কলকাতা: সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিষবাষ্পে জ্বলছে বাংলাদেশ। গোটা বিশ্বের দরবার নাক কাটলেও ভারত বিদ্বেষ থামছে না বাংলাদেশের। রণহুঙ্কার দিয়েই চলেছেন বাংলাদেশের কট্টরপন্থী নেতারা। কলকাতা থেকে সেভেন সিস্টার্স দখলের ডাক পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছেন। তা নিয়ে হাসির রোল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এপার থেকে ধেয়ে যাওয়া মিমের স্রোতে কার্যত নাকানিচোবানি খাচ্ছেন ওপারের বিএনপি-র মতো দলের নেতারা। নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে ইউনূস সরকারকে। কিন্তু, ভারত বিদ্বেষ থামছে কোথায়! থামছে না আস্ফালনও। কিন্তু, বাংলাদেশের একেবারে ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে এক ভয়ঙ্কর সৈন্য দল। যা দেখে অনেকেই বলছেন, ভারতের ‘খেয়ে’ ভারত বিদ্বেষের পালে হাওয়া তুলতে গিয়ে গিয়ে কখন যে নিজের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে তা বুঝতে পারছে না বাংলাদেশের অন্তর্বতী সরকার। কিন্তু, কেন এই শঙ্কা? মুখে না বললেও তাঁদের ভয়ে কার্যত তটস্থ হয়ে আছে বাংলাদেশের সেনা। আরাকান আর্মি। হ্যাঁ এই সৈন্য দল নিয়েই এখ জোরদার চর্চা গোটা বিশ্বে। কেনই বা নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে নিজেই বিপদ ডেকে আনছে বাংলাদেশ? কতটা ভয়ঙ্কর এই আরাকান আর্মি? কী তাঁদের উদ্দেশ্য?
কেন ভয় বাংলাদেশের?
বর্তমানে মায়ানমারে চলমান যুদ্ধের আবহে বারবার উঠে এসেছে রাখাইনের ( আগে নাম ছিল আরাকান) মতো রাজ্যের নাম। সেখানেই বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসাবে উঠে এসেছে এই আরাকান আর্মি। বর্তমানে দেশের মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণও তাঁদের হাতে। ফলে বাংলাদেশ-মায়ানমারের প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার সীমানা পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির দখলে চলে গিয়েছে বলে দাবি করছে মায়ানমারের একাধিক সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর মায়ানমার অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির এই ঘোষণার পর নাফ নদীতে নৌ চলাচলে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে বাংলাদেশের তরফে। নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিজিবি।
ভিতর থেকেই মদত দিচ্ছে কেউ?
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের ২৭১ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের বান্দরবান, রাঙামাটি ও কক্সবাজারের মতো তিনটি জেলা রয়েছে মায়ানমারের ঠিক পাশেই। এই সীমান্তবর্তী জায়গাগগুলিতেই বর্তমানে আরাকান তাঁদের দাপট দেখাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। তাঁদের কী সাহায্য করছে বাংলাদেশের ভিতরের কেউ? বারবার উঠে আসছে কুকি চিন বা কেএনএফ এর নাম। কুকি চিন বা কেএনএফ ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় তাঁদের শক্ত ঘাঁটি করে নিয়েছে বলে খবর। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, লামা, আলীকদম, বোয়াংছড়ি, রুমা এসবই মূলত তাঁদের প্রধান টার্গেট। সূত্রের খবর, কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির যুবনেতা ছিলেন। এই সংগঠনটির মায়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে খবর। অসমর্থিত সূত্রে খবর, আরাকান আর্মির হাতে বর্তমানে প্রায় ৩৮ হাজার সেনা রয়েছে।
মাথার উপরে ‘ধর্ম সঙ্কট’?
ইতিহাস বলছে, মায়ানমারের বুকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের লড়াই নতুন নয়। জুনতা আর্মির বিরুদ্ধেও তৈরি হয়েছে একাধিক ‘রিবেল’ গ্রুপ। তবে ধারেভারে সবথেকে বেশি শক্তিশালী এই আরাকান আর্মি। তাঁদের লক্ষ্য একটাই আরাকান প্রদেশের স্বায়ত্ত্বশাসন। যদিও যা দিতে নারাজ জুনতা। সে কারণেই প্রায় দীর্ঘদিন থেকেই চলছে লড়াই। তবে এখানেও জুড়েছে ধর্ম। এদিকে জুনতা ও আরাকান আর্মি দুই শিবিরেই আবার বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা বেশি। সে ক্ষেত্রে দুই শিবিরের কাছেই কোণঠাসা রোহিঙ্গারা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলেও বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। একদিকে যখন হিন্দু নিপীড়নের দায়ে গোটা বিশ্বের কাছে মুখ পুড়ছে বাংলাদেশের সেখানে বৌদ্ধ জট তাঁদের নতুন করে চাপে ফেলতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একটা বড় অংশ। যদিও আন্তর্জাতিক সূত্র মতে, ধর্মীয় আগ্রসনের কোনও রণকৌশল এখনও পর্যন্ত নিতে দেখা যায়নি আরাকান আর্মিকে। কিন্তু, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর সীমাহীন অত্যাচারের অভিযোগে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে ভারত। ঢাকায় গিয়ে ঝাঁঝালো বার্তা দিয়ে এসেছেন ভারতের বিদেশ সচিব। এমতাবস্থায় বৌদ্ধ শিবির সোজা কথায় মায়ানমার জট যদি আরও পাকায় তা যে ঢাকার মাথা ব্যথার কারণ বাড়াবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উদ্বেগের কথা মানছেন বাংলাদেশের কর্তারাও
উদ্বেগ যে আছে তা মানছেন টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন। বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছেন, “যেহেতু সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে গিয়েছে সে কারণে আমরা সীমান্তে সতর্কতা বজায় রেখেছি। যাতে কোনও অবৈধ অনুপ্রবেশ না ঘটে তা দেখা হচ্ছে।”
আরাকান আর্মির হুঙ্কারে সবথেকে বেশি ভয় বাড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। সূত্রের খবর, বর্তমানে সেখানে আদিবাসীদের ৬ টি সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। শোনা যায় এদের মধ্যে সবথেকে শক্তি বেশি জেএসএস। জন্মস্থান রাঙামাটি। মনে করা হয় তাঁদের হাতে প্রায় ৫০ থেকে এক লক্ষ পর্যন্ত সশস্ত্র যোদ্ধা রয়েছে। এরা আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তসাসন চায়। সূত্রের খবর, অন্যদিকে আরাকান আর্মি আরাকান সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটার দখল করে বর্তমানে বান্দরবানে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়েছে। এই বান্দারবন আবার গভীর অরণ্যে ঘেরা। ফলে আরাকান আর্মির নিরাপদ ডেরা হিসাবে উঠে আসছে এই বান্দারবন। বান্দরবানের রুমা উপজেলার প্রাংসা সীমান্ত দিয়ে আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে খবর। কিন্তু সে দিকে কী নজর রয়েছে ইউনূস প্রশাসনের?
আরও জটিল হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু
দীর্ঘ সময় ধরে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই আরাকান আর্মি। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের দাবি, মায়ানমারের চলমান এই যুদ্ধে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সহযোগী সংগঠন আরাকান-রোহিঙ্গা আর্মি বা এআরএ, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা সহ কয়েকটি সংগঠনের অবস্থান রয়েছে জুনতা বাহিনীর পক্ষে। এই জুনতাই বর্তমানে সেখানে ক্ষমতায়। কিন্তু, সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ। কারণ, ময়ানমারের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের আবহে পুরনো রোহিঙ্গা সঙ্কট। বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এমদাদুল ইসলাম বিবিসি-র কাছে এ প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, “বাংলাদেশের জন্য বিষয়টা আরও জটিল হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পাঠানোর দিকেও ঝামেলা বাড়ছে।”
কেন চাপ বাংলাদেশের?
বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার মংডু, বুথিডং ও পালেতাওয়া দখলে নেওয়ার দাবি করেছে আরাকান আর্মি। কয়েক মাস ধরে লাগাতার জুনতা বাহিনীর সঙ্গে লাগাতার লড়াইয়ের পর মংডু শহরের দখল নেওয়ার দাবি করেছে আরাকান আর্মি। আর তারপর থেকেই উদ্বেগের জল ঢেউ তুলছে নাফ নদীতেও। পরিস্থিতি যে হাতে বাইরে যাচ্ছে তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে বিজিবি। বেড়েছে টহল। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে কতগুলি রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতাদের অস্ত্র-সহ আটক করতে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশকে। কক্স বাজারের স্থানীয় প্রশাসনও এবার নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। ফেরত পাঠানো তো যাচ্ছে না উল্টে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু কেন? নিরাপত্তা বিশ্লেষক এমদাদুল ইসলাম বিষয় আরও সহজ করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, আরাকান আর্মির সঙ্গে জুনতা বাহিনীর যে যুদ্ধ চলছে তাতে রোহিঙ্গাদের বড় অংশ জুনতাকে সমর্থন করছে। ওদের পক্ষ নিয়েছে। ফলে আরাকান আর্মির রোষানলে পড়বে ওরা। তাই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সঙ্কট যে বাড়ল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে পদ্মপাড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আবহে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছেই। এই আবহে আবার নতুন মাথাব্যথা মায়ানমার। এই অবস্থায় প্রতিবেশী মায়ানমারের সীমান্তে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে দুই দেশেরই বাণিজ্যে বড়সড় প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ। যার ছাপ সুস্পষ্ট হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আঙ্গিকে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বেশ ভালই। বাংলাদেশেও তার প্রভাব যথেষ্ট। এমতাবস্থায়, ওই এলাকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্য আচমকা ওলটপালট হলে তা সামাল দেওয়া ইউনূস সরকারের পক্ষে বেশ খানিকটা চাপের হবে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ভারতের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই অস্থির আবহের আঁচ ইতিমধ্যেই পড়েছে ভারতেও। প্রভাব পড়ছে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও।