EXPLAINED: ক্যানসারের ‘ওষুধ’ আবিষ্কার রাশিয়ার, কী বলছেন কলকাতার ডাক্তাররা?
EXPLAINED: রাশিয়া জানিয়েছে, তারা নাকি ক্যানসারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছে। নতুন বছর থেকেই ক্যানসারের রোগীদের বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে এই ভ্যাকসিন। তবে এখানে অনেক গুলি প্রশ্ন ওঠে!
ক্যানসারের উত্তর কী? এই প্রশ্নই তাড়া করে বেড়াচ্ছে গোটা বিশ্বকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের যতই উন্নতি হোক না কেন, এই একটা জায়গায় এসে যেন সকলেই অসহায় হয়ে পড়ে। তবু ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নীরিক্ষা লেগেই আছে। যার উপর ভর করে একটু একটু করে বাড়ছে ভরসা। সম্প্রতি রাশিয়ার আবিষ্কার করা নতুন ক্যানসারের টিকা নিয়ে তেমনই হইচই পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে।
রাশিয়া জানিয়েছে, তারা নাকি ক্যানসারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছে। নতুন বছর থেকেই ক্যানসারের রোগীদের বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে এই ভ্যাকসিন। তবে এখানে অনেক গুলি প্রশ্ন ওঠে! প্রথমত, এই নতুন ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ ট্রায়াল কি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে তাহলে সেই তথ্য কোথায়? নতুন এই ক্যানসারের ভ্যাকসিন কী ভাবে কাজ করে? এই ভ্যাকসিন কতটা ভরসাযোগ্য? ভারতীয়রা কবে থেকে পেতে পারে এই ভ্যাকসিন? রাশিয়ার এই ভ্যাকসিন কি সব ধরনের ক্যানসারের প্রতিকার করতে সক্ষম?
নতুন ভ্যাকসিন নিয়ে কী দাবি রাশিয়ার?
এই খবরটিও পড়ুন
রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রেডিওলজি মেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের জেনারেল ডিরেক্টর আন্দ্রে কাপ্রিন জানিয়েছেন, রাশিয়া ক্যানসারের বিরুদ্ধে mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। যা ক্যানসারের বিস্তারকে রোধ করতে পারে আবার ম্যালিগনেন্ট টিউমারকে ক্যানসার থেকেও আটকায়।
কী ভাবে কাজ করে এই mRNA ভ্যাকসিন?
সাধারণত আমরা জানি কোনও রোগ হওয়ার আগেই সেই রোগের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়া হয়। যাতে সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে। তবে সাধারণত mRNA ভ্যাকসিন যে ভাবে কাজ করে তার সঙ্গে রাশিয়ার তৈরি ভ্যাকসিনের সামান্য পার্থক্য রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবার শরীরে নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশ কিছু গলদ, ফাঁক বা ক্ষত তৈরি হয়। সেই ফাঁক গলেই শরীরে ঢুকে পড়ে নানা রোগ জীবাণু। এখানেই প্রয়োজন হয় ভ্যাকসিনের। ওষুধ দিয়ে সেই সব ফাঁক বন্ধ করা হয়, যাতে সেই কোনও ব্যাক্তি সেই নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত না হয়।
mRNA ভ্যাকসিন শরীরে প্রোটিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করে। যেমনটা করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও হয়। তবে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হত, যাতে কেউ করোনা আক্রান্ত না হয় সেই কারণে। কোনও ব্যাক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে আর সেই ভ্যাকসিন নিয়ে কোনও লাভ হয় না।
তবে রাশিয়ার তৈরি নতুন এই ভ্যাকসিনের বিষয়টি একটু আলাদা। রাশিয়ার mRNA ভ্যাকসিন জেনেটিক নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে শরীরের কোষগুলিতে ক্যানসার প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম, যা অ্যান্টিজেন নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্যানসার প্রোটিনকে শনাক্ত করে, তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতেও শেখে।
এবার যখন সেই একই ধরনের অ্যান্টিজেন শরীরের ইমিউন সিস্টেম, টিউমার কোষে শনাক্ত করে তারা সেই ক্যানসার অ্যান্টিজেনকে লক্ষ্য করে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। mRNA ভ্যাকসিনগুলি টিউমার কোষের উপস্থিত একাধিক অ্যান্টিজেনকেও শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
এই mRNA ভ্যাকসিনগুলি প্রত্যেকে মানুষের ইমিউন সিস্টেম এবং ক্যানসার কোষের ধরন বিশ্লেষণ করতে পারে। সেই অনুসারে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সর্বোপরি এই ভ্যাকসিন টিউমার থেকে ক্যানসারের বিকাশ বা নির্দিষ্ট কোনও অঙ্গ থেকে শরীরের অনান্য অংশে ক্যানসার কোষের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারে বলে দাবি। অর্থাৎ কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও এই ভ্যাকসিন নিতে পারবেন।
কী বলছে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল রিপোর্ট?
গামলেয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির ডায়রেক্টর অ্যালেক্সান্ডার গিন্টসবার্গের মতে, প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে এই ভ্যাকসিন টিউমারের বৃদ্ধি এবং ক্যানসারের বিস্তার রোধ করে। তিনি বলেন, “ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে এই ভ্যাকসিন টিউমারের বিকাশ এবং সম্ভাব্য মেটাস্টেসগুলির বিকাশ রোধ করে।”
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলতি বছরের গোড়ার দিকেই ক্যানসারের ভ্যাকসিন নিয়ে আসার বিষয়টি নিয়ে আশা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন খুব শীঘ্রই রাশিয়া ক্যানসারের ভ্যাকসিন নিয়ে আসবে।
ক্যানসারের ভ্যাকসিন কি এটাই প্রথম?
না, রাশিয়া ছাড়াও আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ ক্যানসারের ভ্যাকসিন নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করছে। এমনকি মডার্না এবং মার্ক সংস্থা ক্যানসারের ভ্যাকসিন নিয়ে যে গবেষণা করছে তার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে সংস্থার তরফে জাআন গিয়েছে সেই ভ্যাকসিন বাজারে আসতে এখনও সময় লাগবে। প্রায় ২০৩০ সাল নাগাদ সেই ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও ইউরোপের বহু দেশ ক্যানসারের ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। চিন ও আমেরিকা যৌথ উদ্যোগে প্রোটিন ব্যবহার করে ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালাচ্ছে। পেন স্টোক হাক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা, ক্যানসারের ইঞ্জিনিয়ারড সেলের ব্যপক বৃদ্ধির হারকে ব্যবহার করে ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এখন অবধি সারভাইক্যাল ক্যানসার বা জরায়ুর ক্যানসারের ক্ষেত্রেই টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। সারভাইক্যাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে মহিলাদের ১২-১৫ বছরের মধ্যেই সেই টিকা দিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন চিকিৎসকেরা। সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের টিকা বাজারে পাওয়া যায়।
কী মত বিশেষজ্ঞদের?
বিখ্যাত ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় এই ভ্যাকসিন নিয়ে বলেন, “কোন ক্যানসারের জন্য এই টিকা দেওয়া হবে। কতটা ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়েছে? কাদের উপর ট্রায়াল হয়েছে? হিউম্যান ট্রায়াল হয়েছে কি? হয়ে থাকলে সেই ট্রায়ালের তথ্য কোথায়? কাদের এই ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেওয়া হবে? তা কি কেবল রাশিয়ার মানুষ বিনামূল্যে পাবেন না বিশ্বে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও জানি না। তবে যদি সত্যি এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে ক্যানসার সেরে ওঠে তবে খুবই ভাল। কিন্তু দাবি এবং বাস্তব সব সময় মেলে না।”
নিউজ ১৮-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, স্যার গঙ্গা রাম হাসপাতালের, ক্যানসার বিভাগের চেয়ারম্যান চিকিৎসক শ্যাম আগরওয়াল জানিয়েছেন, রাশিয়ার দাবি সত্যি হলে ক্যানসার গবেষণা এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। নতুন এই mRNA ভ্যাকসিন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে এমনভাবে গড়ে তোলে যে তারা শরীরের কোথাও ক্যানসার সেলের অস্তিত্ব খুঁজে পেলে তাকে ধ্বংস করে। ক্যানসার কোষ না থাকলে, শরীরের মধ্যে অ্যান্টি ক্যানসার প্রোটিন ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই টিকার হিউম্যান ট্রায়ালের কোনও ডেটা এখনও পাওয়া যায়নি। তাই কতগুলি ডোজ প্রয়োজন তাও পরিষ্কার নয়। সুতরাং যতক্ষণ না সেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পূর্ণ বোঝা সম্ভব নয়। অনেক সময় অনেক কিছু তত্ত্বগত ভাবে সঠিক হলেও, বাস্তবে অন্যরকম হয়।
ক্যানসার চিকিৎসক স্বর্ণবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভ্যাকসিন এত তাড়াতাড়ি বাজারে আনা সম্ভব হয় না। এটা অনেকটা বড় প্রসেস। এখনও হিউম্যান ট্রায়ালের কোনও রিপোর্ট নেই। কী ভাবে রাশিয়ার মতো একটি দেশ ভ্যাকসিন বাজারে আনছে তা জান নেই। তবে ফেস ১ ট্রায়াল ছাড়া কোনও ভ্যাকসিন যদি আমাকে দিয়ে বলা হয় রোগীর উপর প্রয়োগ করতে, তাহলে আমি তা করব না।”
এই ভ্যাকসিন যে ক্যানসার চিকিৎসা এবং গবেষণায় নতুন দিশা নিয়ে এনেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সত্যি বাস্তবে কতটা উপযোগী তা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কেবল সময় বলবে ক্যানসার কে কী হারানো সম্ভব, না কি সে অমর!