IRAN-USA, Qatar WC: ইরান-আমেরিকার তিক্ততার জমিতে কি ফের ফুটবল-ফুল?
Qatar 2022: বিউটিফুল গেম-এ তো শুধুই ৯০ মিনিটের বর্তমান। কিন্তু তিক্ততার অতীত যদি সাময়িক ভাবে অন্তত ভোলা যায়? তাহলে ৯৮-এর মতো হয়তো এই ম্যাচেরও কিছু মুহূর্ত ফুটবলের পতাকা আবার উঁচুতে উড়িয়ে দিতে পারে!
নীলাঞ্জন বসু
২ জানুয়ারি, ২০২০। হোয়াইট হাউসে তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন রকেট হানায় নিহত হলেন ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর-এর মেজর জেনারেল কাসেম সুলেমানি। ওয়াশিংটনের বরাবরের অভিযোগ, সুলেমানি সন্ত্রাসবাদী। কিন্তু কট্টরপন্থী ইরানিদের কাছে তিনি জাতীয় হিরো। সে কারণেই তেহরান থেকে তাবরিজ— ইরানের শহরে শহরে তখন জোরদার আমেরিকার মুণ্ডপাত।
আমেরিকা-ইরানের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ সত্তর বছরের। তিক্ততার গ্রাফ একটু-আধটু নেমেছে, কিন্তু পুরোপুরি মুছে যাওয়ার কোনও ঝিলিক দেখা যায়নি। ফুটবল মাঠেও এই ছায়া লম্বা। ৯৮-এ ফ্রান্সের পর কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগের ম্যাচে ফের আমেরিকার মুখোমুখি হচ্ছে ‘টিম মিল্লি’। মানে ইরানের জাতীয় ফুটবল দল। তাই স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের তলায় আবার রাজনীতি-কূটনীতির তাপ-উত্তাপের আঁচ। তবে বিউটিফুল গেম-এর আবেগ কখনও কখনও টপকে যায় তিক্ততা-শত্রুতার সীমানা। দেশের মাটিতে যা লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার, সেটাই বন্ধুত্বের ফুল হয়ে ঝরে পড়ে অভিবাসী ইরানি মহলে।
দুই দেশের ফুটবল ম্যাচের আবহে যতই লড়াইয়ের হুঙ্কার থাকুক না কেন, বাইশ বছর আগে ছবির দেশ, কবিতার দেশ ফ্রান্সে বিশ্বকাপের আসরে যাবতীয় আশঙ্কা ছাপিয়ে শেষমেশ জিতেছিল ফুটবল। তবে রাজনীতি কবে আর সাধারণ মানুষের ফুটবল নিয়ে আবেগের তোয়াক্কা করেছে? কাতার বিশ্বকাপে আমেরিকা-ইরান ম্যাচ ঘিরে হাওয়া গরম সে কারণেই। গত সেপ্টেম্বরে পুলিশ হেফাজতে কুর্দিশ তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে ইরানে। ইরানের রক্ষণশীল সরকারের বন্দুক-বেয়নেটের মুখে পথে নেমেছেন দেশের মহিলারা। হিজাব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিক। আরও ফুটছে স্বৈরতন্ত্র-গণতন্ত্রের ঘোলাজল। কাতার বিশ্বকাপ থেকে ইরানকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে বার বার। ইরানের মাঠে এখনও ব্রাত্য মহিলারা। তার জন্যও ইরানকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছে মহিলা অধিকার রক্ষার সংগঠন ‘ওপেন স্টেডিয়ামস’। বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে ইরানিরা ২৯ নভেম্বর, মঙ্গলবার মুখোমুখি হচ্ছে মার্কিনদের। ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করারও অভিযোগ আছে তেহরানের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে গরমা-গরম আন্তর্জাতিক আবহেই ফুটবল স্টেডিয়ামে টক্কর দুই দেশের।
সেটা ছিল ১৯৫৩। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেঘের নেতৃত্বাধীন ইরানের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে গদিচ্যুত করেছিল আমেরিকা। মোসাদ্দেঘের অপরাধ ছিল, ইরানের তেল শিল্পের জাতীয়করণের পথে এগিয়েছিল তাঁর সরকার। ওয়াশিংটন-তেহরানের সেই তিক্ততার সম্পর্ক তিক্ততর হয়ে ওঠে ১৯৭৯-এ, ইসলামি বিপ্লবের সময়, মার্কিন মদতপুষ্ট মহম্মদ রেজা পহ্লভির শাসন উৎখাতের মাধ্যমে। ইরানি বিক্ষোভকারীরা দখল করে নেন তেহরানে মার্কিন দূতাবাস। টানা ৪৪৪ দিন বন্দি করে রেখেছিলেন মার্কিন দূতাবাস কর্মীদের। ইরানি বিপ্লবের হোতা আয়াতোল্লা খোমেনি আমেরিকার নাম দিয়েছিলেন ‘মহা শয়তান’। পাল্টা ওয়াশিংটনও একে একে নানা অবরোধ, নিষেধাজ্ঞার ফাঁস চাপিয়ে দিতে শুরু করে দেয় তেহরানের ওপর।
গত শতাব্দীর আটের দশকে শুরু হয়েছিল ইরাক-ইরান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে সাদ্দাম হুসেনের বন্ধু ছিল আমেরিকা! প্রকাশ্যেই ইরাককে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল পেন্টাগন। তাতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে আম-ইরানিদের রোষ। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, পশ্চিম এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দেয় ইরানের ইসলামি সরকার। অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। ২০০২ সাল নাগাদ ইরানের গোপন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি ঘিরে ওয়াশিংটন বনাম তেহরানের সংঘাত ফের তুঙ্গে। রাষ্ট্রপুঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। তবে ২০১৫-য় স্বাক্ষরিত হয় ‘জেসিপিওএ পরমাণু চুক্তি’। যদিও ছাইচাপা আগুনের এই সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। ২০১৮-য় ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের তেল রফতানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তেহরানকে ভাতে মারার কৌশল নেয় ওয়াশিংটন। কিন্তু দমানো যায়নি ইরানকে। কাসেম সোলেমানিকে হত্যার কয়েক দিনের মধ্যেই ইরাকে মার্কিন সেনা ও যৌথ বাহিনীর দুই ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তাতে কমপক্ষে ৮০ জন ‘মার্কিন’ নিহত হন বলে দাবি করে তেহরান।
ইরাকে মধ্যরাতের সেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে আমেরিকার গালে সপাটে থাপ্পড় বলে বর্ণনা করেছিলেন ইরানের বর্তমান শীর্ষনেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। দু-পক্ষের আস্ফালনে সেই সময় মেঘ ঘনিয়েছিল যুদ্ধের। যদিও মার্কিন মুলুকেই তখন বেরিয়েছিল বিশাল সব যুদ্ধ বিরোধী মিছিল। যুদ্ধ বিরোধী এই মার্কিনদের সঙ্গে বিরোধ নেই দীর্ঘ ইতিহাস, পরম্পরার অধিকারী সাধারণ ইরানিদের। ফুটবলের ফুল ফুটে উঠতে পারে এমন জমিতেই। অনেকটা যেমন হয়েছিল ফরাসি দেশে, লিয়ঁর সেই ম্যাচে। ৯৮-এর ওই ম্যাচে নাকি মার্কিন ফুটবলারদের সঙ্গে হাত না-মেলানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্ব। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগে ইরানি ফুটবলারদের প্রতিপক্ষকে সাদাফুল উপহারে ভেসে যায় সব শত্রুতা। ফুটবলের ম্যাজিককে নিশান করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা।
ফুটবলের এই ম্যাজিক সত্ত্বেও দেশের মাটিতে ইরানি মহিলাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। রক্ষণশীলতার শক্ত খাঁচা খেলার মাঠেও যে! ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই মাঠ বা স্টেডিয়ামে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্বদেশে মোল্লাতন্ত্রের এমন আচরণের বিরোধিতায় বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক জাফর পানাহি তৈরি করেন একটি ছবি– অফসাইড। ২০০৬-এর বিশ্বকাপে ইরানের যোগ্যতা অর্জনের একটি ম্যাচে সব বাধা ছাপিয়ে এক তরুণীর তেহরানের আজাদি স্টেডিয়ামে ঢুকে ফুটবল ম্যাচ দেখার চেষ্টাই ছবিটির বিষয়বস্তু। তবে ২০১৯-এর অক্টোবরে কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচে আজাদি স্টেডিয়ামেই ঢোকার অনুমতি মিলেছিল মেয়েদের। ইরানে নারী বিরোধী হিংসার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে তার রেশ এখন ফিকে। টিম মিল্লি-র স্টার স্ট্রাইকার, বেয়ার লেভারকুসেনের সরদার আজমৌনের ইস্টাগ্রামে ‘লং লিভ উইমেন অফ ইরান’ বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে এই গ্রহের সর্বত্র। রক্ষণশীলদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আজমৌনকে জাতীয় দলে নিতে দু-বার ভাবেননি ইরানের পর্তুগিজ কোচ কার্লোস কুইরোজ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতের সময় ইরানের ফুটবলারদের ‘সরব-নীরবতা’ কুর্নিশ কুড়িয়েছে সারা বিশ্বের। ভয় ও অভয়ের এমন টানাটানির মধ্য়েই আবার মাঠে নামছে ইরান ও আমেরিকার ফুটবল টিম। ফুটবলের সেরা উৎসব-বিশ্বকাপে। পারস্যের মহাকবি, বুলবুল-ই-শিরাজ হাফেজ লিখেছেন– পুরনো স্মৃতির ভার বওয়া মিছে/অতীত তুলো না; যা গেছে তা গেছে।
বিউটিফুল গেম-এ তো শুধুই ৯০ মিনিটের বর্তমান। কিন্তু তিক্ততার অতীত যদি সাময়িক ভাবে অন্তত ভোলা যায়? তাহলে ৯৮-এর মতো হয়তো এই ম্যাচেরও কিছু মুহূর্ত ফুটবলের পতাকা আবার উঁচুতে উড়িয়ে দিতে পারে!