In Depth-Prithvi Shaw: কাম্বলি হবেন নাকি শেন ওয়ার্ন? নতুন পথ বাছতে হবে পৃথ্বীকে
Prithvi Shaw's Rise and Fall: দুই ক্রিকেটারকে এনসিএ-তে দ্রাবিড়ের কাছেই পাঠানো হয়েছিল। টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই 'ক্লাস'। সেটা ক্রিকেটীয় দিক থেকেই শুধু নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও। শ্রেয়স আইয়ার, অজিঙ্ক রাহানে, চেতেশ্বর পূজারার মতো ক্রিকেটাররা যখনই টেকনিকের দিক থেকে সমস্যয় পড়তেন, ঠিকানা ছিল একটাই।
নেক্সট বিগ থিং। ভারতীয় ক্রিকেটে অতি পরিচিত শব্দ। নতুন কেউ উঠে এলেই তাঁর সঙ্গে কিংবদন্তিদের তুলনা শুরু। প্রোজেক্ট ‘বিগ থিং’। কিন্তু প্রতি প্রজন্মে বিগ থিং একজনই হয়। সে সুনীল গাভাসকর হোক বা সচিন তেন্ডুলকর। কিংবা পরবর্তীতে বিরাট কোহলি। তাঁদের আসাটা যেমন জাঁকজমক পূর্ণ, তেমন সাময়িক পতনও। কিন্তু হার মানেননি, ফোকাস সরলেও দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, ক্রিকেটের বেসিকে মনোসংযোগ করেছেন। শূন্য থেকে শুরু করেছেন আবার। এ সবই তো কিংবদন্তি করেছে তাঁদের। একটা সময় ভারতীয় ক্রিকেটে নেক্সট বিগ থিংয়ের তকমা জুটেছিল পৃথ্বী শ-রও। হবে নাই বা কেন? জুনিয়র স্তরে এমন সব কারনামা করছিলেন, তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছিল কিংবদন্তি সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে। পরবর্তী সচিন পাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট, কিন্তু পেল কী? শুধুই কি ক্রিকেটীয় কারণ? একেবারেই নয়। বরং, তাঁর পতনের শুরুটা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতেই। সেটা গত সিরিজের গোলাপি টেস্টে নয়, তার আগের সফরে।
ব্যক্তিগত ইমোশন কাজ করে কিছু ক্ষেত্রে। সেটা প্রতিটি ক্রিকেট প্রেমীর। নিয়মিত যাঁরা ক্রিকেট দেখেন, সাংবাদিকতা করেন, তাঁদেরও। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপই ধরা যাক। নিউজিল্যান্ডে হয়েছিল সে বারের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। তার আগের মরসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে একের পর এক বিধ্বংসী ইনিংস। সব ম্যাচ টেলিভিশনে সম্প্রচার হয় না। অপেক্ষা শুরু হয় বিশ্বকাপের। এতেও বড় বাধা টাইমজোন। ভোর ৪টেয় শুরু বিশ্বকাপের ম্যাচ। তাতে কী! বাংলার পেসার রয়েছেন, আর সবচেয়ে বড় কথা, যাঁকে নিয়ে এত্ত আলোচনা, সেই পৃথ্বী শ-কে নিজের চোখেও তো খেলতে দেখতে হবে!
রাত জেগে ‘নেক্সট’ বিগ থিংয়ের কিছু দুর্দান্ত ইনিংস দেখার সুযোগ হয়েছিল। সত্যিই পরবর্তী প্রজন্মের ‘রাজা’-র মতোই। তাঁর নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়। সিনিয়র দলে সুযোগ ছিল সময়ের অপেক্ষা। দ্রুতই ইংল্যান্ড সফরে শেষ দুটি টেস্টের স্কোয়াডে ডাক পান। সেই সিরিজেই ঋষভ পন্থের টেস্ট ডেবিউ হয়। পৃথ্বী অবশ্য খেলার সুযোগ পাননি।
ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজেও দলে জায়গা ধরে রাখেন। তাঁর খেলা নিশ্চিতই ছিল। হলও তাই। অভিষেকে প্রথম ইনিংসেই ১৩৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৭০, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৩৩। শুরুটা স্বপ্নের মতো। ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, তাঁর মুম্বই থেকে সচিনের মতোই উঠে এসেছেন এক তরুণ। তবে ঘরের মাঠে পারফরম্যান্স আর বিদেশে, বিশেষ করে যতক্ষণ না সেনা কান্ট্রি (SENA) অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় সাফল্য পাচ্ছেন, তাঁর মধ্যে যতই প্রতিভা থাকুক, বিগ থিংয়ের আসনে বসানো যায় না।
অস্ট্রেলিয়ায় খেলার সুযোগ দ্রুতই আসে। ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরেও টেস্ট স্কোয়াডে পৃথ্বী শ। কিন্তু টেস্ট সিরিজে খেলার সুযোগ আসেনি। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একাদশের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৬৯ বলে ৬৬ রান করেন। লোকেশ রাহুলের সঙ্গে ওপেন করেছিলেন। টেস্ট সিরিজেও এই জুটিই দেখার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে সমস্যা তৈরি হয়। বাউন্ডারি লাইনে একটি ক্যাচ নিতে গিয়ে গোড়ালিতে চোট লাগে। দ্রুতই মাঠ ছাড়েন। পুরো সিরিজ থেকেই ছিটকে যান। অনেকে মন্তব্য করেছিলেন, কী দরকার ছিল প্রস্তুতি ম্যাচকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার! প্র্যাক্টিস ম্যাচেও পৃথ্বীর তাগিদ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্রিকেট প্রেমীরা।
চোট লাগার পর অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে কেন পত্রপাঠ দেশে ফেরানো হয়েছিল পৃথ্বীকে? অনেক সময় কোনও প্লেয়ারের চোট লাগলেও টিমের সঙ্গে রাখা হয়। অপেক্ষা করা হয় তাঁর ফিট হওয়ার। পৃথ্বীর ক্ষেত্রে কেন হয়নি? ওই সময়কার পরিস্থিতি অন্য কথা বলছিল। অস্ট্রেলিয়ায় থাকা সাংবাদিক বন্ধু, সিনিয়রদের থেকে কিছু তথ্য এসেছিল। রিহ্যাবের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার নাইট লাইফ, পার্টি পৃথ্বীর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পরিষ্কার করে বললে, শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণেই দেশে পাঠানো হয়েছিল পৃথ্বীকে। তখনই পৃথ্বীর মতো প্রতিভাবান তরুণের পতনের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল।
খুব কম সময়ে বেশি সাফল্য পেলে অনেকের মাথা ঘুরে যায়। ফোকাস নষ্ট হয়। লক্ষ্য থেকে যখন আশপাশের বিষয় বেশি টানে, তৈরি হয় সমস্যা। সরকারি ভাবে যেহেতু চোটের কারণে বাদ পড়েছিলেন, দল থেকে জায়গা হারাননি পৃথ্বী। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স এবং ফিট হওয়ার পর ২০২০ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে টেস্ট স্কোয়াডেও জায়গা পেয়েছিলেন। দু-ম্যাচের সিরিজে তাঁর অবদান যথাক্রমে ১৬, ১৪, ৫৪, ১৪ রান। অর্থাৎ, সফল নন, ব্যর্থই বলা উচিত। তাতেও টিমে ম্যানেজমেন্ট তাঁর পাশেই ছিল।
পৃথ্বীর বাইরের ‘দুনিয়া’ তাও বদলায়নি। যাঁর প্রভাব মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেন কোনও মহামারী ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছিল। নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছিলেন। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে পিঙ্ক বল টেস্টে জায়গা পেয়েছিলেন পৃথ্বী। প্রথম ইনিংসে ০। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪। রানের চেয়েও বড় সমস্যা ছিল, তাঁর আউট হওয়ার ধরণ। ৩৬ রানে অলআউটের লজ্জার পর মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টে বাদ পড়েন পৃথ্বী। আর সেখান থেকে উত্থান ২০১৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে পৃথ্বীর সতীর্থ শুভমন গিলের।
সেই সিরিজে আর এক ম্যাচেও সুযোগ হয়নি পৃথ্বী শ-এর। কিন্তু পতনের ব্রিজ তৈরি করেছিলেন নিজে হাতেই। সেই ২০১৮ অস্ট্রেলিয়া সফরে। ২০২০-তে তাঁর উপর যেন সিলমোহর পড়ল। অবাক হওয়ার বিষয় অন্য জায়গায়। ২০১৬ সাল থেকে ভারতের যুব দলকে সামলেছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। ঈশান কিষাণ-ঋষভ পন্থদের ব্যাচ সে-বার অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জেতাতে পারেনি। পরের বিশ্বকাপেও কোচ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়ই। কেরিয়ারের শুরুতে রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কোচ, সকলের এমন ভাগ্য হয় না। দ্রাবিড়ের স্কুলিং থেকে কেউ ফোকাস হারাতে পারে, অবিশ্বাস্য। বলা ভালো, বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেটের যাঁরা সুপারস্টার তাঁদের জীবনে খারাপ সময় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোয় দ্রাবিড়ের বড় অবদান রয়েছে। শুভমন গিল, যশস্বীদের মতো তরুণদের কথা না হয় বাদই দিলাম। হার্দিক পান্ডিয়া, শ্রেয়স আইয়ার, লোকেশ রাহুল। উদাহরণ হিসেবে এই তিনটে নামই যথেষ্ট। একটি টেলিভিশন শো-তে কুরুচিকর মন্তব্যের জেরে হার্দিকের কেরিয়ার শেষ হতে বসেছিল। তাঁর সঙ্গে একই পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন লোকেশ রাহুল।
সে সময় জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির দায়িত্বে দ্রাবিড়। দুই ক্রিকেটারকে এনসিএ-তে দ্রাবিড়ের কাছেই পাঠানো হয়েছিল। টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ‘ক্লাস’। সেটা ক্রিকেটীয় দিক থেকেই শুধু নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও। শ্রেয়স আইয়ার, অজিঙ্ক রাহানে, চেতেশ্বর পূজারার মতো ক্রিকেটাররা যখনই টেকনিকের দিক থেকে সমস্যায় পড়তেন, ঠিকানা ছিল একটাই। রাহুল দ্রাবিড়। জাতীয় দলে ব্রাত্য, ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা নেই, ফিটনেসের দিক থেকে খুবই খারাপ জায়গায়। লাগাতার সমালোচনায় মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত। অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটাররাই মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে চলেছেন পৃথ্বীকে। পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আগে পৃথ্বীকে মূল স্রোতে হয়তো ফেরাতে পারেন রাহুল দ্রাবিড়। তবে যতক্ষণ না নিজেকে আয়নায় দেখে পৃথ্বীর সেই উপলব্ধিটা হচ্ছে, ততক্ষণ সম্ভব নয়।
অনেক সেরা ক্রিকেটারই হারিয়ে গিয়েছেন শুধুমাত্র শৃঙ্খলা ধরে রাখতে না পারায়। বিনোদ কাম্বলির চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে। অনেকে তর্কের জায়গা থেকে বলতেই পারেন, প্রয়াত শেন ওয়ার্নও তো ‘রঙিন’ জীবন যাপন করতেন। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, মাঠের পারফরম্যান্সে তার প্রভাব পড়তে দিয়েছেন কি? খুঁজলে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।
কে জানে, বিরাট কোহলিও হয়তো এই তালিকায় থাকতেন! কেরিয়ারের শুরুর দিকে তাঁর ফিটনেস, অল্প সাফল্যে নিজেকে সেরা ভেবে নেওয়া, আইপিএলে ভালো খেলার নেশায় কিংবদন্তি হওয়ার পথটাই যেন ভুলে যেতে বসেছিলেন। ব্যর্থতার ধাক্কা তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছিল। নিজের ভুল দ্রুতই বুঝতে পারেন বিরাট। আসল লক্ষ্য পূরণে পছন্দের নানা বিষয়ের সঙ্গেই আপোস করেছিলেন। খাবার, লাইফস্টাইল, ফিটনেস সব দিক থেকে নতুন শুরু করেছিলেন। বিরাট কোহলি বিশ্বের সেরা হয়ে উঠেছেন।
জীবনের যেটা আসল লক্ষ্য, সেই ক্রিকেট কেরিয়ারই যদি ‘সাদা-কালো’ হয়ে যায়, রঙিন জীবন থেকে বাস্তবে ফিরে আসাই শ্রেয়। রঙিন দুনিয়া সাময়িক আনন্দ দিতে পারে, দীর্ঘমেয়াদী তৃপ্তি নয়। ‘নারীর’ টান আর যাঁর জন্য পরিচিতি পাওয়া সেই ক্রিকেটের প্রতি ‘নাড়ির’ টান গুলিয়ে ফেললে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। পৃথ্বী শ- কি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন? প্রশ্ন করবেন নিজেকে? ফিটনেসে জোর দেবেন! কে জানে, হয়তো ফেরার একটা রাস্তা তৈরি করবেন নিজেই।