EXPLAINED: জেলে কী করতে হবে সঞ্জয়কে, কত মিলবে পারিশ্রমিক? কয়েক বছর বাদেই পাবে ‘মুক্ত জীবন’?
EXPLAINED: এই জেলের সুবিধা হল, এঁরা জেলের মধ্যে থেকেও মুক্ত হন। সকালবেলা এঁরা জেল থেকে বেড়িয়ে যান, সারাদিন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ব্যবসা করা, বা অনান্য কাজ করতে পারেন নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য।
আরজি কর কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রাইয়ের বিরুদ্ধে রায়দান করেছে শিয়ালদহ কোর্ট। এদিন বিচারপতি অনির্বাণ দাস জানান আরজি করের ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়। ফাঁসি নয় আমৃত্যু সশ্রম কারাবাসের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। অর্থাৎ সারাজীবন জেলেই কাটাতে হবে সঞ্জয়কে।
সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জেলে থাকাকালীন সময়ে তাঁকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হবে। কিন্তু কী কী কাজ করতে হয় জানেন? জেলের মধ্যে বন্দিদের নানা ধরনের কাজ করতে হয়। বিভিন্ন সিনেমা, সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজে দেখা যায় জেলের মধ্যে বন্দিরা নানা ধরনের কাজ করে থাকে। এর মধ্যে মূলত কায়িক পরিশ্রমের কাজ যুক্ত থাকে। কিন্তু কী কী কাজ করতে হয় জানেন?
এখন বেশিরভাগ জেলকে সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করানো হয়েছে। নিজের করা ভুলের জন্য সাজা পাওয়ার মাধ্যমে চলতে থাকে বন্দিদের শুদ্ধিকরণ। এই সময় এঁদের নানা কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন বিভাগে কাজে নিযুক্ত করা হয় বন্দিদের। রান্নাবান্না, কাঠের কাজ, শৌচাগার, বাগান সহ বিভিন্ন কাজ থাকে। যেমন ধরুন কেউ যদি কিচেন বিভাগে কাজ করে, তাহলে তাঁকে সবার জন্য রান্না করা, খাবার পরিবেশন করা, বাসন মাজা এই সব কাজ করতে হয়।
এই খবরটিও পড়ুন
কেউ যদি বাগানে কাজের বরাত পান, তাহলে গাছের পরিচর্যা করা বা সেই ধরনের কাজ করতে হয়। জামা-কাপর কাচা, বা বাথরুম, জেল পরিষ্কারের দায়িত্ব থাকে আলাদা আলাদা বিভাগের উপরে। যে দিন যেখানে কাজের ভাগ পরে সেই দিন সেখানে কাজ করতে হয়।
অনেক জেলে আজকাল ম্যানুফাকচারিং ডিপার্টমেন্ট থাকে। সে সব জায়গায় বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরি করা হয়। এই তালিকায় আছে গামছা, চাদর, সর্ষের তেল, কাঠের আসবাব পত্র, বাসনপত্র সহ আরও নানা ধরনের কাজ। পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি, দমদম, মেদিনীপুর বহরমপুরের মতো সংশোধনাগারগুলিতে এই ধরনের ম্যানুফাকচারিং ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।
কারাসূত্রে খবর সব সংশোধনাগারে এই ম্যানুফাকচারিং ডিপার্টমেন্ট থাকে না। বিশেষ করে জেলা ভিত্তিক যে সব ছোট ছোট সংশোধনাগার বা জেল রয়েছে, সেখানে কয়েদিদের আবার অন্য ধরনের কাজ করতে হয়। রান্নাবান্না করা, গোডাউনের কাজ, জেল পরিষ্কার রাখার মতো নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ জেল বন্দিরাই করে থাকে।
জেলের বাইরেও কাজ করাতে নিয়ে যাওয়া হয় আসামীদের –
জেলের বাইরেও অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হয় আসামীদের। এঁদেরকে ‘এক্সট্রা মুরাল গ্যাং’ বলে। যে সব বন্দিদের জেলের ভিতরে ট্র্যাক রেকর্ড খুব ভাল, জেলের মধ্যে কোনও ঝামেলায় জড়ায়নি, যা সাজা পেয়েছে তার প্রায় ২/৩ ভাগ সাজা ভোগ করা হয়ে গিয়েছে, বেশ কয়েকবার প্যারোলে মুক্ত হওয়ার পরেও তাঁর সমন্ধে কোনও খারাপ রেকর্ড নেই তাঁদেরকে জেলের বাইরে কিন্তু জেলের জুরিডিকশনের মধ্যে বিভিন্ন কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সব কাজের মধ্যে চাষবাষ করা, বিল্ডিং তৈরি বা পুকুর পরিষ্কারের মতো নানা কাজ রয়েছে।
কী ভাবে শ্রমের টাকা পান বন্দিরা?
এই সব কাজের বিনিময়ে টাকাও পান বন্দিরা। আগে রোজের কাজের হিসাবে টাকা দেওয়া হত বন্দিদের। যা যখন তাঁদের জেল মুক্তি ঘটত, তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হত। কারা দফতর সূত্রের খবর, এখন আর তা হয় না। প্রত্যেক কয়েদির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়ে গিয়েছে। তাঁদের শ্রমের টাকা সরাসরি সেই অ্যাকাউন্টে ফেলে দেওয়া হয়। প্রায় ৯৫ শতাংশ বন্দিকেই এই পদ্ধতিতে টাকা দেওয়া হয়। কোনও কারণে ৫ শতাংশ বন্দির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করা সম্ভব হয়নি, তাঁদের টাকা দেওয়া হয় নগদে।
সংশোধনাগারে থাকাকালীন সময়ে টাকার প্রয়োজন হলে সুপারিনটেন্ডেন্টের অনুমতি নিয়ে সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারেন। তবে সাজা শেষ হয়ে গেলে যখন সে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন একটা বিশেষ রিলিজ সার্টিফিকেট এবং ব্যাঙ্কের পাসবুক দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা ওই টাকা ব্যবহার করতে পারেন। সে নিজের ইচ্ছা মতো তখন সেই টাকা ব্যবহার করতে পারে। যাঁরা আমৃত্যু কারাবাসের সাজা হয়েছে তাঁরা সুপারিনটেন্ডের অনুমতি নিয়ে টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন।
মনে রাখবেন এই টাকা আবার দুটি ভাগে কয়েদিদের দেওয়া হয়। ৫০ শতাংশ যা তাঁরা জেলে থাকার সময় নিজের ইচ্ছা মতো খরচ করতে পারেন, বাড়িতে পাঠাতে পারেন।কয়েদির আবেদনের ভিত্তিতে ব্যাঙ্ককে জানালে, ব্যাঙ্ক সেই ভাবে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাকি টাকা চাইলেই খরচ করা যায় না। তার জন্য জেল কতৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। আইজির অনুমতি নিয়ে একেকবারে ৫০% করে টাকা তুলতে পারে। জেলের ভাষায় একে বলে সাদা টাকা এবং লাল টাকা।
কারা দফতর সূত্রে খবর, সশ্রম দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী তিনটি হারে পারিশ্রমিক দেওয়া কথা। দক্ষ শ্রমিক হলে রোজ ১০৫ টাকা দিতে হবে। অর্ধদক্ষ শ্রমিক ১২০ টাকা। অদক্ষ শ্রমিকরা দিন প্রতি ১৩৫ টাকা পান।
জেলে থেকেও মুক্ত জীবন পেতে পারেন কয়েদিরা –
সরকারের উদ্যোগে কয়েদিদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য রয়েছে ওপেন জেল। কী এই ওপেন জেল? যে সব কয়েদিদের দীর্ঘ দিন সাজা কাটা হয়ে গিয়েছে (অন্তত ৭-১০ বছর), হয়তো আর কিছুদিন সাজা কাটা বাকি রয়ে গিয়েছে, যাঁদের ট্র্যাক রেকর্ড ভাল, জেলে ভাল ব্যবহার ছিল, জেল কতৃপক্ষ ভরসা করে এমন কোনও আসামীকে এই ওপেন জেলে ট্রান্সফার করা হতে পারে।
এই জেলের সুবিধা হল, এঁরা জেলের মধ্যে থেকেও মুক্ত হন। সকালবেলা এঁরা জেল থেকে বেড়িয়ে যান, সারাদিন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ব্যবসা করা, বা অনান্য কাজ করতে পারেন নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য। তারই সঙ্গে শিক্ষামূলক কোনও প্রতিষ্ঠানে কিছু শিখতে যেতে পারেন। অর্থাৎ সমাজের সঙ্গে মেশার, বাইরের জগতে সাধারণ ভাবে বাঁচার একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে দিনের শেষে আবার জেলে ফিরে আসতে হয়।
মনে রাখবেন কারা ওপেন জেলে যেতে পারবেন, তা নির্ধারণ করে ওপেন জেল বোর্ড। এই বোর্ডে জেল সুপারিনটেন্ডেন্ট, আইজি, জেলার সহ আরও অনেকে থাকেন। দীর্ঘ দিন জেল জীবনে কোনও কয়েদির ব্যবহারের উপর নির্ভর করে কাউকে এই ওপেন জেলে পাঠানো হবে কি না তা ঠিক করা হয়। কয়েদিদের সংশোধন করাই এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।
ওপেন জেলে থাকা আসামীদের নিজের খাবারের জোগান নিজেদের করে নিতে হয়। এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারাকর্মী জানান ওপেন জেলে যাওয়ার পরে তিন মাস অবধি ওই কয়েদির খাবার দাবারের খরচ বহন করে সরকার। কিন্তু তারপর থেকে নিজের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই রোজগার করে করতে হয়। অর্থাৎ আজীবন কারাবাসের সাজা পেলেও, যদি নিজেকে শুধরে নেন তাহলে ভালো করে বাঁচার সুযোগ পেতে পারেন সঞ্জয়ও।
যদিও রায় প্রকাশের পরেই নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ফাঁসির আবেদন করতে হাইকোর্টে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজ্য। আবার উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দোষী সঞ্জয় রায়ের আইনজীবিও। সুতরাং সঞ্জয়ের ভবিষ্যৎ কী, তা জানার একমাত্র উপায় অপেক্ষা!