কলকাতা: সেটা ছিল ১৯৬৮-র জুন মাস। যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিআইএম। ত্যাগরাজ হলে সম্মেলন হবে। রাজনৈতিক প্রতিবেদন তৈরি করছেন দীনেশ মজুমদার। কিন্তু যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক কে হবে? দীনেশ মজুমদারকে পার্টির কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে নারাজ প্রমোদ দাশগুপ্ত। ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর নেতৃত্বে থাকবেন বিমান বসু। রাজ্যে এই সংগঠনের দায়িত্ব সামলাবেন শ্যামল চক্রবর্তী ও সুভাষ চক্রবর্তী। ষাটের দশকে এই চার নেতাই ছিলেন ছাত্র-যুব সংগঠনের মুখ। এই অবস্থায় ডিওয়াইএফআই-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের এক প্রাক্তনীকে। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সম্মেলন উপলক্ষে শহিদ মিনারে প্রকাশ্য সমাবেশ হয়েছিল। সেই সভাতেই রাজনীতির বড় মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
এর দুই বছর আগেই, অর্থাৎ, ১৯৬৬ সালেই সিপিএমে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। দলের কাজের পাশাপাশি এসেছিল যুব সংগঠনের দায়িত্ব। এরপর, ১৯৭১-এ সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য হন তিনি। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই তরুণ নেতাকে উত্তর কলকাতার কাশিপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিল পার্টি। প্রথমবারেরই বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত ওই বছরই জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিল সিপিআইএম। গত শতাব্দীর আট এবং নয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত পার্টিতে দাপট ছিল বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস এবং শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তীদেরই। বুদ্ধ অনেকটাই ছিলেন পিছনের সারিতে। তবে, সাতাত্তরে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভাতেই তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।
তবে, ১৯৮২ সালের নির্বাচনে, কাশিপুর আসনে কংগ্রেসের প্রফুল্লকান্তি ঘোষের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলন বুদ্ধদেব। পাঁচ বছর পরই অবশ্য মন্ত্রিসভায় ফিরেছিলেন। এবার তাঁকে বিধানসভায় পাঠিয়েছিল যাদবপুর। এরপর থেকে পাকাপাকিভাবে যাদবপুরই তাঁর একচেটিয়া বিধানসভা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখার ভক্ত, সিনেমা-নাটক নিয়ে নিয়মিত চর্চা করা বুদ্ধর হাতেই এই দফতরের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন জ্য়োতি বসু। ১৯৯৬-এ কাঁধে চাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গুরু দায়িত্বও। ১৯৯৯ সালে জ্য়োতি বসুর স্বাস্থ্য দ্রুত ভাঙছিল। বুদ্ধ ভট্টাচার্যকে উপ-মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর ২০০০ সালে জ্যোতি বসু দায়িত্ব ছাড়ার পর, তিনিই হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০০১ এবং ২০০৬ সালে দলকে বড় জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০১-এ রাজ্যের ২৯৪ আসনের মধ্যে বামেরা জিতেছিল ১৯৯ আসনে। ২০০৬ সালে ফল আরও ভাল হয়েছিল। বামেরা পেয়েছিল ২৩৫ আসন।
প্রশাসনের পাশাপাশি দলেও ঘটছিল তাঁর উত্থান। ১৯৮৪ সালে তাঁকে সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়। পরের বছরই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। ২০০২ সালে সিপিআইএম-এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণকারী কমিটি, পলিট ব্যুরোর সদস্যপদ পেয়েছিলেন তিনি। রাজ্যে সিপিআইএম সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, অসুস্থতার কারণে দলীয় দায়িত্ব থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে, তাঁকে দল এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত যে, ২০১২ সালে কোঝিকোড়ে ২০তম পার্টি কংগ্রেসেও তাঁকে পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে রেখে দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ২০১৫ সালের বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেসে তাঁকে পলিট ব্যুরো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এরপরও দল তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে রেখে দিয়েছিল।
তবে, বরাবরের বিপ্লবী মনোভাবে বুদ্ধ ভট্টাচার্যর সঙ্গে দলের সম্পর্ক বরাবর খুব মসৃণ ছিল না। ১৯৯৩ সালে তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক এবং নগরোন্নয়ন ও পুর বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালীন আচমকা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। প্রশাসনের কার্যকারিতা এবং দুর্নীতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছিল তাঁর। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে তিনি বলেছিলেন, ‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না’। তবে, কয়েক মাস পরই তিনি ফের মন্ত্রিসভায় ফিরে এসেছিলেন। আসলে বরাবরই তিনি বড়্ড বেশি আবেগপ্রবণ। একই ধরনের আবেগ ছিল তাঁর বাংলা রাজ্যকে নিয়ে। বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। দুরদর্শী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষিত যুবদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে রাজ্যে শিল্প আনতেই হবে। এর জন্য দলের বিরুদ্ধে মন্তব্য করতেও পিছপা হননি তিনি।
‘চলবে না, চলছে না’ সংস্কৃতি বদলে রাজ্য়ের ভাবমূর্তির পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই পর্যায়ে এক শিল্প সম্মেলনে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি দুর্ভাগ্যবশতঃ এমন এক দলের সদস্য, যারা বন্ধ ডাকে’। ২০০৬ সালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদে, পুঁজি এবং শ্রমের মধ্যে মৌলিক বিরোধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা সমাজতন্ত্র নয়, পুঁজিবাদের নীতির চর্চা করছি। আমরা লড়াই লড়াই লড়াই চাই-এর মতো স্লোগান দিতে চাই না এবং কারখানা বন্ধ করতে চাই না।” তাঁর এই সকল মন্তব্য দলের অনেকেই সেই সময় ভালভাবে নেয়নি। আর এখানেই বুদ্ধ ভট্টাচার্যর সাফল্য। দলের নেতা-কর্মীদেরও তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন, রাজ্যের অগ্রগতির জন্য শিল্প আনতে হবে। আর শিল্প আনতে গেলে, শিল্পপতিদের সঙ্গে বিরোধ করলে হবে না। এই নয়া ধাঁচের বাম
তবে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বাংলায় শিল্পায়নের ডাক দিয়ে চাপে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সুযোগ বুঝে মমতা বন্দোপাধ্যায়ও বাম সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় বামফ্রন্ট। যাদবপুর কেন্দ্রে পরাজিত হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। এরপরও কিন্তু হতাশা গ্রাস করেনি তাঁকে। দলের কাজে সব সময় এগিয়ে এসেছেন। তবে, তাঁর শরীর ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছিল। তারপরও যতটা সম্ভব দলকে সময় দিয়েছিলেন। ব্রিগেডের সভায় তাঁকে গাড়ি থেকে বসেও বক্তৃতা দিতে দেখা গিয়েছিল। এমনকি, সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি বক্তৃতা দেওয়া বা বার্তা দেওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও, এআই সংস্করণের মাধ্যমে রাজ্যবাসীকে বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। আজ জামা-কাপড় বদলানোর মতো দল বদলের বাজারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মতো রাজনৈতিক কর্মী সত্যিই বিরল।