডগোল—যার ছাপ ফুটে উঠতে পারে শারীরিক উপসর্গ বা মনোরোগের লক্ষণ হয়ে।

যা-তা বলছেন ডক্টর ফ্রয়েড! কোনও প্রমাণ আছে এসবের? ডাক্তারিশিক্ষায় কুলীন ভিয়েনা নতুন তত্ত্ব শুনে দু’কানে আঙুল দিচ্ছে। শিশুদেরও যৌনতা? লিবিডো, ফিক্সেশন? বিকৃতকাম, গাঁজাখুরি রূপকথা আরও কত কী বাছা-বাছা সমালোচনা ধেয়ে আসছে মনোসমীক্ষণের জনকের দিকে। তিনিও পাল্টা দিচ্ছেন। চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজে যা জেনেছেন, বুঝেছেন, সেটাই ঠিক। তার সঙ্গে একচুলও আপস করবেন না। প্রয়োজনে দীর্ঘদিনের সতীর্থদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেঁটে ফেলছেন। তবে নিজের তত্ত্বে অনড়। অবচেতনে থাকা আদিম প্রবৃত্তিই সে তত্ত্বের মূলসূত্র। যে যত ভুরু কোঁচকাক, মানবমনের সত্যিটা বদলায় না।

Sigmund Freud

তবে সমালোচকদের থেকে সমর্থকদের সংখ্যা যে খুব কম ছিল, এমন নয়। দ্রুত সাইকো-অ্যানালিসিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকে এটি নিয়ে চর্চা শুরু করেন। ক্যারেন হরনাই, এরিক ফ্রমের মতো অনেকেই এগিয়ে আসেন। ভারতের সঙ্গে বা আরও নির্দিষ্ট করে বললেও বাংলার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল ডক্টর ফ্রয়েডের। কী রকম? চিকিৎসক গিরিন্দ্রশেখর বসুর ডিএসসি থিসিস Concept of Repression ১৯২১ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়।  ঘটনাচক্রে সেই বছরই ফ্রয়েডের বইয়ের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ ভারতে পৌঁছয়। দেখা যায়, ফ্রয়েডের লেখা অনেক বিষয়ই চিকিৎসক বসু নিজের পদ্ধতিতে তাঁর থিসিসে লিখেছেন। ভিয়েনা থেকে এত দূরে সাইকো-অ্যানালিসিস মান্যতা পাচ্ছে দেখে রীতিমতো খুশি হয়েছিলেন ফ্রয়েড। পত্রালাপও চলে দুই চিকিৎসকের মধ্যে।

পরে সে যোগাযোগ ছিন্ন হলেও পার্শিবাগান লেনে ইন্ডিয়ান সাইকো-অ্যানালিটিকাল সোসাইটি কিন্তু আজও মনোসমীক্ষণের বহুমুখী চর্চা ধরে রেখেছে।

কিন্তু কেন ছিন্ন হল যোগাযোগ? কেন ক্যারেন হরনাই বা এরিক ফ্রমের মতো একদা সহযোগী পণ্ডিতদের ব্যাপারে তিক্ত হয়ে উঠলেন ফ্রয়েড? যে যৌনতা তাঁর সমস্ত তত্ত্বের মূলসূত্র, ব্যক্তিগত জীবনে সেই যৌনতা নিয়েই কেন এত নিরাসক্ত ছিলেন? উত্তর আছে বা হয়তো সেই উত্তর যথেষ্ট নয়। তবে চর্চা জরুরি। কারণ জন্মের ১৬৬ বছর পরও নিরন্তর বিতর্ক ও চর্চাতেই বেঁচে রয়েছেন ফ্রয়েড।

(ঋণস্বীকার: গিরিন্দ্রশেখর বসু, অগ্রন্থিত বাংলা রচনা, সংকলন, সম্পাদনা এবং অবতরণিকা, অমিতরঞ্জন বসু)