Kolkata Derby Retro Story: ‘হেরেও সমর্থকদের কাঁধে চেপে ক্লাবে ফিরেছিলাম’

সাড়ে ৩ বছর পর আবার কলকাতায় একটা বড় ম্যাচ হবে। নিঃসন্দেহে সমর্থকরা তেতে থাকবে। কোভিডের সময় কলকাতায় খেলা হয়নি। বড় ম্যাচ দেখার সুযোগ পায়নি দুই প্রধানের সমর্থকরা।

Kolkata Derby Retro Story: 'হেরেও সমর্থকদের কাঁধে চেপে ক্লাবে ফিরেছিলাম'
'হেরেও সমর্থকদের কাঁধে চেপে ক্লাবে ফিরেছিলাম'
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 17, 2022 | 8:00 PM

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা ডার্বি ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি (Derby) ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির নানা গল্প নিয়েই টিভি নাইন বাংলার এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

বড় ম্যাচ নিয়ে এই প্রতিবেদনটা লিখতে বসে এক ঝটকায় কয়েক যুগ পিছিয়ে গেলাম যেন। আমার বয়সটাও যেন একধাক্কায় কমে গেল অনেকখানি। ওই সোনালী অতীত ভোলার নয়। কলকাতা ময়দান, বড় ম্যাচ আমার জীবনের এক অন্যতম সুখের সময়। এত মানুষের ভালোবাসা পাওয়া তো ওই ময়দানের জন্যই। ময়দানই আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। সবুজ ঘাসের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে কখনও ভুলতে পারব না। কোচ, কর্মকর্তা, সমর্থকদের প্রত্যেকের কথাই আমি আজও মনে রেখেছি। এখনও সময় পেলে ওই দিনগুলোয় ফিরে যাই। অদ্ভূত ভালো লাগা কাজ করে।

সাড়ে ৩ বছর পর আবার কলকাতায় একটা বড় ম্যাচ হবে। নিঃসন্দেহে সমর্থকরা তেতে থাকবে। কোভিডের সময় কলকাতায় খেলা হয়নি। বড় ম্যাচ দেখার সুযোগ পায়নি দুই প্রধানের সমর্থকরা। কোভিডের সঙ্গে লড়তে লড়তে একটা সময় আমরা ভাবছিলাম, আদৌ দর্শকভর্তি গ্যালারিতে খেলা হবে তো! সেই সব বাধা কাটিয়ে ২৮ তারিখ আবার মুখোমুখি হচ্ছে দুই প্রধান। ভেবেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। সমর্থকরা সারা বছর এই ম্যাচটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। দুই প্রধানকে কেন্দ্র করে সমর্থকদের লড়াইটা মাঠ থেকে এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়েছে। আমাদের যৌবনে এই দ্বৈরথটা মাঠেই হত। শুধু মাঠ কেন! রাস্তাঘাট, সেলুন, চায়ের দোকান সর্বত্র একটাই বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। তখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের উন্মাদনার মাত্রাটাই অন্য রকম ছিল। বড় ম্যাচের অনেক আগে থেকেই দুই প্রধানের সমর্থকদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র লেগে যেত।

১৯৭৬ সাল। কালিঘাট থেকে সই করি ইস্টবেঙ্গলে। আমার কাছে মোহনবাগানের অফারও ছিল। ওই বছর সমরেশ চৌধুরী, মহম্মদ হাবিব, আকবরসহ একঝাঁক ফুটবলার সই করেছিল মোহনবাগানে। প্রদীপদাকেও (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) নিয়ে নেয় মোহনবাগান। আগের বছর ইস্টবেঙ্গলের কাছে ৫ গোলে লজ্জার হারের পর, ধীরেন দে ক্লাবের দলগঠনের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন চন্দ্র মাধব রায়ের কাঁধে। আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন চন্দ্র মাধব রায়ই। গড়ের মাঠের নামী ফুটবলারদের সে বার সই করায় মোহনবাগান। অনেক ভেবে চিন্তেই ইস্টবেঙ্গলেই সই করি। আমি তখন জুনিয়র। প্রথম বড় ক্লাব। বাইরে বসে থাকতে চাই না, তাই মোহনবাগানে না গিয়ে ইস্টবেঙ্গলে খেলার সিদ্ধান্ত নিই।

অবশেষে এগিয়ে এল বড় ম্যাচের দিন। আমাদের কোচ অমলদা (অমল দত্ত)। ইডেন গার্ডেন্সে কলকাতা লিগের হাইভোল্টেজ ম্যাচ। তখন আমাদের বাড়ি ছিল টালিগঞ্জ থানার পিছনে। প্রিয়দা (প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি) থাকতেন আমাদের পাড়ায়। রাস্তায় বেরোলেই সবার মুখে শুধু একটাই কথা। আমি ইস্টবেঙ্গলে খেলায় বাড়িতে টিকিটের জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল। প্র্যাক্টিসে গিয়ে দেখতাম টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন ক্লাব তাঁবুতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ টিকিট নিয়ে যেত। ঝামেলা হলেই ঘোড়সওয়ার পুলিশ তেড়ে আসত।

বড় ম্যাচে মাঠে নামব। সে কি টেনশন! দু’দিন ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। ইডেন গার্ডেন্সে কলকাতা লিগের বড় ম্যাচ। ম্যাচের আগেই দুই প্রধানের কর্তাদের মধ্যে তুমুল ঝামেলা। তখন সবাই একটু বেশি তুকতাকে বিশ্বাস করত। ইডেন গার্ডেন্সে একটা পয়মন্ত ড্রেসিংরুম ছিল। ওই ঘরে যে দল নিজেদের দখলে নিত, তারাই নাকি ম্যাচ জিতত। জীবনদা, পল্টুদারা আগে থেকে সেই ঘর ম্যানেজ করে রাখতেন। প্রদীপদা মোহনবাগানে চলে যাওয়ায় ইস্টবেঙ্গলের ওই চালটা জানতেন। তাই আগে থেকে ওই ঘরে তালা মেরে দেন। জীবনদা জানতে পেরে ওই তালার উপর আর একটা তালা মেরে দেন। ঘর খোলা নিয়েই শুরু হয়ে যায় ঝামেলা।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব থেকে ইডেন গার্ডেন্স— ওই রাস্তাটুকু আমরা গাড়ি চেপে গিয়েছিলাম। প্রথম বার ইডেনে ঢুকলাম। গ্যালারিতে অত মানুষ দেখে চমকে গিয়েছিলাম। একটা ভীতি মনের মধ্যে কাজ করছিল। গৌতম সরকার আমাদের অধিনায়ক। সুধীর কর্মকারও ছিল। ওরাই আমাকে সামলাল। ভয় কাটিয়ে তারপর মাঠে নামলাম। বাঁশি বাজার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গোল। উলগানাথনের লম্বা সেন্টার থেকে আকবরের হেড। ১৭ সেকেন্ডের মাথায় আকবরের ওই গোল আজও ভারতীয় ফুটবলে দ্রুততম গোল হয়ে রয়ে গিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোল হজম করলাম। ওই ০-১ গোলেই আমরা ম্যাচটা হেরেছিলাম। তবে সে দিন আমরা মনে রাখার মতো ফুটবল খেলেছিলাম। বিশেষ করে গৌতমদা। মোহনবাগানকে নাজেহাল করে দিয়েছিল ওই ম্যাচে। আমরা ৫ গোলে ম্যাচটা জিততে পারতাম। ভাগ্য সহায় না থাকায় হেরে ফিরেছিলাম। আমি তো বলব, ওটাই গৌতমদার কেরিয়ারের অন্যতম সেরা ম্যাচ। ওই ম্যাচে রেফারি ছিলেন রত্নাঙ্কুর ঘোষ। গড়িয়ায় থাকতেন। ম্যাচের পর রেফারিকে তাড়া করেছিল সমর্থকরা।

আমি আর শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায় সবে ইস্টবেঙ্গলে এসেছি। সেই আমাদেরই কিনা ম্যাচের পর কাঁধে করে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে নিয়ে গিয়েছিল সমর্থকরা। হেরেও যে এত ভালোবাসা পাওয়া যায়, ওই প্রথম অভিজ্ঞতা। পরের দিন মতি নন্দী লিখলেন, খেলেছে ইস্টবেঙ্গল, জিতেছে মোহনবাগান। ক্লাবে ঢুকতেই সচিব ডাঃ নৃপেন দাস আমাকে আর শ্যামলকে পরদিন ওঁর বাড়িতে ডাকলেন। পরদিন সকাল ৯টায় নিউ আলিপুরে ডাঃ নৃপেন দাসের বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই আমাদের গরম লুচি, তরকারি আর আম দেওয়া হল। খাওয়া শেষ করতেই দেখি, সিঁড়ি দিয়ে ডাক্তারবাবু নামলেন। আমাদের খেলার প্রশংসা করলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে দশটা ১০ টাকার নোট বার করে আমাদের হাতে দিলেন। বললেন, ‘ভালো ফল খেও। ভেজাল খাবার একদম খাবে না। এদিক-ওদিক ঘুরবে না। আর কোনও দাদা ধরবে না।’

১৯৭৮ দিল্লিতে ডুরান্ড কাপের ফাইনালও আমার স্মরণীয় ম্যাচ। মোহনবাগান তখন শক্তিশালী দল। প্রদীপদা কোচ। আমাদের কোচ অরুণ ঘোষ। ওই ম্যাচ আমরা ৩-০ জিতে চ্যাম্পিয়ন হই। দারুন ফুটবল খেলেছিলাম সে দিন। ট্রফি নিয়ে শহরে ঢোকার পর অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দিয়েছিল লাল-হলুদ সমর্থকরা। কলকাতায় খেলা থাকলে, প্রত্যেকটা বড় ম্যাচের তিন চারদিন আগে ইস্টবেঙ্গল কর্তারা আমাদের পার্ক স্ট্রিটের নাম করা রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতেন। চাইনিজ খেয়ে মনোবল কয়েকগুণ বেড়ে যেত।

১৯৮৫ সালে কলকাতা লিগের বড় ম্যাচও স্মরণীয়। তখন আমি মোহনবাগানে। ইস্টবেঙ্গলের কোচ তখন প্রদীপদা। আমাকে আটকাতে সুনির্মল চক্রবর্তীকে দিয়ে পুলিশম্যান মার্কিং করালেন। কলকাতা ময়দান ওই প্রথম পুলিশম্যাচ মার্কিং দেখল। আমি যেখানেই যাচ্ছি, সুনির্মল সঙ্গে। ম্যাচটা ১-১ ড্র হয়েছিল। সুনির্মল এরপর কোথাও গেলে, লোকে পুলিশম্যান বলে ডাকত।

(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)