BNS: পুলিশ তদন্তের স্বার্থে ব্যবহার করলে তবেই সার্থক হবে ৯০ দিনের হেফাজত

Police Custody: পুরনো আইনের বেশ কিছু ধারা যেমন নতুন আইনে অবলুপ্ত হয়েছে, তেমনই সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা বেশ কিছু নতুন ধরনের অপরাধের জন্য নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ সবই নতুন তিন আইনের ইতিবাচক দিক। অপরাধ দমনে আইনের আগল আঁটোসাটো করার পদক্ষেপ। কিন্তু নতুন আইন নিয়ে কিছু নেতিবাচক দিকও উঠে আসছে।

BNS: পুলিশ তদন্তের স্বার্থে ব্যবহার করলে তবেই সার্থক হবে ৯০ দিনের হেফাজত
১ জুলাই থেকে লাগু হওয়া নতুন আইনে পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ বৃদ্ধির পরিসর তৈরি করা হয়েছে। Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Aug 04, 2024 | 5:09 PM

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে আমূল বদল আনা হয়েছে দেশের আইনি ব্যবস্থায়। দীর্ঘ দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে চালু থাকা ভারতীয় দণ্ডবিধি বা Indian Penal Code বদলে হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। এর পাশাপাশি ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট হয়েছে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (BSA) আর ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর কোড বদলে হয়েছে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (BNSS)। ব্রিটিশ আমলে লাগু হওয়া আইনে ঔপনিবেশিকতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, ব্রিটিশদের লাগু করা আইনে বেশ কিছু সংশোধন বা অ্যামেন্ডমেন্টও করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের ছায়া থেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে এবং দেশের আইনি ব্যবস্থাকে যুগপোযোগী করে তোলার লক্ষ্যেই এই বদল বলে দাবি এনডিএ সরকারের। নতুন আইনে বর্তমান যুগে সংগঠিত হওয়া বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন এই আইন পুলিশের হাতে অনেক ক্ষমতা তুলে দিয়েছে বলে অভিযোগ আইনজীবীদের একাংশের। পুলিশের ভূমিকা আইনের প্রয়োগকারী হিসাবে। নতুন আইন এসে অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অতিরিক্ত সুবিধা হবে পুলিশের? এ নিয়ে প্রাক্তন পুলিশকর্তারা কী ভাবছেন? আইনজীবী বা বিচারকদের মতামত কী? তা নিয়েই টিভি৯ বাংলার এই বিশেষ প্রতিবেদন।

নতুন আইনে মহিলা এবং শিশুদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আরও কড়া হয়েছে। এমনকি সংগঠিত অপরাধ রুখতে আইনের কিছু ধারা আরও জোরদার করা হয়েছে। পুরনো আইনের বেশ কিছু ধারা যেমন নতুন আইনে অবলুপ্ত হয়েছে, তেমনই সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা বেশ কিছু নতুন ধরনের অপরাধের জন্য নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ সবই নতুন তিন আইনের ইতিবাচক দিক। অপরাধ দমনে আইনের আগল আঁটোসাটো করার পদক্ষেপ। কিন্তু নতুন আইন নিয়ে কিছু নেতিবাচক দিকও উঠে আসছে। বিএনএস এবং বিএনএসএস-এর কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি উঠেছে কোনও কোনও মহলে। যার মধ্যে অন্যতম পুলিশের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া। এই ক্ষমতার অপব্যবহার হলে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন হওয়ার আশঙ্কা করছেন আইনি বিশেষজ্ঞরা।

পুরনো আইনে কোনও অপরাধ ঘটনায় অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পর ১৫ দিন পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখতে পারত পুলিশ। অভিযুক্তকে জেরা এবং তদন্তের প্রয়োজনেই দেওয়া হয় পুলিশি হেফাজত। কিন্তু ১ জুলাই থেকে লাগু হওয়া নতুন আইনে পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ বৃদ্ধির পরিসর তৈরি করা হয়েছে। নয়া আইনে পুলিশ অভিযুক্তকে ৯০ দিন পর্যন্ত হেফাজতে রাখতে পারে। এর জেরে হেফাজতে পুলিশি অত্যাচার বাড়ার আশঙ্কা করছেন আইনজ্ঞরা। কেন পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ ৬ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হল তার ব্যাখ্যা মেলেনি নতুন আইনে। ভারতে পুলিশি হেফাজতে বন্দি মৃত্যুর ঘটনা নেহাতই কম ঘটে না। পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ বৃদ্ধি হলে এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা।

পুরনো আইন অনুযায়ী, পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে আদালতে হাজির করাতে হত। নতুন আইন অনুযায়ী তা আর বাধ্যতামূলক নয়। এর জেরে কোনও ব্যক্তিকে আদালতে না পেশ করে পুলিশ আটকে রাখলে, বিষয়টি নিয়ে চিন্তার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে। এর পাশাপাশি গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়েও নিয়মে বদল হয়েছে নতুন আইনে। পুরনো আইন অনুযায়ী হেফাজতে থাকা অভিযুক্তের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হত ৪৮ ঘণ্টা অন্তর। তা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু নতুন আইনে স্বাস্থ্যপরীক্ষা কত সময় অন্তর করা হবে তা নিয়ে কোনও বাধ্যতামূলক নির্দেশ নেই। বরং তা চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে তৈরি হওয়া এ রকমই বেশ কিছু পরিসর নিয়ে অপব্যবহারের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অর্ক নাগও এই আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, “এই আইনে পুলিশের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার হলে ভবিষ্যতে অনেক নাগরিককে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।”

যদিও রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, এই আইন কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশের কাজ সহজ করে দেবে। বিশেষ করে দাগী আসামীদের জেরা এবং অপরাধের তদন্তের বিষয়ে তদন্তকারীরা বেশ কিছু সুবিধা পাবেন বলে মনে করছেন তিনি। এ বিষয়ে ওই পুলিশকর্তা বলেছেন, “আগে লকআপে মারধরের ব্যাপার ছিল। অনেক দিনই তা নেই। এখন পুলিশ জেরা করে। দাগী আসামীরা অপরাধ করে ধরা পড়ার পর এই সুযোগ নিত। তাঁরা ভাবত, পুলিশি হেফাজতে দিন ১৪ কোনও মতে কাটিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। ৯০ দিন পুলিশি হেফাজতে এই মনোভাব আটকে যাবে।” হেফাজতে বেশি পেলে পুলিশের কী সুবিধা হবে, সে ব্যাপারে তিনি বলেছেন, “পুলিশ হেফাজত হলে তাতে পুলিশের সুবিধা হয়। পুলিশ কাজ করতে পারবে। তদন্তে এবং তথ্য জোগাড়ে সুবিধা হবে।” এই কথা বলার পাশাপাশি ক্ষমতা অপব্যবহার না করার পরামর্শও শোনা গিয়েছে প্রাক্তন পুলিশকর্তার কথায়। তিনি বলেছেন, “এই ৯০ দিনের হেপাজত যাতে তদন্তের কাজেই ব্যবহার হয়, তাও পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে।” নতুন আইনে ইলেক্ট্রনিক্স এভিডেন্সকে গুরুত্ব দেওয়াকেও সদর্থক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে বা রাষ্ট্র দমনের নামে তার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদী বা সমালোচক বা আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করার ঘটনা নতুন নয়। গত এক দশকে এ রকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আইনি ব্যবস্থায় শেষ কথা পুলিশ বলে না। পুলিশ অসৎ উদ্দেশ্যে চালিত হলে আদালতের দায়িত্ব তার নজরদারি করার। তাই পুলিশের হাতে বেশি ক্ষমতা গেলেও, পুলিশ যদি তা ঠিক কাজে ব্যবহার না করে, তাহলে সাংবিধানিক আদালত তা পরিমার্জন করবে বলে আশা আইনজীবী-বিচারকদের। এ নিয়ে তাঁদের বক্তব্য, “যদি কোনও ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে, অগণতান্ত্রিকভাবে আটকে রাখা হয়, তাকে আটকানোর যথেষ্ট পরিসর আমাদের আইনে এখনও আছে। এখনও আমাদের সংবিধান অনেক শক্ত। মাথার উপর সাংবিধানিক আদালতও রয়েছে।” প্রাক্তন পুলিশকর্তাও মনে করেন, হাতে পাওয়া অতিরিক্ত ক্ষমতা অপরাধ আটকাতেই ব্যবহার করা উচিত। তাই পুলিশের প্রতি তাঁর বার্তা, “পুলিশ যেন ক্ষমতাকে অত্যাচারের জন্য ব্যয় না করে, হেফাজতের এই সময়কাল যেন তদন্তের জন্যই ব্যবহার হয়। এবং অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করা হয়।”