দীপেন্দু পালের রিপোর্ট
দেশের সবথেকে নিশ্ছিদ্র ‘নিউক্লিয়ার আন্ডার গ্রাউন্ড বেস’ তৈরির পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল ভারত। ভারতীয় নৌসেনার সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস প্রজেক্ট ‘আইএনএস বর্ষা’ তৈরি হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের কাছে রামবিলি গ্রামের কাছে। যেটি এক গোপন জায়গা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (PM MODI) নেতৃত্বে এমনই ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে ভারতীয় নিউক্লিয়ার সাবমেরিনগুলির জন্য, যা পারমাণবিক হামলাতেও অটুট থাকবে। চিন বা কোনও শত্রু দেশ যদি আচমকা পারমাণবিক হামলা করে বসে, তাহলেও যাতে এ দেশের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনগুলির কোনও ক্ষতি না হয় সেই লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ। শুধু তাই নয়, শত্রুপক্ষের উপর যাতে পাল্টা হামলা চালানো যায়, তার জন্য ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের তত্ত্বাবধানে বিশাখাপত্তনমকে হেডকোয়ার্টার করে তৈরি হচ্ছে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক নেভাল বেস আইএনএস বর্ষা বা INS Varsha।
কীভাবে এগোচ্ছে কাজ?
ইতিমধ্যেই জোরকদমে চলছে সেই কাজ। ২০ বর্গকিলোমিটারে এই অভেদ্য ঘাঁটিতে অনায়াসে ঢুকে যাবে ভারতের ১০টি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ররা রাতদিন এক করে পরিশ্রম করছেন যাতে ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ করা যায়। আক্ষরিক অর্থেই পাহাড় কেটে টানেল তৈরি করা হচ্ছে। গোটা প্রকল্পটিই খুব গোপন রাখা হয়েছে যার ফলে এর খরচ এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট না হলেও আনুমানিক ৩.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩২৮ কোটি টাকার কাছাকাছি। ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টার বা BARC-এর কাছে কাছাকাছি এই নৌঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে যাতে আপৎকালীন পরিস্থিতে দ্রুত পাল্টা হামলা চালানো যায়। কারণ, ভারত সবসময়ই ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ বা ‘প্রথমে হামলা নয়’ নীতি মেনে চলে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে পাওয়া ছবি
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে পাওয়া ছবি
হলিউডি সিনেমার সেটের চেয়েও বেশি চোখ ধাঁধানো এই নৌ-ঘাঁটি। রামবিলি গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছে এর প্রাকৃতিক গঠনের জন্য। বিশালাকৃতির পাহাড়ের নিচে তৈরি হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ‘বেস’ যেখানে এক একটি সাবমেরিন অনায়াসে ঢুকতে ও বেরোতে পারবে। কোনও শত্রুদেশের স্যাটেলাইট আকাশ থেকে এর ছবি তুলতে পারবে না। আশেপাশে কারও ঘেঁষা একেবারেই নিষিদ্ধ। ভারতের সবকটি পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজ এখান থেকেই অপারেট করতে পারবে। আর শুধু হামলা কেন, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের কোনও জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এখানেই তাকে সারানো যাবে। চালকরা বিশ্রাম নিতে পারবেন। এস-২ থেকে শুরু করে আসন্ন এস-৫– সব ক্লাসের সাবমেরিনই এখানে সাময়িক বিশ্রাম নিতে পারবে। এমনিতেই বিশাখাপত্তম ভারতীয় নৌসেনার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থাকায় এখানে কমবেশি ৫০টি যুদ্ধজাহাজ অপারেট করে।
নিউক্লিয়ার সাবমেরিন কী?
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে,কাকে বলে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন? কী এই নিউক্লিয়ার সাবমেরিন? কেন একে দিয়েই কোনও দেশের যুদ্ধ করার ক্ষমতাকে মাপা হয়? যে ডুবো-যুদ্ধজাহাজগুলি মূলত পারমাণবিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত, তাদেরই বলে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। নিউক্লিয়ার সাবমেরিন মানেই যে নিউক্লিয়ার হামলার ক্ষমতা থাকবে এমনটা নাও হতে পারে। প্রথাগত ডিজেল ইঞ্জিনের চেয়ে নিউক্লিয়ার চুল্লি-নির্ভর যুদ্ধজাহাজ ঢের বেশি শক্তিশালী হয়। এই ধরণের আধুনিক সাবমেরিন জলের তলা থেকেও শত্রু দেশের বিরুদ্ধে পরমাণু মিসাইল হামলা চালাতে পারে। যুদ্ধবিমান বহন করতে পারে। সেগুলি এই জাহাজ থেকেই উড়ে যেতে ও নেমে আসতে পারে। পরমাণু হামলাকে প্রতিহত করে পাল্টা হামলা চালাতে সক্ষম। ভারতের কাছে এই মুহূর্তে চারটি নিউক্লিয়ার ক্লাস সাবমেরিন রয়েছে। ২০২০-তেই ভারতীয় নৌসেনার কাছে আইএনএস অরিহন্ত (এস-২), আইএনএস অরিঘাত (এস-৩) ও আইএনএস অরিধমান (এস-৪) এসে গিয়েছিল। সম্প্রতি ভারতীয় নৌসেনা হাতে পেয়েছে আরও এক সর্বাধুনিক ‘এস-৪’। সবকটিই পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে ও হামলা চালাতে সক্ষম। আসছে এস-৫-ও। জলের নিচে থাকায় এগুলিকে শত্রুপক্ষ সহজে খুঁজে পায় না।
বহুদিন ধরেই বঙ্গোপসাগরের ৮,৩৯,০০০ বর্গমাইলের বেশিরভাগ অংশেই দাদাগিরি চালিয়ে আসছে চিন। বাণিজ্য থেকে শুরু করে সামরিক আগ্রাসন– কোনও কিছুতেই পিছপা নয় বেজিং। চিনা আগ্রাসনকে মুখের মতো জবাব দেবে আইএনএস বর্ষা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে লালফৌজের একচেটিয়া আধিপত্য রুখতে ভারতও নিজের সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কোয়াড জোটকে আরও শক্তিশালী করতে চায় নয়াদিল্লি। আইএনএস বর্ষা ভারতের নৌসেনার শক্তিকে নিরাপদে এক ছাতার নিচে সুরক্ষিত রাখবে বলেই মত নিরাপত্তা বিষেশজ্ঞদের।