Two Finger Test Explained: ধর্ষণের মামলায় নিষিদ্ধ নির্যাতিতার ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’, বিশেষজ্ঞরা যা বললেন…

Banning Of Controversial Two Finger Test: যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের ঘটনায় যে ধরনের আঘাত থাকে, তাতে মেমব্রেনের ক্ষতির চরিত্র অন্যরকম হয়। ফলে সেখানে 'টু ফিঙ্গার টেস্ট'-এর কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকে না

Two Finger Test Explained: ধর্ষণের মামলায় নিষিদ্ধ নির্যাতিতার 'টু ফিঙ্গার টেস্ট', বিশেষজ্ঞরা যা বললেন...
'টু ফিঙ্গার টেস্ট' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 03, 2022 | 4:46 PM

দীক্ষা ভুঁইয়া

২০১৩ সালেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিষিদ্ধ করেছিল ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ (Two Finger Test)। কিন্তু সর্বস্তরে সেই রায় না পৌঁছনোর জন্যই এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার মহিলাদের ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এর সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। সোমবার এই সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চ ধর্ষণ হয়েছে কি না, তার প্রমাণ পেতে নির্যাতিতার ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। শুধু তাই-ই নয়, কেউ এই পরীক্ষা করলে তাঁকেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক (Union Health & Family Welfare)-কে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, দেশের সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালকে বিষয়টি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যক্রম থেকেও সরাতে হবে এই বিষয়টি।

এই রায় প্রকাশ্যে আসতেই আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, ৯ বছর আগেই এই পরীক্ষাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে উল্লেখ করেছিল শীর্ষ আদালত। একই সঙ্গে এই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’কে মহিলাদের জন্য ‘অসম্মানজনক’ বলেও অভিহিত করা হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। ২০১২ সালে নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে গঠিত ভর্মা কমিটির তরফে জমা পড়া রিপোর্টেও জানানো হয়েছিল ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ আইনসম্মত নয়। যার ভিত্তিতে ২০১৩ সালেই The Criminal Laws (Amendment ) Act, 2013-তে এই পরীক্ষাকে ‘বেআইনি’ বলা হয়। এ প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় TV9 বাংলার তরফে। তাঁর কথায়, “২০১৩ সালে লিল্লু বনাম হরিয়ানা স্টেট মামলায় একই রায় দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। কিন্তু সেই রায়ের প্রচার কম ছিল। সেই রায় আইনজীবী এবং পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যেই সীমিত ছিল। চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা তা জানতেও পারেননি। ফলে সেই অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা রয়েই গিয়েছিল কিছু-কিছু জায়গায়।” তবে সোমবার শীর্ষ আদালতের রায় এবার বদল আনবে বলেও আশাবাদী দেবাশিসবাবু।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তথা শিশুদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী রবিকান্ত বলেছেন, “জেলাস্তরে রায় মেনে কাজ না হওয়াতেই এই পরীক্ষা হয়ে চলেছিল। প্রতিটি রাজ্যকে দেখতে হবে তার জেলাগুলিতে কড়াভাবে এই আইন প্রণয়ন হচ্ছে কি না। নাহলে মহিলাদের সম্মানহানি হতেই থাকবে।” কিন্তু আদৌও ধর্ষণ হয়েছে কি না, তা জানতে এই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে কি? রাজ্যের মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায় ধরা পড়েছে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের কথা। যে কথা উঠে এসেছে সোমবারের রায়েও। সুনন্দাদেবীর কথায়, “একজন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কি না, সেটা কোনওভাবেই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এ ধরা পড়ে না। তিনি যদি মা হন অথবা কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে থাকেন, সেখানে এই পরীক্ষা করে কোনও লাভ নেই। বরং সমাজ এখনও মনে করে যৌনজীবন পালন করলে তিনি ধর্ষণের শিকার হতে পারেন না। আর সেই বদ্ধমূল ধারণা থেকেই অনেক জায়গায় এই পরীক্ষা করা হয় এবং প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে ওই মহিলাই ভাল চরিত্রের অধিকারী নন।”

‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এ চিকিৎসক নির্যাতিতার গোপনাঙ্গে দু’টি আঙুল প্রবেশ করিয়ে সেখানকার মাংসপেশীর শৈথিল্য পরীক্ষা করতেন। নির্যাতিতার হাইমেন অক্ষত রয়েছে কি না, পরীক্ষা করা হত তা-ও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation)-র তরফেও জানানো হয় এই টেস্ট অবৈজ্ঞানিক। প্রসঙ্গত, যে মামলার তরফে সোমবার সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিয়েছে, সেটিও একটি ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা। এই মামলায় ঝাড়খণ্ডে ১৬ বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল অভিযুক্ত। ওই অভিযুক্তকে শুনানিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫-১৬ থেকে এই পরীক্ষা করা হয় না বলেই জানিয়েছেন এক পুলিশকর্তা। তিনি জানান, একাধিক পাচার হওয়া মেয়েকে তাঁরা উদ্ধার করছেন। এক সময়ে এই পরীক্ষা করা হলেও ২০১৫-১৬ সাল থেকে আর এই পরীক্ষা করানো হতই না। তবে নির্যাতিতাদের ন্যায় দিতে এবং তদন্তের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট করানো বাধ্যতামূলক। মহিলা পুলিশ ও নির্যাতিতা বা তাঁর বাড়ির অনুমতি নিয়ে মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট করানো হত এবং এখনও এ রাজ্যে সেটাই হয়।

কোনও মহিলা ধর্ষণের শিকার কি না, তা কীভাবে বোঝেন চিকিৎসকেরা? নাম প্রকাশ্য়ে অনিচ্ছুক এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক বলছেন, “যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের ঘটনায় যে ধরনের আঘাত থাকে, তাতে মেমব্রেনের ক্ষতির চরিত্র অন্যরকম হয়। ফলে সেখানে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এর কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকে না।” যদিও এখন শিশুদের ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞার বদল হয়েছে। যে কোনও ধরনের ‘পেনিট্রেশন’-কেই যৌন নির্যাতন বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে এই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এর কোনও বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হিমা কোহলি জানিয়েছেন, নির্যাতিতাকে এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ তাঁকে আবার মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হিমা কোহলি জানিয়েছেন, নির্যাতিতাকে এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ তাঁকে আবার মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া। দিনকয়েকের মধ্যেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিতে চলা বিচরপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, “যৌন জীবনে সক্রিয় একজন মহিলা ধর্ষণের অভিযোগ করলে তাঁর কথা বিশ্বাস করা যায় না, এই চিন্তাভাবনা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও লিঙ্গবৈষম্যেরই পরিচয়। নির্যাতিতার যৌন জীবনের ইতিহাসের সঙ্গে মামলার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা দুঃখজনক যে, আজও এমন পরীক্ষা করা হয়। নির্যাতিতাদের পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে এটি একটি ‘ইনভেসিভ মেথড’। জোর করে শরীরের ভিতরে আঙুল প্রবেশ করানো হয় এই পরীক্ষার সময়ে, যার ফলে নির্যাতিতা আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।”

২০২১ সালে এক মহিলা বায়ুসেনা অফিসারের ধর্ষণের মামলায় ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। ২৯ বছরের ওই নির্যাতিতার বক্তব্য ছিল, এই পরীক্ষা তাঁর কাছে যৌন নির্যাতনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিকেই মনে করিয়ে দেওয়ার সামিল।

প্রাক্তন পুলিশকর্তা তথা কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ এ প্রসঙ্গে TV9 বাংলাকে বলেছেন, “ইন্ডিয়াল পেনাল কোডে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা সেখানে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এর কথা বলা নেই। তবে মেডিক্যাল সায়েন্স-এ এই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-এর কথা রয়েছে। বিশেষ করে জে পি মোদীর A Textbook of Medical Jurisprudence and Toxicology, যে বইকে মেডিক্যাল সায়েন্সে বেদবাক্য মানা হত, তাতে এই পরীক্ষার উল্লেখ রয়েছে। এক সময়ে সেই বইয়ের বক্তব্যকে সামনে রেখে এই পরীক্ষা করা হত। তবে বর্তমানে ধর্ষণের আইনগত পদ্ধতি বদলে যাওয়ায় এই পরীক্ষা অপ্রয়োজনীয়।”