World Toilet Day 2021: মহিলারা ইউরিনের বেগ চেপে রাখছেন! বাড়ছে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ভয়!
জানেন কি, আজ আন্তর্জাতিক টয়লেট দিবস? কেন এই দিনটি পালন করা হয় সেই প্রশ্ন দূরে থাক, আদৌও যে এই দিনটি রয়েছে, তাই অনেকে জানেন না। অথচ লক্ষ লক্ষ নারী আক্রান্ত হচ্ছেন ইউরিনের সংক্রমণে। কী করবেন? জানাচ্ছেন স্বনামধন্য চিকিৎসকরা।
লকডাউন উঠতেই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্ল্যান করলেন স্কুল শিক্ষিকা শ্রীতমা। প্রতিবারের মতো স্বামীর সঙ্গে লং ড্রাইভে না গিয়ে ঠিক করলেন দূরপাল্লার ট্রেনেই লাল মাটির দেশে পৌঁছে যাবেন। অন্যরকম অভিজ্ঞতাও হবে। পরিকল্পনা মতোই ট্রেনে চাপা। ট্রেন বর্ধমানে ঢুকতে না ঢুকতেই ইউরিনের চাপ বাড়ল। একটু হালকা হওয়ার জন্য টয়লেটের দরজা ঠেলতেই চক্ষু চড়কগাছ শ্রীতমার! গোটা বাথরুমটা যেন ডাস্টবিন! থকথকে কাদায়, জলে ভয়াবহ নোংরা টয়লেট! এদিকে ব্লাডারে পড়ছে অসহনীয় চাপ। অগত্যা কোনওরকমে নোংরা বাথরুমেই ইউরিন পাস করতে হল। স্বস্তি খানিক মিলল বটে, তবে সংক্রমণের ভয়টাও জাঁকিয়ে বসল মনে। আতঙ্কেই বেশ কয়েকবার জল খেয়ে ফেললেন শ্রীতমা। এদিকে ফের ইউরিনের বেগ এলে কী করবেন, জানা নেই তাঁর!
উপরিউক্ত সমস্যা শুধু শ্রীতমার নয়। প্রতিটি মহিলাকেই নিত্যদিন একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে! একটু খোঁজ করলেই জানতে পারবেন, স্কুল-কলেজ বা অফিসে কর্মরতা অনেক মহিলা রয়েছেন, যাঁরা প্রতিদিন ট্রেনে-বাসে চড়ে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছান। এই কর্মীদের অনেকেই ডায়াবেটিস বা কঠিন রোগে আক্রান্ত । ডায়াবেটিসের রোগীদের ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ আসে। কখনও ভেবে দেখেছেন দীর্ঘসময় ধরে টয়লেট চেপে রাখতে গিয়ে কতখানি শোচনীয় অবস্থা হয় তাঁদের? যাঁরা প্রেগন্যান্ট মহিলা, বা পাঁচ বাড়ি কাজ করা পরিচারিকা? তাঁদের অসুবিধার কথাই বা ভেবেছেন ক’জন?
শারীরিক গঠনের কারণে পুরুষরা না হয় রাস্তার ধারে, ডাস্টবিনের স্তুপে দাঁড়িয়েও অনায়াসে মূত্রত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু মহিলারা তা পারেন না। ভব্যতার কথা বাদ দিন। মহিলাদের শারীরিক গঠনের কারণেই তাঁরা এমনটা পারেন না। তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায় ষোলো আনা। কতশত মেয়েরা শুধু অফিসে টয়লেট নেই বলে বা নোংরা টয়লেটের জন্য সারাদিন জল পান করে না জানেন? জানেন না।
এও জানেন না যে দীর্ঘদিন ধরে টয়লেট ধরে রাখার অভ্যেস, কম জলপানের অভ্যেস কীভাবে ধীরে ধীরে আপনার শরীরে ঘুণ ধরাচ্ছে!
চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ইউরেথ্রা বা মূত্র নিষ্কাশনের জায়গার দৈর্ঘ্য কম। ফলে মহিলাদের মূত্রনালীতে চট করে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নোংরা জায়গায় ইউরিন করা, জল কম খাওয়ার কারণে পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বেশি হয়। তাই কর্মক্ষেত্র বাড়ি থেকে দূরে হলে দূরপাল্লার যাত্রা করলে মহিলাদের বিশেষ করে সতর্ক থাকা উচিত। এই ব্যাপারে রুবি জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও মেডিসিন রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশিস মিত্র জানান, ডায়াবেটিস, স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত মহিলা কিংবা মেনোপজ হয়ে গিয়েছে এমন মহিলার মূত্রত্যাগের সমস্যা বেড়ে যায়। এই বিষয়ে আগাম সতর্কতা নিতে হবে। ইউরিন পাসের জন্য নোংরা জায়গা বা টয়লেট এড়িয়ে চলতেই হবে। বিশেষ করে যে জায়াগায় ইউরিন পাস করছেন, সেই জায়গাটি খুব ভালো করে পরিষ্কার থাকা দরকার। অথচ আমাদের দেশের এমন বহু স্কুল কলেজ রয়েছে, যেখানে টয়লেটের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। ডাঃ মিত্র আরও বলেন, মহিলাদের সংক্রমণ ঘটার অন্যতম জায়গা হল ইংলিশ স্টাইলের কমোড। কমোডে ইউরিন পাস করার সময় স্কিন কনট্যাক্ট হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত মূত্রনালীর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। তাই সবসময় কমোডটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতিবার টয়লেটের পর জীবাণুনাশক দিয়ে কমোড ধুয়ে দিতে হবে কিংবা বাজারচলতি জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। এছাড়া দু’বার করে ফ্ল্যাশ করে তারপর ইউরিন করুন। এরপর গোপন অঙ্গে জল দিয়ে পরিষ্কার করার পর ফের একবার ফ্ল্যাশ করুন। এরফলে নিজে যেমন সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচবেন, তেমনই পরবর্তী টয়লেট ব্যবহারকারীকেও সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
আবার, রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালের জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাসও বলেন, যেখানেই বাথরুম ব্যবহার করুন না কেন, সেই জায়গাটি অবশ্যই পরিষ্কার থাকতে হবে। শহরের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখায় না হলেও মহিলাদের জন্য রয়েছে সুলভ শৌচালয়। সেগুলি যাতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া স্কুল-কলেজের বাথরুমও হতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। না হলে মহিলাদের শারীরিক সমস্যাগুলি কোনওদিনই মিটবে না। বিশেষ করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে টয়লেট চেপে রাখলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, রাস্তায় জল কম পান করলেও কর্মক্ষেত্রে ঢোকার পর জল পান করতে হবে। না হলে ঘনঘন সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়বেই এমনকী কর্মক্ষেত্রে টয়লেট না থাকলে, সেখানে টয়লেট গড়ার আবেদন করতে হবে।
ডাঃ আশিস মিত্র আরও জানিয়েছেন, যাঁরা সুগারে আক্রান্ত তাঁরাই শুধু নন, প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মধ্যে মূত্রনালীতে সংক্রমণ দেখা যায়। এই ধরনের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে জলের পাশাপাশি ক্র্যানবেরির জ্যুস বা ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে।
ডাঃ মিত্র আরও বলেন, ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তবে সময় বদলাচ্ছে। পুরুষের পাশপাশি মহিলারাও কর্মক্ষেত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। অথচ পুরনো আমলের চিন্তাভাবনা কাটেনি। এই কারণেই কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে পুরুষের জন্য টয়লেট বানানো হলেও মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয় না! তাঁর কথায়, প্রাথমিক স্কুল থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে টয়লেট নিয়ে শিক্ষা দেওয়া উচিত। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। ছোট থেকেই শিক্ষা পেলে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাসের মতে, প্রশাসন পারে সুলভ শৌচালয়ের সংখ্যা আগের থেকে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে। তবে শুধু শৌচালয় তৈরি করলেই হবে না। সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি।
একনজরে—
• ইউটিআই এড়াতে সারাদিনে প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন। শীতকালে জল পান কম করা হয়। এই ঋতুতে কর্মরতা ও গৃহী মহিলাদের পর্যাপ্ত জলপান জরুরি। • জলের অভাবে শরীর শুষ্ক হয়ে গেলে সংক্রমণের মাত্রা ও সমস্যা বাড়তে পারে। কিডনির উপর কুপ্রভাব পড়ে। এর জেরে কিডনিতে পাথরও জমতে পারে। • ইউটিআই সন্দেহ হলে চিকিৎসক ইউরিন রুটিন ও কালচার করাতে দিতে পারেন। এরপর দিতে পারেন অ্যান্টিবায়োটিক। তাই বলে মূত্রনালী জ্বালা হলে বা ইউরিনের সমস্যা দেখা দিলেই ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না। সবসময় চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। • স্বাস্থ্যকর খাবারের সঙ্গে ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার যেমন আমলকীর রস, ক্র্যানবেরির জ্যুস বা ট্যাবলেট খেতে পারেন। যাঁদের ঘনঘন সংক্রমণের প্রবণতা দেখা যায়, তাঁরাও দিনে একবার করে ক্র্যানবেরির জ্যুস খেতে পারেন। তবে প্রেগন্যান্ট মহিলা বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলারা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেই ওষুধ বা জ্যুস খাবেন। • অনেকেই ইউরিনের চাপ সহ্য করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে তরল খাদ্য ও জলপানের মাত্রার ব্যাপারে সচেতন হোন। দূরে বেড়াতে যাওয়ার থাকলে রাস্তায় অল্প অল্প করে জল পান করুন। একসঙ্গে অনেকটা জলপান করবেন না। • বাথরুমে যাওয়ার আগে জায়গাটিকে ভাল করে পরিষ্কার করে নিতেই হবে। গ্রামেগঞ্জে এখনও অনেক বাড়িতে টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। তাঁদেরকে অবিলম্বে শৌচালয় গড়ে দেওয়া প্রয়োজন। • টয়লেট সম্পর্কে ছোট থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিতে হবে অভিভাবক ও প্রশাসনকে। বাড়তে হবে শৌচালয়ের সংখ্যাও। যত্রতত্র মূত্র-মলত্যাগ না করে বাড়ির লাগোয়া বাথরুমেই কাজ সারুন। তাতে পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে।
আরও পড়ুন: World Toilet Day: বিচিত্র এ বিশ্ব! সাহস থাকলে এই ৬ টয়লেট-থিমযুক্ত রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে দেখান
আরও পড়ুন: World Toilet Day 2021: সচেতনতা সঙ্গে ইতিহাস; ভারতেই রয়েছে সুলভ শৌচালয় মিউজিয়াম