SSKM ‘হাইলি সাসপেসিয়াস’! জটায়ু এমনটা বললে কি খুব ভুল হত?

SSKM: সালটা ২০১৫। জুনের মাঝামাঝি। প্রখর গরম। এক তৃণমূল নেতার ‘ভিভিআইপি’ আত্মীয়ার কুকুরের ডায়ালেসিস করার উদ্যোগী হয় এসএসকেএম। এই ডায়ালিসের ‘ডেট’ পাওয়ার জন্য হাসপাতালের ‘দুয়ারে’ মাসের পর মাস রাত কাটান রোগী-পরিজনেরা, সেখানে কুকুরের ডায়ালিস!

SSKM 'হাইলি সাসপেসিয়াস'! জটায়ু এমনটা বললে কি খুব ভুল হত?
প্রতীকী ছবিImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Nov 26, 2023 | 5:06 PM

কলকাতা: এক চিকিৎসক বলছেন, সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকুর’ কণ্ঠস্বরের পরীক্ষা করতে আপত্তি নেই। পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় আচমকা বাধা দিলেন আর এক চিকিৎসক। পদাধিকার বলে যিনি হাসপাতালের এমএসভিপি। তিনি সটান জানিয়ে দেন, এই মুহূর্তে সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা দেওয়া সম্ভব নয়। কেন? সদুত্তর মেলেনি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরকে দেওয়া এমএসভিপি পীযূসকান্তি রায়ের চিঠিতে। তবে, পীযূসকান্তির এমন ‘কীর্তিতে’ হতভম্ব ইডি-র আধিকারিকরা। এমনকী আদালতও। মেডিক্যাল বোর্ড যেখানে গ্রিন সিগন্যাল দিচ্ছে, এ হেন অবস্থায় চিকিৎসকের ভূমিকা ‘ভেরি সারপ্রাজিং’! আদালতে ঠিক এই মন্তব্যটি করে ইডি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, ‘কালীঘাটের কাকুকে’ কোনওভাবে আড়াল করার চেষ্টা করছে এসএসকেএম? বিরোধীদের দাবি, সুজয়কৃষ্ণের স্বর বদল করার চেষ্টা করছেন এসএসকেএমের চিকিৎসকরা, যাতে ইডির হাতে থাকা অডিয়োর নমুনার সঙ্গে কাকুর স্বরের মিল না থাকে। এই অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষ, তবে, বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যখনই কোনও বড় অঘটন ঘটেছে, অযাচিতভাবে রাজনীতির ঘোলা জলে নাম লিখিয়েছে এসএসকেএম। বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে এ রাজ্যের সবচেয়ে বড় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালকে। আদালত পর্যন্ত ভর্ৎসনা করেছে। ফেলু মিত্তিরের বন্ধু জটায়ু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, এ সব দেখে মুখ ফস্কে বলেই ফেলতেন ‘হাইলি সাসপেসিয়াস’!

জটায়ু যদি এই মন্তব্য করতেন, সত্যিই কি ভুল হত! একবার দেখে নেওয়া যাক…   

সালটা ২০১৫। জুনের মাঝামাঝি। প্রখর গরম। এক তৃণমূল নেতার ‘ভিভিআইপি’ আত্মীয়ার কুকুরের ডায়ালেসিস করার উদ্যোগী হয় এসএসকেএম। এই ডায়ালিসের ‘ডেট’ পাওয়ার জন্য হাসপাতালের ‘দুয়ারে’ মাসের পর মাস রাত কাটান রোগী-পরিজনেরা, সেখানে কুকুরের ডায়ালিস! সংবাদ মাধ্যমে খবর হতেই হুলস্থূল পড়ে যায় চিকিৎসা মহলে। তড়িঘড়ি ডায়ালিসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এসএসকেএম। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এমন কার অঙ্গলুহেলনে কুকুরের ডায়ালিস করতে পর্যন্ত বাধ্য হয় এসএসকেএম? ধোঁয়াশা ভরা যুক্তি ছিল হাসপাতালের। কেউ বলেছেন, কুকুরের ডায়ালিসের স্লিপ দেখে স্তম্ভিত। আবার কেউ বলেন, “হয়েছেটা কী! মানুষ ও কুকুর উভয়েই স্তন্যপায়ী।” এ বিষয়ে তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজির যুক্তি ছিল, “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

এবার, সেই বছরের অক্টোবর। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। ২০১৪ সালে ১২ ডিসেম্বর সিবিআই গ্রেফতার করে ক্রীড়া এবং পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে। দেখা গিয়েছে, তারপর থেকে খাতায় কলমে ৩২৫ দিন সিবিআই বা জেল হেফাজতে থাকলেও অধিকাংশ সময়টা কাটিয়েছেন উডবার্ন ওয়ার্ডে। কিন্তু যে দিন (২০১৫, ৩১ অক্টোবর, শনিবার) জেল হেফাজত থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন, তার পরক্ষণেই (১ নভেম্বর, রবিবার) এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ছুটি মেলে মদনের। কোন ‘জাদুবলে’ রাতারাতি ফিট হয়ে গেলেন মদন, তার সদুত্তর ছিল না চিকিৎসা বিজ্ঞানে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, যদি এ দিন জামিন না পেতেন, তাহলে কি মদনকে পরের দিন ‘ফিট’ ঘোষণা করা হত? নাকি জেলের ভাত খাওয়া এড়াতেই এতদিন ‘সেফ হোমের’ আশ্রয় দিয়েছিল এসএসকেএম?

মদনের দ্বিতীয়বার কারাবাস যাপন। কলকাতা হাইকোর্টে মদনের জামিন খারিজ হয়ে যাওয়ায় ১৯ নভেম্বর ফের সিবিআই তাঁকে গ্রেফতার করে। তার কিছুদিন পর বুকে ব্যথা নিয়ে এসএসকেএম-এ ভর্তি হন মদন। উডবার্ন কার্যত দ্বিতীয় ঘর হয়ে উঠেছিল মদনের। এরপর ক্রীড়া-পরিবহণ দফতর হাতছাড়া হয় মদনের। রাজ্য সরকারের এবং দলের সব রকম পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সবরকম প্রভাবশালী তকমা সরিয়ে ’১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জামিন পান মদন মিত্র।

২০২১ সালে নারদ কাণ্ডে ৪ ওজনদার তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে সিবিআই। জেল হেফজতে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন শোভন চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং মদন মিত্র। তড়িঘড়ি ভর্তি করানো হয় এসএসকেএম-এ। যদিও জ্বর থাকা সত্ত্বেও এসএসকেএম-এ যাননি ববি হাকিম। তিনি জানিয়েছিলেন, জেলেই চিকিৎসা করাতে চান। সে সময় জেল হেফাজতের অনেকটা সময় এসএসকেএম-এ কাটিয়েছিলেন তৃণমূলের ৩ হেভিওয়েট নেতা।

মদনের যদি এসএসকেএম পছন্দের হাসপাতাল হয়, বীরভূমের একদা দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলও কম যান কীসে! সুদূর লাল মাটির জেলা থেকে নিজাম প্যালেসে হাজিরা দিতে এসে ‘পথ ভুলে’ এসএসকেএম-এ ঢুঁ মেরে যান অনুব্রত। আর তৎক্ষণাৎ ভর্তিও হয়ে যান তিনি। গরু পাচার মামলায় গত বছর থেকে লাগাতার অনুব্রত মণ্ডলকে তলব করেছে সিবিআই। একের পর এক হাজিরা এড়িয়েছেন। আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল যখন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন, অনুব্রত মণ্ডল কার্যত রাস্তা ‘ভুলে’ সোজা এসএসকেএম-এ চলে আসেন। আর আসতেই সঙ্গে সঙ্গে ভর্তিও হয়ে যান তিনি। যেখানে সাধারণ রোগীর এসএসকেএম-এ বেড পেতে মাসাধিকাল সময় লেগে যায়, একাধিক হাসপাতাল ঘুরে আসা এমার্জেন্সি রোগীকে বেড নেই বলে মুখের উপর ফিরিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কীভাবে ‘এক পলকের একটু দেখায়’ উডবার্নের বেডে পেয়ে যান অনুব্রত! 

এসএসকেএম আরও একবার খবরের শিরোনামে আসে পার্থ চট্টোপাধ্যায়-পর্বে। এসএসসি মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই দফতরে হাজিরা নির্দেশ দেওয়ার সময় আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এসএসকেএম-এর উডবার্নে যেন ভর্তি না হন তিনি। সম্প্রতি একাধিক শাসক দলের নেতার এসএসকেএম ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হওয়ার অভিযোগ ওঠায় আদালতের এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এমনকী পার্থর গ্রেফতারির পর এসএসকেএম-এ ভর্তি হয়েও তিনি ফিট আছেন কিনা, তার শংসাপত্র নিতে ভুবনেশ্বর এইমসে পাঠায় আদালত। এই সময় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিবেক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এসএসকেএম প্রতিটি প্রভাবশালীর জন্য নিরাপদ জায়গা।’

শুধু পার্থ, মদন কিংবা অনুব্রত নন, যখনই শাসক দলের নেতাদের গ্রেফতার হতে দেখা গিয়েছে এসএসকেএম-এ চরণধূলি দিয়েছেন তাঁরা। বাদ পড়েননি ভাঙড়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা আরাবুল ইসলাম কিংবা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ছত্রধর মাহাত। সাম্প্রতিক সংযোজন রেশন দুর্নীতিতে ধৃত প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ‘কালীঘাটের কাকু’ না শাসক দলের মন্ত্রী-বিধায়ক, না কাউন্সিলর। তবে তদন্তকারীদের অনুমান, তিনি হচ্ছেন শিক্ষা দুর্নীতির তদন্তে অন্যতম ‘লিঙ্কম্যান’, তাঁকে ধরেই মাথার খোঁজ মিলতে পারে। আর সেখানেই এসএসকেএম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। কাকুর স্বর নমুনা সংগ্রহে বিলম্ব হওয়ায় তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে মহম্মদ সেলিম, সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ, কাকুর স্বর বদল করতেই এসএসকেএম-এ ভর্তি। স্বর বদল হয়ে গেলেই ইডির হাতে থাকা অডিয়োর সঙ্গে কাকুর কণ্ঠস্বরের মিল না-ও হতে পারে। 

তাহলে এসএসকেএম-এ হচ্ছেটা কী? ব্রহ্মা জানেন, গোপন কম্মটি।