কলকাতা: ৫০ দিনের রাজ্যজোড়া ইনসাফ যাত্রার পর ব্রিগেড। ২০০৮ সালের পর ২০২৪। ১৬ বছর পর ফের ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ হতে চলেছে কলকাতায়। ফের বাম যুব ফ্রন্টের হাত ধরেই উড়তে চলেছে লাল পতাকা। লোকসভা ভোটের আগে বঙ্গ বামের এই কর্মসূচি নিয়েই জোর চর্চা রাজনীতির অন্দরে। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে ‘ক্যাপ্টেন’ করেই রাজ্য ইনসাফের দাবিতে ঘুরেছে বাম শিবিরের তরুণ তুর্কিরা। সেই মীনাক্ষীই এদিনও ব্রিগেডের ‘ক্যাপ্টেন’। ক্যাপ্টেনকে মুখ করেই পোস্টারে, কাউআউটে ছেয়ে ফেলা হয়েছে বাংলা। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পড়েছে পোস্টার। রবিবার শহরের ৭ জায়গা থেকে আসছে মিছিল। মিছিল আসছে জেলা থেকেও। হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশনেও সকালেই বাড়তে শুরু করেছে ভিড়। ব্রিগেডে ৩২ ফুট/ ২৪ ফুটের একটি মূল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে থাকবেন প্রধান অতিথিরা। এছাড়াও মঞ্চের ডান দিকে এবং বাঁদিকে ৪০ ফুট/৪০ ফুটের দু’টো আলাদা মঞ্চ থাকছে।
এ দিন ব্রিগেড শেষ হয় বিকেল চারটে নাগাদ। শেষে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় সংবিধান পাঠ করান। পাশাপাশি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্রিগেড নিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।
‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাউকে দেখবেন না। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও ফোন করেছিলেন। উনি ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’
‘সব মানুষকে আমাদের দরকার। তৃণমূলের কর্মীদের বলছি। ওরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের তুলবে। কিন্তু তোলেনি। একটার পর একটা আইএএস আইপিএস-এর অবসর নেওয়ার পর পুষছে।’
‘এখানেই অনেকে বলবেন এত লোক হল ভোটটা কোথায়? আপনারা জানেন না পঞ্চায়েত নির্বাচন কীভাবে হয়েছে। প্রথমে বলল চোর ধরো জেলে ভরো। চোর ধরল না। চোর পাহাড়া দিল। আমরা বললাম গ্রাম জাগো। গ্রাম জাগল। চোর ধরল।’
‘এক সময় মোবাইল ছিল না। মানুষ তারা দেখে পথে ঠিক করত। এখনও মানুষ এই তারা দেখেই নিজেদের পথ বেছে নিচ্ছেন। বাংলায় যে ভূত গ্রাস করছে সেই ভূত তাড়াতে হবে। বামপন্থা ফাঁকা আওয়াজ দেয় না। নীল সাদা রং করে ওরা আমাদের স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর এখন সব চুরি করেছে।’
‘রাজ্যের মানুষ রেগে যাচ্ছে এই চুরি দেখে। রেশন, আইসিডিএস, চাকরির টাকা সব চুরি করছে। যারা মনে করেছিল নবান্নের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ৫৬ লাগাবে। বামপন্থীরা বলেন ৫৬ নয় জনগণ পারেন এই সিস্টেম বদলাতে।’
‘কুকুর মোটা হলে বাঘ হয় না। সংসদে কারা যাবে? বামপন্থীরা যাবে। তাই কবি নজরুলের কথায়, ‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত, যেদিন…’
‘কে বিজেপি? নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো সব তৃণমূলের নেতাগুলো ভাগাড়ে বিজেপির দিকে গিয়েছে। কী করবে এরা? দেশ বেচে দিচ্ছে। সব ধ্বংস করছে।’
অসংখ্য আইনজীবীরা রয়েছেন। যাঁরা বামপন্থীদের পাশে রয়েছেন। এই লড়াইয়ের মাটি থেকে এই ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দেব না। আমরা বলেছি নতুন করে কারখানা তৈরির কথা। চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার কথা। হবু শিক্ষিকারা সরকারের অপদার্থতার জন্য চুল বিসর্জন দিল। ওরা যদি না পড়ায় আগামী প্রজন্ম কার কাছে পড়তে যাবে? সেভেন পাশ কথা সেই সব শিক্ষকদের কাছে পড়বে যারা বাবার কিডনি বিক্রি করে চাকরি পেয়েছে? তৃণমূলের পকেটে লক্ষ-লক্ষ টাকা দিয়েছে তারা শিক্ষিকা। আমরা লড়াই করছি ফিরে আসার জন্য।
‘আমাদের আসল কাজ হল গোটা সিস্টেম বদল করা। অনেক ছোট থেকে এসেছি বাবার হাত ধরে। ওই কোনে বসতাম। রাজনীতি করতে গেলে চুরি করতে হবে কেউ শেখায়নি।’
‘কোন গর্ধবরা বলে বামপন্থীরা শূন্য? আসলে শূন্যের মূল্য ওরা জানে না। ওরা বামপন্থীদের শক্তিকে ভয় পায়। আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই। আমাদের কোনও রাগ নেই। তবে আশঙ্কা রয়েছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ রুটি-রুজির কথা বলে কি না। দাঙ্গাবাজ-চোরেদের প্রচারক হয়ে যায় তখন লড়াইয়ের মাঠে বাধা আসে। সেটা অতিক্রম করা বামপন্থীরা তুড়ি মারতে জানেন। পঞ্চাশ দিন কারোর কাছে মুখ দেখাইনি।’
“বামপন্থীরা একটা পাড়ায় রাজনীতি করতে গুঁতোগুঁতি করে না। বামপন্থীদের লড়াই একটা গলির জন্য নয়। একটা বিধায়ক, একটা সাংসদ পদের জন্য লড়াই করে না। যতদিন এদেশের মাটিতে অপশাসন লুট, অত্যাচার চলবে বামপন্থীরা লড়ে যাবে। ‘চারানার কিছু ফুটো মস্তান গলিতে গুতোগুতি করছে। ভাবছে এটাই দুনিয়া। আমরা জানি নিজের গলিতে একটা কুকুরও বাঘ। ময়দানে আসুন দেখা যাবে।’
“
‘২ হাজার ৯১০ কিমি হেঁটেছেন বামপন্থীরা। পায়ে হাঁটা আমাদের কাছে নতুন নয়। নেতৃত্বদের শেখানো রাস্তায় আমরা হাঁটি। ইনসাফের লড়াই ধারাবাহিক-দীর্ঘ। তাই আমরা বলেছিলাম বড় মাঠে লড়াই হবে। এই মাঠে লড়াইয়ের শর্ত ভাষা হবে না, এই মাঠে লড়াইয়ের শর্ত বর্ণ হবে না। এই মাঠে ইন্ডিয়া-ভারত নাম নিয়ে তর্ক হবে না, জাত-পাত নিয়ে কথা হবে। লড়াইয়ের শর্ত হবে রুটি-রুজি। কাজ। আর তাই নকল যুদ্ধ ছাড়ো। আসল যুদ্ধ করো।’
“বামপন্থীরা একটা পাড়ায় রাজনীতি করতে গুঁতোগুঁতি করে না। বামপন্থীদের লড়াই একটা গলির জন্য নয়। একটা বিধায়ক, একটা সাংসদ পদের জন্য লড়াই করে না। যতদিন এদেশের মাটিতে অপশাসন লুট, অত্যাচার চলবে বামপন্থীরা লড়ে যাবে।”
মঞ্চে উঠলেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। বলেন, “লাল সেলাম। লড়তে এসেছি। ওরা রাজনীতিকে নিয়ে খেলা হবে। সেই মাঠের দখল নিয়েছি। কারোর বাবার ক্ষমতা নেই মাঠের দখল আমাদের থেকে কেড়ে নেবে কারোর বাবার ক্ষমতা নেই মাঠের দখল আমাদের থেকে কেড়ে নেবে। বামপন্থীরা রক্তবীজের জাত। বামপন্থীরা রক্তবীজের জাত, লড়ে যাবে-লড়ে যাবে।”
সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরী বলেন, “ইনসাফ চাই। ওরা যত হেঁটেছে মানুষের সমর্থন বেড়েছে। আনিস খানের বাবা মনে করেছেন ইনসাফ চাই। বিজেপি দিয়ে তৃণমূল যাবে না। তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপিকে হারানো যাবে না। বিজেপি-তৃণমূল চোরে চোরে মাস্তুত ভাই”
সৃজন ভট্টাচার্য: চার লক্ষ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমে গিয়েছে। কলেজে হাজার হাজার সিট ফাঁকা। আমাদের রাজ্যের ছেলেগুলো মাঝপথে পড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে কাজ করতে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি, রাজ্য শিক্ষা নীতি পড়ুয়াদের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা ছাত্রদের বলেছি, বিভেদ রুখে স্বদেশ গড়ো। আমরা রবি ঠাকুরে মাটি থেকে গোটা দেশবাসীর কাছে বার্তা দিতে চাই- পদ্মপাতার উপরে ফুল দেখতে ভাল লাগে, কিন্তু নীচে সাপ লুকিয়ে থাকে।
ডিওয়াইএফআই-এৎ ব্রিগেড সমাবেশে বক্তৃতা করতে উঠে এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বলেন,
“২০২৩ সালে যাঁরা আপনাদের মুখের ভাত কেড়ে নিল, ২০২৪ সালে আমরা তাঁদের কিস্তিমাত করে দেব। ইনসাফ যাত্রার শেষে যখন ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছিলাম, কেউ কেউ বলেছিলেন, তৃণমূলের কাছে গুণ্ডা, পুলিশ, সাংসদ , বিধায়ক, সরকার আছে। তোমাদের তো নেই। এই শুনে আমি হাসিমুখে বলেছিলাম, আমাদের কাছে এই ঝান্ডা আছে। আর কিছু দরকার নেই। যাঁরা আগে বলেছিলেন, ছোটরা পারবে তো? তাঁরা এখন উল্টো সুর গাইছেন। আমরা ইনসাফ চাইছি। আমরা সুবিচার চাইছি। আমাদের রাজ্যে স্কুল-কলেজে লাগামছাড়া ফি বাড়ছে। বেসরকারিকরণ হচ্ছে একের পর এক। মিড ডে মিলে চুরি হচ্ছে। আমাদের শিক্ষকরা ধর্মতলায় বসে। স্কুলগুলো ফাঁকা।”
কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “বামপন্থীরাই চাইবে বিকল্প আনতে। ব্রিগেড মানুষকে ভরসা জোগাবে। মানুষের আস্থা অর্জনের এই ব্রিগেড।”
সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “ওরা চায় হয় গীতাপাঠ বা চণ্ডীপাঠে দেশকে ঢেকে রাখতে। বামেরা চায়, মানুষ যা চায়। জীবন, জীবিকার ভবিষ্যত নিয়ে বলতে।”
ডিওয়াইএফআই-এৎ ব্রিগেডে হাজির বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও হাজির হয়েছেন ব্রিগেডে।
ডিওয়াইএফআই-এর ব্রিগেড সমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে হাজির হয়েছেন সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষ। বিরোধীরা খোঁচা দিচ্ছে ব্রিগেড ভরলেও, ভোটের ঝুলি ভরে না সিপিএমের। এ প্রসঙ্গে সুশান্ত ঘোষ বলেছেন, “যাঁরা বলছেন, তাঁরা বলবেন। ব্যক্তি নয়, আদর্শ হচ্ছে আমাদের চালিকাশক্তি। সে জন্য শূন্য বা মহাশূন্য যাই হোক, আদর্শ থেকেই মানুষ ভিড় জমান। আমাদের আদর্শের ভিত্তিতেই এই ব্রিগেড।”
বাইকে চড়ে ব্রিগেডে আসছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য দফতর থেকে বাইকে চেপে ব্রিগেডে আসছেন তিনি।
ব্রিগেডে এসে ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্ত টিভি৯ বাংলাকে রবিরারে ব্রিগেডের বিষয়ে বলেছেন, “শুভেন্দু অধিকারীর বাড়িতে শিশির অধিকারী আছেন। তিনি কোন দলে বোঝা যায় না। অন্যদিকে আমাদের ইনসাফ যাত্রায় হেঁটেছেন সাল্কি সোরেনের মা চিন্তামণি সোরেন। সেই ২০০৮-০৯ এর শহিদের মা, এখনও ২৩ সালে দাঁড়িয়ে লড়াইটা করে যাচ্ছেন। ওই নীতিহীনতার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য ব্রিগেড।”
ঘন কুয়াশাকে উপেক্ষা করে নদীপথে ব্রিগেডের উদ্দেশ্যে রওনা সিপিএম নেতাকর্মী সমর্থকদের। সাতসকালে বসিরহাটের হিঙ্গলগঞ্জ স্বরূপনগর বাদুড়িয়া ব্লকের বেশ কয়েকটি ব্লক থেকে সিপিএম নেতাকর্মী সমর্থকরা ব্রিগেডের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
মেয়ের বক্তব্য শুনতে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে ট্রেনে রওনা হলেন মিনাক্ষীর মা-বাবা। সীতারামপুর স্টেশন থেকে কোলফিল্ড ট্রেনে উঠলেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের মা সিপিএম মহিলা জেলা নেত্রী পারুল মুখোপাধ্যায় এবং তার বাবা জেলা কমিটির সদস্য মনোজ মুখোপাধ্যায়
ঠান্ডা উপেক্ষা করেই ভিড় হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশনে। জেলা থেকে ধীরে ধীরে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। উঠছে স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সমাতন্ত্রের স্লোগান। সাতটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে আসেন মালদহের প্রচুর বাম সমর্থক।
সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন ডিওয়াইএফআইয়ের কর্মী সমর্থেরা। সকলের মুখেচোখেই উন্মাদনার ছাপ স্পষ্ট। কারও গলায় ঝুলছে জ্যোতি বসুর ছবি, কারও হাতে আবার মীনাক্ষীর কাটআউট।