Mughal Food Recipe Part VIII: খানা খানদানি-পর্ব ১৬, বিরিয়ানি নয়, ঝক্কি সামলে যদি রাঁধতে পারেন, যা তৈয়ার হবে তেমন খানা আপনি জীবনে খাননি

TV9 Bangla Digital | Edited By: দীপ্তা দাস

Dec 19, 2021 | 7:47 AM

ঘাবড়াবেন না। নীচে আমি যে উপকরণ যত পরিমাণ দিলাম সেগুলি হুবহু সেই মাপে নিয়ে, রান্নার প্রতিটা ধাপ একের পর এক যেমনটি দেওয়া আছে করতে থাকুন। নিশ্চিন্ত থাকুন, যে খানা তৈয়ার হবে তেমন পোলাও আপনি আগে খাননি—   

Mughal Food Recipe Part VIII: খানা খানদানি-পর্ব ১৬, বিরিয়ানি নয়, ঝক্কি সামলে যদি রাঁধতে পারেন, যা তৈয়ার হবে তেমন খানা আপনি জীবনে খাননি

Follow Us

নীলাঞ্জন হাজরা 

পোলাও নিয়ে বেশ কয়েক খণ্ডের কেতাবই লিখে ফেলা যায়, কিন্তু যেহেতু এ রান্না সত্যিই এক প্রজেক্ট, আজ কিস্সার পালা শেষ করে রান্না শুরু করি। প্রথমে ফারসি থেকে তরজমা করা মূল রেসিপি। যেটা পড়লে মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে সব একাকার হবার আশঙ্কা। কাজেই তার একটা আধুনিক ভার্শন আমি একেবারে প্রজেক্টের মতই ধাপে ধাপে দিয়ে দিলাম।

মূল রেসিপিটা এ রকম—

‘‘নারঙ্গি পুলাও

(নুসখা-ই-শাহ জাহানি। পৃ ৪১)

উপকরণ

মাংস—১ সের (৮৪৯.৬ গ্রাম)

চাল—১ সের (৮৪৯.৬ গ্রাম)

ঘি—১/২ সের (৪১৯.৮ গ্রাম)

আখের চিনি—৩ পোয়া (৬২৯.৭০ গ্রাম)

কমলা লেবু—৪টি

দারুচিনি—২ মাশা (২ গ্রাম)

ছোটো এলাচ—২ মাশা (২ গ্রাম)

লবঙ্গ—২ মাশা (২গ্রাম)

পেঁয়াজ—এক পোয়া (২০৯.৯ গ্রাম)

আদা—এক পোয়া (২০৯.৯ গ্রাম)

ধনে—১ দাম (২০ গ্রাম)

শা জিরা—এক দমড়ি (২. ৪৭ গ্রাম)

টক দই—১/২ পোয়া (১০৪.৯৫ গ্রাম)

পাতি লেবু—১/২ সের (৪১৯.৮ গ্রাম)

নুন—১ দাম (২০ গ্রাম)

(মূলে ওজন শাহ জাহানি শের হিসেবে বলা আছে ধরে নিয়ে আমি মেট্রিক পরিমাণ দিয়ে দিলাম।)

প্রকরণ

প্রথমে কমলার কোয়া পরিষ্কার করে নিন। নুন দিন। এরপর ছুরির ডগা দিয়ে এদের গায়ে দাগ-দাগ করে দিন। দইয়ে ফেলুন। দু’ঘড়ি পরে পরিষ্কার জলে ফুটিয়ে নিন। জল বার করে দিন। অন্য জলে টক লেবু সিদ্ধ করুন। এই জল বার করে নিন। এরপর অন্য জলে দুই দাম চিনির রস ও একটা লেবু ফেলে দিন। খুব ভাল করে ফুটান। এর পরে এর মধ্যে থেকে এক পোয়া চিনির রস নিয়ে আঙুল দিয়ে গুলে নিন। কমলার ছাল গলিয়ে নিন। রেখে দিন। মাংসটাকে নুন আর আদা আর ঘি আর ধনে দিয়ে ঝোল (ইয়াখনি) করে নিন। সেই ঝোল একটা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন। লবঙ্গ দিয়ে ফুটিয়ে নিন। তার মধ্যে আধ কিলো রস, উপরোক্ত কমলা, বাকি লেবুর রস মিশিয়ে দিন। ফুটিয়ে নিন। চাল আধ সিদ্ধ করে নিন এবং এই ঝোলের মধ্য দিয়ে দিন। এবং ডেগচির নীচে মাংস বিছিয়ে দিন। মশলা দিন। এক হাতা রস দিন। আঁচে বসান যাতে রস মাংসের গায়ে শুকিয়ে যায়। এবং সিদ্ধ ভাত রেখে এক ঘড়ির একের চার ভাগ আঁচে রেখে দম দিন। ওপর থেকে ঘি ছড়িয়ে উপরোক্ত লেবু ও মাংস ওপরে রেখে পরিবেশন করুন।’’

মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে তো? ঘাবড়াবেন না। নীচে আমি যে উপকরণ যত পরিমাণ দিলাম সেগুলি হুবহু সেই মাপে নিয়ে, রান্নার প্রতিটা ধাপ একের পর এক যেমনটি দেওয়া আছে করতে থাকুন। নিশ্চিন্ত থাকুন, যে খানা তৈয়ার হবে তেমন পোলাও আপনি আগে খাননি—

উপকরণ (চার জনের জন্য)

রেয়াজি খাসির মাংস (একদম চর্বি ছাড়া। হাড় ছাড়া। ১ ইঞ্চি টুকরো করে কাটা)—৮০০ গ্রাম

চাল (বাসমতি)—৫০০ গ্রাম

ঘি—২০০ গ্রাম

আখের চিনি—২০০ গ্রাম

কমলা লেবু (মিষ্টি হওয়া জরুরি)—৪টি

দারুচিনি (গুঁড়ো)—২ গ্রাম

ছোট এলাচ (ছাড়িয়ে গুঁড়ো করা)—২ গ্রাম

লবঙ্গ (গোটা)—২গ্রাম

পেঁয়াজ (বাটা)—২০০ গ্রাম

আদা (বাটা)—১০০ গ্রাম

ধনে (গুড়োঁ)—২০ গ্রাম

শা জিরা (বাটা)—৫ গ্রাম

টক দই—১২৫ গ্রাম

পাতি লেবু—৭টি

নুন—স্বাদ মতো

প্রকরণ

১। ৫০০ গ্রাম চাল আধ-সিদ্ধ করতে কতটা জল লাগবে, ঠিক করুন। সেই জল দু’টো পাত্রে সমান ভাগে ভাগ করে রেখে দিন। (এখন চাল দেবেন না, অন্তত তিন বার ভাল করে ধুয়ে রেখে দিন)

২। কমলার কোয়া শিরা ছাড়িয়ে একেবারে পরিষ্কার করে নিন। খোসা ফেলবেন না, টুকরো করে কেটে রেখে দিন। এরপর ছুরির ডগা দিয়ে কোয়াগুলোর গায়ে সাবধানে হাল্কা দাগ দাগ করে দিন। নুন মাখান। দই মাখান। রেখে দিন। আধ ঘণ্টা পরে পরিষ্কার জলে দই ধুয়ে ফেলুন। চাল সিদ্ধর জন্য রাখা জলের দু’ভাগের একটিতে কমলার সব কোয়া ফুটিয়ে নিন। কোয়া যেন গলে না যায়, বেশ শক্ত থাকে। জল বার করে রেখে দিন। কোয়াগুলিও সাবধানে তুলে রেখে দিন।

২। চাল সিদ্ধর জন্য রাখা দ্বিতীয় ভাগ জলে ছ’টি পাতি লেবু সিদ্ধ করুন। এই জল বার করে রেখে দিন। লেবুগুলো ফেলে দিন।

৩। একটা পাত্রে কমলা লেবু ফোটান জল ও লেবুর জল মিশিয়ে নিন। তার মধ্যে চাল ফেলে দিন। অল্প নুন দিন। আঁচে চড়িয়ে আধসিদ্ধ করে ফ্যান গেলে নিন খুব ভাল করে। আধসিদ্ধ ভাত রেখে দিন।

৪। একটা পাত্রে ৩০০ মি.লি জলে ৫০ গ্রাম চিনি ও একটা পাতি লেবু ফেলে দিন। খুব ভাল করে ফোটান। আঁচ থেকে তুলে লেবু সুদ্ধু ঢাকা দিয়ে রেখে দিন।

৫। একটা পাত্রে ৫০০ মি.লি জলে ১৫০ গ্রাম চিনি দিন। আঙুল দিয়ে গুলে নিন। রসে কমলার ছালের টুকরো দিয়ে নরম না হওয়া পর্যন্ত ভাল করে ফোটান। বেশ গাঢ় রস হলে, কমলার ছাল তুলে ফেলে রসটা রেখে দিন।

৬। মাংসটাকে পেঁয়াজ, আদা দিয়ে ১৫০ গ্রাম ঘিতে ভেজে, নুন, জিরে আর ধনে দিয়ে আরও খুব ভাল করে ভাজুন। প্রথমে ৫০ গ্রাম চিনি আর একটা লেবু ফুটিয়ে যে জল তৈরি করা আছে, সেই জলটা ঢালুন লেবুটা ফেলে দিয়ে। ঢাকা দিয়ে ফোটান। একটু পরে পরিষ্কার সাদা জল মিশিয়ে আরও ফুটিয়ে মাংস নরম করে নিন। যেন বেশ খানিকটা তরল ঝোল (ইয়াখনি) থাকে।

৭। সেই ইয়াখনি একটা কাপড় দিয়ে (খুব সরু ছাঁকনি হলেও চলবে, যেন একটুও মশলা বাটা না গলতে পারে) ছেঁকে নিন। পেঁয়াজ বাটা-সহ যে মশলা জমবে কাপড়ে, সেটা ফেলে দিন।

৮। মাংসের টুকরোগুলো বেছে-বেছে একটা পাত্রে তুলে রাখুন। মাংসের গায়ে যেন কোনও মশলা বাটা না লেগে থাকে।

৯। ছাঁকা ইয়াখনি লবঙ্গ দিয়ে আর তুলে রাখা কমলার কোয়া দিয়ে ফুটিয়ে নিন। ভাল মতো ফুটে গেলে, চেখে দেখুন। দরকার হলে আর একটু নুন দিয়ে ফোটান অল্প। ইয়াখনি আর একবার ছাঁকুন। লবঙ্গগুলো ফেলে দিন। কমলার কোয়া সাবধানে তুলে রাখুন।

১০। আলাদা করা মাংস একটা পাত্রে নিন। কমলার ছাল দিয়ে ফোটান যে রস রাখা আছে, তা এক হাতা নিয়ে ছড়িয়ে দিন। হাল্কা আঁচে গরম করে রস শুকিয়ে নিন।

১১। একটা বড় ডেগচিতে ভাল করে ঘি মাখান। ডেগচির নীচে হাল্কা এক পরত আধসিদ্ধ ভাত বিছিয়ে দিন। মশলা (দারুচিনি গুঁড়ো, এলাচ গুঁড়ো) একটু করে, নুন একটু, ফোঁটা ফোঁটা ঘি ছড়িয়ে দিন।

১২। আধ সিদ্ধ ভাতের ওপর সব মাংস এক পরতে বিছিয়ে দিন দিন।

১৩। বাকি ভাত এক পরতে ছড়িয়ে, ফের মশলা (দারুচিনি, এলাচ) একটু করে, নুন একটু, ফোঁটা-ফোঁটা ঘি ছড়িয়ে দিন।

১৪। ওপরে বিছানো ভাতের ওপর থেকে রেখে দেওয়া ইয়াখনি সমান ভাবে ততটাই ছড়ান যাতে আধসিদ্ধ চাল, মাংস সব রসা-রসা হয়ে থাকে (ডুবু ডুবু নয়)। ইয়াখনি বেশি হলে রেখে দিন পোলাওয়ের সঙ্গে চামচ দিয়ে খাওয়া যাবে।

১৫। সব কমলার কোয়া ওপর থেকে এক পরতে বিছিয়ে দিন।

১৬। দশ মিনিট ডেগচির ঢাকা টাইট করে দম দিন (আটা দিয়ে আঁটার দরকার নেই)। ঢাকা খুলে চামচ ঢুকিয়ে তলা থেকে ভাত তুলে দেখুন সিদ্ধ হয়েছে কিনা। এবং ইয়াখনি একদম টেনে নিয়েছে কিনা। ইয়াখনি শুকিয়ে গিয়ে ভাত অসিদ্ধ থাকলে, বাকি ইয়াখনি থেকে আন্দাজ মত ফের ছড়িয়ে দিন। অল্প দম দিন। মোট কথা, যখন নামাবেন চাল সিদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু একেবারে ঝরঝরে থাকবে, কোনও ঝোল থাকবে না। গলা-গলা যেন কিছুতেই না হয়।

১৭। আঁচ থেকে নামিয়ে অন্তত ১০ মিনিট ঢাকা খুলবেন না।

১৮। কমলা লেবু ও মাংস ভাতের ওপরে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

এর পরেও আরও একটু আছে— যাকে বলে উপসংহার। ইরানে পোলাও খেলে খাস খাদ্যরসিক একটা জিনিসের খোঁজ করবেন— তহে-দেগ। ইরানি বাড়িতে খেলে, মুসাফির হিসেবে আপনাকে সবার আগে সেটি দেওয়া হবে, কারণ আপনি মুসাফির। বলতে দ্বিধা নেই মুসলমান সংস্কৃতিতে — ভারতে, বাংলাদেশে, তুরস্কে, ইরানে, পাকিস্তানে — যে অতিথিপরায়ণতা দেখেছি, তার তুলনা আর কোনও সংস্কৃতিতে আমার চোখে পড়েনি। অতিথিকে নিয়ে কী করা হলে যথেষ্ট আতিথেয়তা হবে মুসলমান গৃহস্থ যেন ভেবে তার কুল পান না। এমনটাই আমার অভিজ্ঞতা। কী এই ‘তহে-দেগ’ বা ‘তহে দিগ’? হুবহু তরজমা করলে — ডেগচির তলা। তহ-এ-দেগ। ‘তহ’ তলা, ‘দেগ’ ডেগচি। ব্যাপারটা কী? খেয়াল করুন, ১১ নম্বর ধাপ— ডেগচির নিচে হাল্কা এক পরত ভাত ছড়িয়ে দিতে বলা আছে। জাত পোলাও-বাওর্চি ডেগচিতে সব কিছু দিয়ে ডেগচির ঢাকনা এঁটে ঠিক ততক্ষণ দম দেবেন যাতে সব ইয়াখনি শুষে চাল গন্ধে ম-ম হয়ে উঠেও ভাত থাকবে একদম ঝরঝরে। কিন্তু পুরোটা নয়। ওই যে একদম নিচের ভাতের পরত, যেখানে এসে জমা হবে ডেগচির সমস্ত রস, সেই পরতটা হবে, আমাদের মায়েদের মুখে যাকে বলতে শুনেছি ‘ধরা ধরা’, ঠিক পোড়া শুরু হওয়ার আগের অবস্থা, এক চুল পোড়া গন্ধ নেই। লালচে। সে স্বাদ স্বর্গীয়। দেখুন আপনার পোলাও সেই ব্রহ্ম-মুহূর্তে আঁচ থেকে নামিয়ে ‘তহে-দিগ’ আস্বাদন করতে পারেন কিনা!

আরও পড়ুন- Mughal Food Recipe Part VII: খানা খানদানি-পর্ব ১৫, বিরিয়ানি নয়, হিন্দের শাহি পাকোয়ানের আসল কামাল পোলাও

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার। এই মাসে ৫টি সপ্তাহ।
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস
Next Article