Explained: ইনজেকশন উঠে যাবে! নতুন আবিষ্কারে শোরগোল চিকিৎসা বিজ্ঞানে

Health: নানা দূরারোগ্য ব্যধীর জন্য রয়েছে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল। তাতেও কাজ না হলে রয়েছে ইনজেকশন। তবে ইনজেকশন দিয়ে যতই কঠিন ব্যধী সহজে সারুক না কেন, একটা সমস্যাও রয়েছে।

Explained: ইনজেকশন উঠে যাবে! নতুন আবিষ্কারে শোরগোল চিকিৎসা বিজ্ঞানে
ইনজেকশনের যুগ কি তবে শেষ?
Follow Us:
| Updated on: Nov 30, 2024 | 7:02 PM

প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান। যার হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগে যেখানে কেবল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা হত সেখানে আজ অ্যালোপাথি, হোমিওপাথি চিকিৎসা রয়েছে। প্রতিনিয়ত যেন ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।

নানা দূরারোগ্য ব্যধীর জন্য রয়েছে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল। তাতেও কাজ না হলে রয়েছে ইনজেকশন। তবে ইনজেকশন দিয়ে যতই কঠিন ব্যধী সহজে সারুক না কেন, একটা সমস্যাও রয়েছে। তা হল সংক্রমণের ভয়। আবার ইনজেকশন নেওয়া একটু বেদনাদায়ক বটে। কিছু কিছু ইনজেকশন নিতে তো রীতিমতো ব্যথা হয়। তাই যদি সেই কাজটিও কোনও ওষুধ খেয়েই হয়ে যেত তাহলে মন্দ হয় না। সাধারাণত পেটের সমস্যা, ইনসুলিন বা অনান্য নানা রোগে ওষুধে কাজ না হলে, তখন ইনজেকশন নিতে হয়।

এবার সেই ইনজেকশনের বিকল্প পথ খুঁজে বার করল, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি), বারমিংহাম এবং মহিলা হাসপাতাল এবং ওষুধ প্রস্তুতকারক নভো নরডস্কের বিজ্ঞানীরা।

গবেষকদের এই বিশেষ দল এমন এক ক্যাপসুল তৈরি করেছেন যার ফলে সহজেই ইনজেকশনকেও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। আপনারা বলবেন, এ আর নতুন কী? ক্যাপসুলের ব্যবহার তো আগেও ছিল। তবে এই নতুন বিশেষ ক্যাপসুল কিন্তু অনান্য ক্যাপসুলের মতো এক নয়। সেফালোপড জাতীয় জলে বসবাসকারী প্রাণীর ‘ইঙ্ক স্প্রে’ বা ‘জেট প্রপালশন মেকানিজম’-এর ধরন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ এই ক্যাপসুল। যা শরীরে গেলেই ফেটে গিয়ে ওষুধ নিস্ক্রমণ করবে না। বরং তা পেটে গিয়ে পাচন রসের সংস্পর্শে এলে তবেই বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভিতরে থাকা ওষুধ নিস্ক্রমণ করবে। গবেষকদের দাবি বিশেষ করে যারা হাই ব্লাড সুগারের রোগী, নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয় তাঁদের জন্য এই ক্যাপসুল বেশ কার্যকরী হবে। ইনসুলিন নিতে হলে রোজ শরীরে সূচ ফোটাতে হয়। কিন্তু নতুন এই ক্যাপসুল সেই ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

কিছুদিন আগে নেচার জার্নালে প্রকাশিত ‘সেফালোপড-অনুপ্রাণিত জেটিং ডিভাইসস ফর গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ড্রাগ ডেলিভারি’ শীর্ষক গবেষণায় এই বিশেষ ক্যাপসুলের কথা প্রকাশ্যে আনা হয়েছে।

তবে এই ক্যাপসুলের গুরুত্ব বুঝতে হলে, আগে জানতে হবে কেন ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়?

সাধারণত শরীরে হরমোন জনিত কোনও সমস্যা হলে, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে, কোনও নির্দিষ্ট রোগের ভ্যাকসিন দিতে, অ্যান্টিবডি জনিত ক্ষেত্রে বা ক্যানসার জাতীয় মারণ রোগের চিকিৎসা করতে ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। আসলে এই সব ক্ষেত্রে বড় বায়োলজিক্যাল মলিউকিউল ব্যবহার করে ওষুধ বানানো হয়। কিন্তু সেই মলিউকিউলের কার্যকরিতা ধরে রাখার ক্ষমতা ছোট ছোট ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলে থাকে না।

একবার গিলে ফেলা হলে সেই সব ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের বড় মলিকিউল পাচনকারী এনজাইমের সংস্পর্শে এসে দ্রুত ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। এতে যে কেবল ওষুধের কার্যকারীতা কমে তাই নয় বরং নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মূলত এই কারণেই ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় রোগী খুব বমি করলে ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব নয়। তখন ইনজেকশন দেওয়া হয়। প্রোটিন মলিকিউলের ওজন অনেক বেশি হয়। সেই সব সময় ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়।

ইনজেকশনের বিকল্প কী প্রয়োজন?

ইনজেকশন ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ইনজেকশনের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছেন। কারণ ইনজেকশন ব্যবহার করলে অনেক সময় খুব কম হলেও সংক্রমণ, ত্বক জ্বালা এবং অন্যান্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। রোগীরাও ইনজেকশন নিতে ভয় পায় অনেক সময়। কখনও কখনও কিছু ইনজেকশন বেশ বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। কিন্তু ইঞ্জেকশনের তুলনায় ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খাওয়া অনেক সহজ।

বিশেষ এই ক্যাপসুল কী ভাবে তৈরি করা হয়?

গবেষকরা ক্যাপসুল তৈরির জন্য স্কুইড এবং অক্টোপির মতো সেফালোপড জাতীয় প্রাণীর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। এই ধরনের প্রাণী জলের মধ্যে কালি স্প্রে করে জেটের মতো চাপ দিয়ে এগিয়ে যায়।

গবেষকরা স্কুইড এবং অক্টোপির জেটিং অ্যাকশনকেই অনুসরণ করেছেন। ক্যাপসুল থেকে তরল ওষুধ বের করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করতে কার্বন ডাই অক্সাইড বা শক্তভাবে কুণ্ডলীকৃত স্প্রিংসকে সংকুচিত করে।

গ্যাস বা স্প্রিং একটি কার্বোহাইড্রেট ট্রিগারের সাহায্যে একটি সংকুচিত অবস্থায় রাখা হয়। ওই ট্রিগার আর্দ্রতা বা পেটের মতো অম্লীয় পরিবেশের সংস্পর্শে এসে দ্রবীভূত হয়ে যায়। যখন ট্রিগার দ্রবীভূত হয়, তখন গ্যাস বা স্প্রিংকে প্রসারিত হয়। ক্যাপসুল থেকে ওষুধ জেটের মতো স্প্রে হয়ে বেরিয়ে যায়। এই ভাবেই শরীরে গিয়ে ক্যাপসুল থেকে ওষুধ মিশে যায়।

কী মত চিকিৎসকদের?

চিকিৎসক মানস কুমার মণ্ডল বলেন, “সব ওষুধের ক্ষেত্রেই ড্রাগ ডেলিভারি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সত্যি মলিকিউলে পরিবর্তন করে ড্রাগ ডেলিভারিতে পরিবর্তন আসে, তাহলে ইনজেকশন নির্ভরতা কমানো সম্ভব।”

চিকিৎসক সুজয় রায় বলেন, “ওষুধের ড্রাগ ডেলিভারির উপরে তার কার্যকারিতা নির্ভর করে। সাধারণত লাইপোজমাল ডেলিভারি সিস্টেম ব্যবহার করে ড্রাগ ডেলিভারি করা হয়।

কী কী ঝুঁকি কমানো সম্ভব?

মানস কুমার মণ্ডল বলেন, “ইনজেকশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমনিতে খুব একটা ঝুঁকি যে থাকে তেমন নয়। তবে তবে কিছু ক্ষেত্রে বেশ বড় রকমের ইনফেকশনের ভয় থাকে। আবার পেশিতে ব্যথা, জ্বর আসার মতো সাইড এফেক্টস কমানো সম্ভব।”

সুজয়বাবুর মতে, “ইনজেকশনে অনেকের ভয় থাকে। ইন্টার ভেনাস ইনজেকশন দিতে গেলে চ্যানেল করতে হয়। তার জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ফলে তা খরচ সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ইনজেকশন দিতে গেলে অনেক বেশি হাইজিন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মানতে হয়। কিন্তু মুখে ওষুধ খেলে সেই ঝামেলা থাকে না। তার সঙ্গে খরচ অনেকটা কমানো সম্ভব। অ্যানাফাইলেকটিক রিয়াকশন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।”

এই নতুন ক্যাপসুল খেলে কতটা উপকার হবে?

মানসবাবু বলেন, “মুখ দিয়ে ওষুধ খেলে তা যে ১০০ শতাংশ ইনজেকশনের মতো কাজ করবে এমনটা বলা যায় না। তবে চেষ্টা করা হবে যতটা বেশি ওষুধ কাজ করে। তবে এমন কিছু ঘটলে তা ভালই হবে।”

সুজয় রায় বলেন, “এই গবেষণা এখনও কার্যকরী নয়। অনেকগুলি পর্যায়ে ট্রায়ালের পরেই তা জানা যাবে। তাই নতুন কোনও গবেষণা এলেই তা কার্যকরী এমন নয়, তবে সেই পদ্ধতিকে নিয়ে গবেষণা করতেও হবে।”

তিনি আরও বলেন, “এই পদ্ধতি সত্যিই কার্যকর হলে, তাতে অনেকেই উপকৃত হবেন। প্রথম দিকে, সামান্য খরচ সাপেক্ষ হলেও এই ধরনের ক্যাপসুলের ব্যবহার বাড়লে, উৎপাদন বাড়বে তখন সাধারণ ভাবেই খরচ আরও কমে যাবে।” নতুন এই উপায় কার্যকরী হলে তা যে সকলের হিত হবে সেটা বলাই বাহুল্য।