Karar Oi Louho Kopat: রহমান ভিন্ন সুরে গাইছেন বলে এত অসহিষ্ণুতার কোনও যৌক্তিকতা দেখছি না: রাজু আলাউদ্দিন
Kazi Najrul Islam: গানের সুর নিয়ে নতুন করে কাটাছেঁড়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় নেটদুনিয়ায় তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবে ভিন্ন সুরও রয়েছে, যাঁরা নতুন এই প্রচেষ্টা নিয়ে সমালোচনার পক্ষপাতী নন। তাঁদের মধ্যেই একজন হলেন বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন। গোটা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন তিনি?
শুক্রবারই ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে ‘পিপ্পা’ সিনেমা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্লটে নির্মিত এই সিনেমার একটি গান ঘিরে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটির রিমেক করা হয়েছে। সুর বদল করা হয়েছে। এই গানটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। এই নজরুলগীতি নিয়ে বাঙালির মনে আলাদা ভাবাবেগ রয়েছে। গানের সুর নিয়ে নতুন করে কাটাছেঁড়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় নেটদুনিয়ায় তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবে ভিন্ন সুরও রয়েছে, যাঁরা নতুন এই প্রচেষ্টা নিয়ে সমালোচনার পক্ষপাতী নন। তাঁদের মধ্যেই একজন হলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন। গোটা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন তিনি?
রাজু আলাউদ্দিনের বয়ানে:
এটা ঠিক যে বাঙালি হিসেবে এবং এই গানের/কবিতার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ জড়িয়ে আছে বলে আমাদের কাছে এর ভিন্ন একটা তাৎপর্য আছে। মূল সুরের সঙ্গে আমাদের একটা বন্ধন তৈরি হয়ে আছে। আমরা এর বাইরে অন্য সুরে গাইবার কথা চিন্তাও করতে পারি না। কিন্তু অন্য ভাষী একজন সুরকার সেই একই গানে ভিন্ন সুর আরোপ করে গাইছেন বলে এত অসহিষ্ণু মনোভাবেরও কোনও যৌক্তিক কারণ আমি দেখি না। সংস্কৃতির কোনও কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব বা তাঁর কোনও শিল্পকর্ম আখেরে ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়। আর সেই ঐতিহ্যে অধিকার তৈরি হয় পৃথিবীর যে-কারোর।
একই ভাবে যখন কোনও শিল্প জনপ্রিয় হয়ে বৃহত্তর জনমানসে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেকের অধিকার থাকে সেটাকে নিজের মতো করে গাইবার। আপনি তাঁর সুর পছন্দ করুন বা না-ই করুন। তাছাড়া, নজরুল নিজেও তো সুরের ব্যাপারে এতটা রক্ষণশীল ছিলেন না। তাহলে এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? এ আর রহমান নিজের মতো করে এই গানটিকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন– আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। আমার ভাল না লাগলে, শুনব না। তাই বলে এত নিন্দামন্দ করার কী আছে, বলুন?
রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার গানের সুরে নিজের কথা চাপিয়ে দিয়ে একটি অসাধারণ গান রচনা করেছেন। পশ্চিমের বহু সুর তিনি নিজের মতো করে খানিকটা বদলে নিয়েছেন তাঁর গানে। কই ওসব নিয়ে তো এত তীব্র প্রতিবাদের কোনও ঝড় বইতে দেখছি না। শেক্সপিয়র বহু ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে নাটক লিখেছেন, সেগুলো হুবহু সেই ঐতিহাসিক ঘটনার অনুসরণ ছিল না, থাকা সম্ভবও নয়। কারণ সৃষ্টিশীল মনের স্পর্শে তা নতুন কিছু হয়ে ওঠে। রামায়ণ বা মহাভারত যখন অন্য ভাষায় অন্য কারও হাতে অনুদিত হয়েছে, কিংবা ধরুন জায়সীর পদুমাবত যখন আলাওল-এর হাতে গিয়ে পদ্মাবতী হিসেবে অনুদিত হয়েছে, তখন তা নতুন রূপ ধারণ করেছে।
আমরা তো এ নিয়ে কোনও আপত্তি তুলছি না। তাহলে নজরুলের মতো এক কিংবদন্তির একটি জনপ্রিয় গান ভিন্ন সুরে গাইলে তাতে আপত্তি তোলা কি নিজেরই সঙ্গেই এক ধরনের স্ববিরোধিতা নয়? এটা ঠিক যে আমার অভ্যস্ত কানে এ আর রহমানের সুরটা বেখাপ্পা লাগছে, কিন্তু তাঁর নিজের কাছে তা মনে হয়নি। আমাদের সবার মনের গড়ন এক নয়। ভিন্নতাকে মেনে না নেওয়ার মধ্যে এক ধরনের সংকীর্ণতা আর রক্ষণশীলতার পরিচয় আছে। আমি বরং এ আর রহমানকে অভিনন্দন জানাব, এই সাম্প্রদায়িক ঘোর উত্থানের সময় নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক ও লড়াকু এক লেখককে তিনি এই গানের মাধ্যমে স্মরণ করেছেন বলে। এই গানটির মধ্যে প্রথা ভাঙার কথা আছে, এ আর রহমান নিজেও বিদ্যমান সুরের প্রথা ভেঙে নজরুলের মর্মকথাকেই সম্মান জানিয়েছেন। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।