Mughal Food Recipe Part VII: খানা খানদানি-পর্ব ১৫, বিরিয়ানি নয়, হিন্দের শাহি পাকোয়ানের আসল কামাল পোলাও

পোলাওয়ের ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে আধা সত্য আধা মিথ্যেয় মাখামাখি গালগপ্পো মিলবে ভূরি-ভূরি।

Mughal Food Recipe Part VII: খানা খানদানি-পর্ব ১৫, বিরিয়ানি নয়, হিন্দের শাহি পাকোয়ানের আসল কামাল পোলাও
নারঙ্গি পুলাও।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 18, 2021 | 8:37 AM
নীলাঞ্জন হাজরা 
মাসিডোনের মদ্যপ যুদ্ধবাজ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডার ৩২৭ পূর্বসাধারণাব্দে মারকন্ড বা বর্তমান সামারকন্দ রাজ্যের রাজধানী সোগদিয়ান জয় করার পর শুধু যে স্থানীয় উজির ওখশারদের কন্যা রোক্সানার রূপে হকচকিয়ে গিয়ে তাঁকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাই-ই নয়, সেই উপলক্ষে তাঁকে ‘প্লোভ’ নামের যে খানা খাওয়ানো হয়েছিল, তার স্বাদে ভ্যাবাচাকা খেয়ে হুকুম করেছিলেন সে খাবারের রেসিপিটিও যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খে টুকে নেওয়া হয়। সেই থেকেই নাকি আমরা বাঙালিরা যে খানাকে ‘পোলাও’ নামে জানি, তার পশ্চিম পাড়ি শুরু।
আবার একাদশ শতকের গোড়ায় কোনও এক সময়ে বুখারার কোনও এক সুলতানের পুত্র কঠিন এক রোগ বাধালেন। চোখে ঘুম নেই, মুখে হাসি নেই, পেটে খাদ্য নেই। কাউকে কিছুই বলেন না, কেবল দিনে-দিনে যেন ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। হাজার হাকিম এসে ফিরে গেল। কিছুতেই কিছু হয় না। শেষে সুলতান পারস্য থেকে তলব করলেন কিংবদন্তি চিকিৎসক ইব্ন সিনা-কে (৯৮০–১০৩৭)। জনাব কিছু করুন। ইব্ন বললেন, করব, কিন্তু রাজপুত্রের সঙ্গে আমাকে একা ছেড়ে দিতে হবে। দরজা বন্ধ হল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায়, দরজা আর খোলেই না। সুলতান পা টিপে-টিপে কান পাতলেন দরজায়, কেবল অস্পষ্ট ফিসফিস—চলেছে তো চলেছেই। শেষে দরজা খুলল। ইব্ন সিনার মুখ প্রসন্ন। চলুন জাহাঁপনা, কথা আছে। খাস কামরায় কথা হল। দেখুন, আপনার পুত্রকে বাঁচানর দু’টি মাত্র উপায়। বেচারা প্রেমে পড়েছে। মুশকিল হল, মেয়েটি অতি দরিদ্র পরিবারের। রাজপুত্র নিশ্চিত এ প্রেমের পরিণয় অসম্ভব। কাজেই সে-ও আর এ দুনিয়ায় বাঁচতে চায় না। অসম্ভবই তো, গর্জে উঠলেন সুলতান। এই তখ্ত যে দখল করবে আমার পরে, তার পাশে বসবে এক ছোটলোকের মেয়ে? নামুমকিন। দ্বিতীয় পথ বাতলান। এবার ইব্ন তাঁর ঝুলি থেকে এক লম্বা কাগজের টুকরো বার করলেন। জাহাঁপনা, এতে এক অতি বিশেষ খানার রেসিপি লেখা আছে, যা আস্বাদন মাত্র প্রেমের ক্ষতের মত সাংঘাতিক ক্ষতও নিমেষে জুড়িয়ে যায়। সুলতান ছিনিয়ে নিলেন সে কাগজের টুকরো— কী এ খানার নাম। জাহাঁপনা ‘পালোভ’। ইব্ন সিনার কেতাবেই নাকি পোলাওয়ের প্রথম নথিবদ্ধ রেসিপি পাওয়া যায়।
পোলাওয়ের ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে আধা সত্য আধা মিথ্যেয় মাখামাখি এমন গালগপ্পো মিলবে ভূরি-ভূরি। কিন্তু এ সব গপ্পের সারাৎসারটা, আমার মতে সত্যি— সুরন্ধিত পোলাওয়ের সঙ্গে চাল ফুটিয়ে তৈরি আর কোনও খাবারের তুলনা চলতে পারে না। পোলাও রাঁধা হয় না, সৃষ্টি হয়। যেটা দুনিয়ার সামান্য কিছু খাবারের বিষয়েই বলা যেতে পারে—‘ফাইন ডাইনিং পদ’। এখানে বলে রাখতেই হবে, বিরিয়ানি এই উপমহাদেশের আনাচ-কানাচ, এবং খিচুড়ি এই উপমহাদেশ উপচে ব্রিটিশ রাজ-হেঁশেল, হোয়াইট হাউস অন্তত সাময়িক ভাবে, এবং সুদূর কায়রোর রাস্তা বেশ পাকাপাকি ভাবে দখল করে নিতে পারলেও, খানা-অশ্বমেধের নিরিখে পোলাওয়ের ধারে কাছে আর কোনও ‘ফাইন ডাইনিং’ খানা নেই।
‘Fine dining’ কথাটার, বা ফরাসিতে ‘haute cuisine’ কিংবা ফারসিতে ‘নি’মত’ বলতে যা বোঝায় তার কোনও বাংলা প্রতিশব্দ আমার মনে পড়ছে না। বাঙালির হেঁশেলে অতি সুস্বাদু খাবারের কোনও অভাব নেই, কিন্তু একমাত্র বেশ কিছু মিষ্টি ছাড়া তার কোনওটিকেই ওই তিন শব্দের বিশেষণ দেওয়া মুশকিল।
শুধু বাঙালি নয়, ধরা যাক গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন, এমনকী ফ্রান্স, স্পেন আর ইতালি ছাড়া আর কোনও পাশ্চাত্য দেশেরই কোনও ‘ওত কুজ়িন’ নেই। জার্মানরা কিছুটা চেষ্টা করেছেন। নেই বলেই ব্রিটিশ বা রুশ সাম্রাজ্যের সব বাঘা-বাঘা রাজা-রানির হেঁশেলে পাকানো খানার নব্বই ভাগ ফরাসি ছাঁচের। ফাইন ডাইনিংয়ে যে খানা পরিবেশিত হবে তা রাঁধা যত ঝক্কি, তার প্রকৃত আস্বাদন ততটাই সংবেদশীল খাদ্যরুচি দাবি করে। তা খেয়ে কখনও পেট আইঢাই করে না, তাতে দেওয়া কোনও মশলা এক গরসেও নিজের ঢাক পেটাবে না, তা খেতে কোনও পরিশ্রম হবে না—প্রাণপণে চিবোতে হবে না, গলা শুকিয়ে আসবে না, অন্য কিচ্ছু দিয়ে তাকে মাখতে হবে না। তার প্রভাব জিভ থেকে নাকের ওপর কোনও অংশে কম হবে না, কোনও অংশে বেশিও না। তাতে কোনও উত্তেজনা নেই, এক পরম সন্তোষ-বোধ আছে। কিন্তু সাবধানে জিহ্বা নাসিকায় পরখ করলে বোঝা যাবে তার স্বাদ ও গন্ধ সরল নয়, সেরা সেতারিয়ার হাতের মীড়ের মত জটিল, কিন্তু সাবলীল।
এ হেন ফাইন ডাইনিংয়ের আসল হেঁশেল প্রাচ্যে। মোটামুটি চারটি—বাগদাদের আব্বাসি খিলাফতের হেঁশেল, যার সময়কাল মোটামুটি অষ্টম থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত। তুরস্কের ওসমানিয়ে (অটোমান) সাম্রাজ্যের হেঁশেল, যা জাঁকিয়ে বসেছিল চতুর্দশ শতকের একেবারে শুরু থেকে বিংশ শতকের গোড়া অবধি। পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের হেঁশেল, ষোড়শ সতকের শুরু থেকে অষ্টাদশকের মাঝামাঝি অবধি যার দাপট। এবং মুঘল সাম্রাজ্যের হেঁশেল, ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে উনবিংশ শতকের গোড় পর্যন্ত যা ছিল হরেক খাদ্যধারার পরমাশ্চর্য পরীক্ষাগার।
আর একটা সাম্রাজ্যেও ফাইন ডাইনিং ছিল—চিন। মিং বংশ এবং কিং বংশের হেঁশেলে। প্রথমটি কায়েম ছিল চতুর্দশ শতকের মাঝ থেকে শপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি, দ্বিতীয়টি সপ্তদশ শতকের মাঝ থেকে বিংশ শতকের গোড়া অবধি। কিন্তু চিনা রাজন্যের সেই সব খাস খানার কিছুই আমি কখনও খাইনি, রান্না তো দূরস্ত্। বেইজিংয়ের হাতে গোনা কয়েকটি রেস্তোরাঁয় যা আজও পাওয়া যায়, সেই ‘পিকিং ডাক’ চাখার পরম সৌভাগ্য আমার হয়নি।
কেউ কেউ হাঁ-হাঁ করে উঠতে পারেন, আরে মশাই প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য ভুলে গেলেন? খানা-পিনা-সঙ্গম-যুদ্ধ ছিল যে সাম্রাজ্য ধরে রাখা চারটি পিলার? আপিকিউস? না ভুলিনি। এই সিরিজেই তো আপিকিউসীয় খানা রেঁধে দেখেছি। উপাদেয়। কিন্তু সে সব ‘ওত কুজিন’ নয়। সে রান্নার সঙ্গে আসলে পাশ্চাত্যের একাংশের ইতিহাসকারের লেখায় পড়া বা ‘হিস্ট্রি চ্যানেল’, ‘নেটফ্লিক্স’ ইত্যাদির সিরিয়ালে দেখা এক রকমের সাংস্কৃতিক জাঁক জমকের মন-ধাঁধানো জৌলুস এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে আমরা সে সময়ের খাবার বিচারের সময়েও তা ভুলতে পারি না। কিন্তু আসলে রোম সাম্রাজ্যের অধিকাংশ খাবার খুব মৌলিক। সরল।
খাস পোলাও তার ঠিক উল্টো। অ্যালান ডেভিডসনের Oxford Companion to Food পোলাও-কে বর্ণনা করছে ‘complex dishes of spiced rice’ বলে। আজ আর কাল আমরা যে খানাটি রাঁধব, শাহ জাহানের হেঁশেলের ‘নারঙ্গি পুলাও’, কমলা লেবুর পোলাও, তাকে রীতিমত একটা প্রজেক্ট বলা যেতে পারে। কিন্তু একেবারেই মধ্যবিত্ত হেঁশেলে তা রেঁধে ফেলা সম্ভব—একটু ধৈর্য্য থাকলে। প্রশ্ন হল, এ খানা এল কোথা থেকে? কঠিন প্রশ্ন। কঠিন এই কারণেই যে, পোলাও নামে আমরা যে খাবারটি জানি তার অজস্র রকম ফের মেলে সারা দুনিয়া জুড়ে—পারস্যে পুলও বা পোলো, গোটা মধ্য এশিয়া জুড়ে প্লোভ বা পলও, তুরস্কে পিলাও, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অধিকাংশ পশ্চিমি দেশে পিলাফ, ক্যারিবিয়ান দেশগুলিতে পেলাউ আর আফগানিস্তান-সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় পুলাও। মুশকিল হল এ রান্না যে কোথায় প্রথম শুরু হয় তার কোনও প্রামাণ্য নথি নেই।
কাজেই আন্দাজ করা যেতে পারে যে নামেই ডাকা হোক, এ খানার কত রকম ফের সম্ভব। শাহ জাহানের পাতেই পড়ত ৫৪ কিসিমের পোলাও, নুসখা-ই-শাহজাহানিতে যার প্রত্যেকটির রেসিপি রয়েছে।
চার্লস পেরি এ সময়ের অন্যতম শ্রদ্ধেয় খাদ্য-ইতিহাসকার। আশ্চর্য মানুষ। ‘কাবাব কিস্সা’ বইটি লেখার সময় ইন্টারনেট থেকে খুঁজে পেতে তাঁর ইমেল আইডি বার করে ‘কাবাব’ শব্দটার উৎস নিয়ে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে ছিলাম। পরের দিনই দেখি আমার ইনবক্সে লম্বা-লম্বা খান তিনেক মেল। তার শেষটিতে লেখা—শোনো, ব্যাপারটা জটিল। ইমেলে বোঝানো যাবে না। নবম-দশম শতকের বাগদাদের একটা কুকবুক আছে, ‘কিতাব অল তবিখ’, আমি সেটা আরবি থেকে তরজমা করেছি, সেইটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি বরং সেটা পড়ে দেখ। নিজের হাতে সই করে দেওয়া সে বই আমার কুকবুক সংগ্রহের রত্ন।
এই চার্লস পেরি লস এঞ্জেলেস টাইম্সে ‘পিলাফ’ (মার্কিনিরা তাই বলেন) নিয়ে এক লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন—যার মূল কথা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পোলাও মোটামুটি পাঁচ ঘরানার—সিল্ক রোড বা রেশমপথের পোলাও, পারসিক পোলাও, হিন্দুস্তানি পোলাও, তুরস্কের পোলাও এবং ক্যারিবিয়ান পোলাও। মার্কিনি ‘পিলাফ’ ব্যাপারটাকে উনি গোড়াতেই মাছি তাড়ানোর তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়েছেন। সে রান্না দেখলে, লিখেছেন পেরি সাহেব, দুনিয়ার জাত পোলাও-পাচকরা ‘শক্ড’ হবেন!
জাত পোলাও পাচকরা তবে যে-পোলাও পাকান কী তার কয়েকটি অপরিহার্য চিহ্ন?
দুরন্ত বর্ণনা পেরির, বাংলা তরজমায়, ‘‘এ হল ভাত, যা আসলে চালের এক একটি স্বাধীন দানার অতি পলকা স্তূপ, যে দানাগুলির প্রত্যেকটি সেই সব সামগ্রীর গন্ধে ম-ম, যেগুলি দিয়ে সেই ভাত রাঁধা।’’ সহজ ভাষায়—পোলাও হতেই হবে এমন ঝরঝরে যাতে ভাতের প্রতিটা দানা আলাদা থাকে। আর সেই ভাত হতে হবে সমান ভাবে সুবাসিত, খাবলা-খাবলা গন্ধের দলা নয়।
এই ঝরঝরে ভাবটা কী ভাবে সুনিশ্চিত করা যায়। পেরি বলছেন, জাত পোলাও-পাচকরা চাল বারবার জলে ধুয়ে নেন, এমনকী প্রয়োজনে সারা রাত ভিজিয়েও রাখেন। লক্ষ্য হল চালের দানাগুলো থেকে মাড়ের শেষ ছাপটুকু পর্যন্ত তুলে দেওয়া।
আর গন্ধ কী ভাবে পুরে দেওয়া যায় প্রতিটি চালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেটা বোঝা যাবে শাহজাহানের কুকবুক নুসখা-ই-শাহজাহানি থেকে আমাদের বেছে নেওয়া ‘নারঙ্গি পুলাও’ রান্নার সময়।

আরও পড়ুন- Mughal Food Recipe Part VI: খানা খানদানি-পর্ব ১৪, কিস্সা কাহিনি মোড়া কোফতা আর দোপেঁয়াজির টানাপোড়েনের রান্না

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার। এই মাসে ৫টি সপ্তাহ।
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস