DVC-র সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্ন’ করলে বাংলার কী লাভ? কী ক্ষতি?
DVC: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জল ছাড়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, "ডিভিসি-র জলে কেন বাংলা ডুববে? আমরা কৈফিয়ত চাই। ঝাড়খণ্ডকে বাঁচানোর জন্য জল ছাড়া হয়। ডিভিসি-র সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব কি না, ভেবে দেখব।"
এক গলা জলে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধ। দুমুঠো ভাতের জন্য উপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা, যদি কয়েকটা খাবারের প্যাকেট পাওয়া যায়, অন্তত একরত্তি সন্তানের পেটটুকু ভরবে। একটু ত্রিপল পেলে তাতেই গুঁজে নেওয়া যাবে মাথা! এই ছবি বাংলায় নতুন নয়। ২০২৪-এও তার ব্যাতিক্রম দেখা গেল না। পুজোর মুখেই ভেসে গেল একের পর এক গ্রাম। প্রতি বছরের মতো এবারও সেইসব বন্যা কবলিত এলাকায় পৌঁছে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারও মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল সেই একই ‘ম্যান মেড বন্যা’র তত্ত্ব। মানুষের তৈরি করা বন্যা! আদৌ কি সম্ভব? এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ডিভিসি (DVC)-র সঙ্গে আদৌ সম্পর্ক রাখবেন কি না সেটা ভেবে দেখবেন।
ঠিক কী বলতে চান মুখ্যমন্ত্রী?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ডিভিসি অর্থাৎ ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’-এর বাঁধ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জল ছাড়ার কারণেই বন্যায় ভাসছে রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ। এই ডিভিসি-র অন্যতম স্টেক হোল্ডার কেন্দ্রীয় সরকার হলেও রাজ্যেরও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে সেখানে।
মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, রাজ্যকে না জানিয়ে ডিভিসি অনিয়ন্ত্রিতভাবে অধিক মাত্রায় জল ছেড়ে দিয়েছে। ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তাই ডিভিসি-র সঙ্গে আগামিদিনে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও প্রস্তুতি তিনি। ডিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে রাজ্যের কি আদৌ কোনও লাভ হবে? ডিভিসি-র বিরুদ্ধে এত অভিযোগ নিয়ে কী পদক্ষেপ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
আসলে এই ডিভিসি ঠিক কী? কী কাজ করে?
ডিভিসি বা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন হল একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। মূলত বাংলা ও বিহারের বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এই কর্পোরেশন তৈরি করা হয়েছিল। বিহারের যে অংশের বন্যার জন্য এই কর্পোরেশন তৈরি করা হয়েছিল, সেটি বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত। তাই এখন ডিভিসি-র অধীনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু অঞ্চল। স্বাধীন ভারতে এটাই ছিল প্রথম কোনও ‘ভ্যালি প্রজেক্ট’।
কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের অধীনে থাকা এই কর্পোরেশন পরিচালনা করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কলকাতাতেই রয়েছে ডিভিসি-র সদর দফতর। বন্যাপ্রবণ দামোদরের জল নিয়ন্ত্রণ করবে বলেই এই কর্পোরেশন তৈরি করা হয়েছিল। একাধিক বাঁধ তৈরি করে বন্যার জল নিয়ন্ত্রণ করা হয় এই কর্পোরেশনের মাধ্যমে। মোট চারটি বাঁধ আছে এর অধীনে- পাঞ্চেৎ, মাইথন, কোনার ও তিলাইয়া।
বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ছিলেন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের রূপকার
দামোদর নদী বরাবরই বন্যাপ্রবণ। ১৯৪৩ সালে এই দামোদরের বন্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্বেই এই নদীকে নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়। বিহারের ছোটনাগপুর মালভূমির পালামু থেকে পথচলা শুরু করে হুগলি নদীতে মিশেছে দামোদর। বন্যা পরিস্থিতি দেখে সেই সময় ব্রিটিশ সরকার ভ্যালি প্রজেক্টের ভাবনা-চিন্তা শুরু করে। আমেরিকায় যেমন রয়েছে ‘টেনেসি ভ্যালি প্রকল্প’, ঠিক সেভাবেই ভারতে দামোদর ভ্যালি প্রকল্পের কথা ভাবা হয়েছিল।
তৎকালীন প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ডবলিউ এল ভরদুইনকে দেওয়া হল প্রজেক্টের পুরো দায়িত্ব। আর এই প্রকল্পের রূপায়নের দায়িত্ব পেলেন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। পরবর্তীতে জওহরলাল নেহরুর সরকার তৈরি করে বিশেষ আইন। ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই স্বশাসিত দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন কাজ শুরু করে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমতি ছাড়া কি জল ছাড়া সম্ভব?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় দাবি করেছেন, রাজ্যকে না জানিয়েই জল ছেড়ে দিয়েছে ডিভিসি। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জল ছাড়া হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি চিঠিও লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই চিঠির উত্তরে কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রক স্পষ্ট জানিয়েছে, রাজ্যের সঙ্গে কথা বলেই জল ছাড়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ: মাইথন ও পাঞ্চেত বাঁধ থেকে ডিভিসি অপরিকল্পিত এবং একতরফাভাবে ৫ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে। তার ফলে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি বন্যার কবলে পড়েছে। ৫০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
কেন্দ্রের অভিযোগ: রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই জল ছাড়া হয়েছে। ‘দামোদর ভ্যালি রিজার্ভার রেগুলেশন কমিটি’-তে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার ইঞ্জিনিয়াররা রয়েছেন। সেই কমিটি অনুমোদন করলেই জল ছাড়া হয়।
এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন নগর পরিকল্পক (টাউন প্ল্যানার) দীপঙ্কর সিনহা জানিয়েছেন, ডিভিসি-র তিন স্টেক হোল্ডারের মধ্যে একটি হল পশ্চিমবঙ্গ। তাই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন সেখানে। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন এই বাঁধ সম্পর্কিত কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন দীপঙ্কর সিনহা । তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যকে না জানিয়ে জল ছাড়া সম্ভব নয়।
যদি সত্যিই রাজ্যকে না জানিয়ে জল ছাড়া হয়, তাহলে?
প্রাক্তন নগর পরিকল্পক (টাউন প্ল্যানার) দীপঙ্কর সিনহা মনে করিয়ে দিয়েছেন ডিভিসি-র নিজস্ব আইন আছে। ১৯৪৮ সালে তৈরি হওয়া সেই ডিভিসি অ্যাক্টেই বলা আছে, কী নিয়ম, সেখানেই উল্লেখ করা আছে।
DVC-র সেই আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘যদি কোনও সরকারের (কেন্দ্র, ঝাড়খণ্ড বা পশ্চিমবঙ্গ) সঙ্গে কর্পোরেশনের মতপার্থক্য হয়, তাহলে দেশের প্রধান বিচারপতি একজন আর্বিট্রেটর (মধ্যস্থতাকারী) নিয়োগ করবেন। সেই আর্বিট্রেটর যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই কার্যকর হবে।’ প্রাক্তন সরকারি আধিকারিকের কথায়, যদি সত্যিই রাজ্যকে না জানিয়ে জল ছাড়া হয়ে থাকে, তাহলে এই আইন মেনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ডিভিসি-র সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক ছিন্ন করা কি আদৌ সম্ভব?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জল ছাড়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, “ডিভিসি-র জলে কেন বাংলা ডুববে? আমরা কৈফিয়ত চাই। ঝাড়খণ্ডকে বাঁচানোর জন্য জল ছাড়া হয়। ডিভিসি-র সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব কি না, ভেবে দেখব।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা শুনে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “ডিভিসির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন। আটটা জেলাতে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবে।” তাঁর দাবি, ডিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিলে বিপদে পড়তে হবে বাংলাকেই।
অন্যদিকে, সম্পর্ক না রাখার এই কথার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না প্রাক্তন আধিকারিক দীপঙ্কর সিনহা । বাংলার জন্যই যে কর্পোরেশন তৈরি করা, তার সঙ্গে বাংলা সম্পর্ক না রেখে কীভাবে চলবে, সেই প্রশ্নই তুলছেন তিনি।
ডিভিসি জল না ছাড়লে কী হবে?
বাঁধের সাহায্যে জল ধরে রেখে, তা কাজে লাগায় ডিভিসি। চাষের কাজের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজে লাগে জল। বর্ষাকালে জল অতিরিক্ত বেড়ে গেলে, জল ছাড়তে হয়।
জল ছাড়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে। ২৩,০০০ থেকে ৫০,০০০ কিউসেক জল ছাড়লে, তা গ্রিন ক্যাটাগরিতে পড়ে। অর্থাৎ স্বাভাবিক। ৫০,০০০ কিউসেক থেকে ১ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়লে, তা হয় কমলা বিভাগ। ১ লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ কিউসেক জল ছাড়লে তা হলুদ বিভাগে পড়ে। এছাড়া ১,৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ কিউসেক জল ছাড়লে তা বলে রেড ফ্লাড বা লাল বিভাগে।
ডিভিসি-র ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের বর্ষায় ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ৫১ মিনিটে ৫০,০০০ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জল না ছাড়লে বাঁধের প্রাচীর ভেঙে পড়তে পারে। তখন জল কোন দিক দিয়ে বইতে শুরু করবে, তা বোঝা যাবে না।
উল্লেখ্য, বন্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাঝেই ঝাড়খণ্ডের তেনুঘাট বাঁধ থেকে অনেক জল ছাড়া হয়েছে, যা সরাসরি দামোদর নদী দিয়ে বইছে। এই বাঁধ ডিভিসি-র অন্তর্ভুক্ত নয়। এই বাঁধের জন্যই কি বাংলার বন্যা? সেই প্রশ্নও উঠেছে।