iPod-এর অকালমৃত্যু! বর্ণময় পথচলা, ফিকে ফেয়ারওয়েল, Apple-এর প্রথম মিউজ়িক প্লেয়ারের যে গল্পগুলো না জানলেই ৯…

iPod Birth And Death 2001 - 2022 Timeline: আইপড এখন ইতিহাস। নস্ট্যালজিয়ার মোড়কেই হয়তো থেকে যাবে পুঁচকে এই ডিভাইস। কারণ, নতুন করে আর আইপড তৈরি হবে না। জন্ম থেকে মৃত্যু আইপডের সামগ্রিক ইতিহাসটা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

iPod-এর অকালমৃত্যু! বর্ণময় পথচলা, ফিকে ফেয়ারওয়েল, Apple-এর প্রথম মিউজ়িক প্লেয়ারের যে গল্পগুলো না জানলেই ৯...
Follow Us:
| Updated on: May 24, 2022 | 10:10 PM

সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়

2001 সালে পথচলা শুরু। তারপর থেকে বহু চড়াই-উতরাইয়ের সঙ্গী থেকেছে সে। তার কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়ার কাজও হয়ে গেল। কথা হচ্ছে iPod-এর। ছোট্ট একটা ডিভাইস। খুব হাল্কাও নয়। আবার খুব ভারীও নয়। পুঁচকে, কিউট একটা ডিভাইস: 1000টা গান স্টোর করতে পারত সে। শেষ যে iPod মার্কেটে পাওয়া যেত, সেই iPod Touch-এর প্রোডাকশনও বন্ধ করে দিল কুপার্টিনোর এই টেক জায়ান্ট। অর্থাৎ বাজারে যে কয়েকটা iPod এখনও পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে, সেগুলিই থেকে যাবে। নতুন করে আর iPod বানাবে না Apple। প্রায় দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে একচেটিয়া বাজার ধরে রাখার পর iPod আজ স্বাভাবিকভাবেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। কথায় আছে না, চেঞ্জ ইজ় দ্য অনলি কনস্ট্যান্ট। সময়ের নিয়মেই প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। ফিচার ফোন বদলে এসেছে স্মার্টফোন। হেডফোন এখন ট্রু ওয়্যারলেস ইয়ারবাড রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছাড়াই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল আইপড। মার্কেট ছেয়েছিল হাজার একটা নকল iPod-এ। সেই আইপডই যখন ইতিহাস হতে চলেছে, তখন অনেকেরই জিয়া নস্ট্যাল। অনেকের স্বপ্নটাও অধরা রয়ে গিয়েছে। কারণ, iPod-এর শখটা শেষ পর্যন্ত শখ হিসেবেই ব্র্যাকেটে আবদ্ধ থেকে গেল।

iPod যে শুধুই মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রি বদলে দিয়েছিল এমনটা নয়। প্রযুক্তি এবং ডিজ়াইন সম্পর্কে আমাদের যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল, তা-ও ভেঙে দিয়েছিল। আইপডের আইডিয়া, তার বাস্তবায়ন অ্যাপলের কাছে একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল ঠিকই। সেই সঙ্গেই তার অকল্পনীয় সাফল্য জনি ইভের জীবনটাই বদলে দিয়েছিল। জনি ইভ, Apple Inc-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবসের ক্রিয়েটিভ কোলাবরেটর ছিলেন 21 শতকের অন্যতম জনপ্রিয় ডিজ়াইনার। এহেন ইভই পরবর্তীতে iPhone, iPod, Apple Watch-সহ আরও একাধিক প্রোডাক্টের ডিজ়াইনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন iPod বাজার থেকে তুলে নেওয়া হল? দিগ্বিদিক না ভেবে যে কারও সহজ উত্তর হবে, বিক্রিবাট্টায় ভাঁটা পড়া। কিন্তু Apple-এর মতো একটা সংস্থা কি শুধুই বিকিকিনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে বলে মার্কেট থেকে iPod তুলে নিল? রয়েছে আরও কিছু কারণ। সেই কারণ আমরা আজ অতি অবশ্যই খুঁজে দেখব। তার থেকেও বড় কথা 21 বছর ধরে মার্কেটে একচ্ছত্র রাজত্ব করতে পারে এমন একটা ছোট্ট ডিভাইসের ইতিহাসটাও তো কম বড় নয়। অ্যাপলের আইপডকে ঘিরে না জানি কত অজানা কাহিনি রয়েছে। স্মৃতির অলিগলি বেয়ে Apple iPod-কে নিয়ে এমনই নানান জানা-অজানা কাহিনিগুলি আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

iPod শুধু স্টাইল স্টেটমেন্ট নয়, আরও অনেক কিছু

আগাগোড়াই মিউজ়িক Apple-এর DNA-তে ছিল। তার কারণ, সংস্থার অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবসের গান-বাজনার প্রতি তীব্র আকর্ষণের কথা প্রায় সকলেরই জানা। বব ডিলান এবং জন লেনন ও তাঁর ব্যান্ড দ্য বিটলস-এর গানের খুব ভক্ত ছিলেন স্টিভ। আর মিউজ়িক শোনার জন্য স্টিভ জোবসের একমাত্র পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল সনি ও তার একাধিক প্রোডাক্ট, যার মধ্যে অন্যতম ছিল সনি ওয়াকম্যান। এমনকী iPod লঞ্চের সময় স্টিভ নিজেই দাবি করেছিলেন, “এটা হল একবিংশ শতকের ওয়াকম্যান।” কিন্তু আইপডে প্রাথমিকভাবে খুব নিম্নমানের গান থাকত। আর সেই কারণে শুরুর দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটু রুচিশীল মানুষজনের কাছে তীব্র সমালোচিতও হয়েছিল। পরে গানের সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে 1000 করা হয় এবং তাতে সব ধরনের মানুষের জন্যই বাছাই করে গানের তালিকা যোগ করা হয়। ধীরে-ধীরে মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকেন। মানুষের হাতে এমনই এক ডিভাইস চলে আসে, যা ফ্ল্যাশ প্লেয়ারের থেকেও ছোট, 5GB স্টোরেজ, 1000 গান ধরে—ঠিক যেন একটা পকেটেই 100টা CD। আর তার প্রমাণ মেলে প্রথম 60 দিনের মধ্যেই যখন 1 লাখ 25 হাজার iPod বিক্রি হয়।

iPod নাম রাখার ইতিহাস

iPod-এর প্রসঙ্গ এলে সকলেই স্টিভ জোবস বা জনি ইভের নাম করেন। কিন্তু আর এক ব্যক্তির অবদানও নেহাত কম নয়। তিনি ভিনি চিকো, একজন ফ্রিলান্স কপি রাইটার। অ্যাপলের প্রথম মিউজ়িক প্লেয়ারের নামটি তিনিই রেখেছিলেন, ‘iPod’। সান ফ্রান্সিসকোয় Apple-এর অফিসে একদিন বাকি কপি রাইটারদের সঙ্গে আড্ডা মারছিলেন চিকো। সেই সময়ই তাঁকে জানানো হয় যে, অ্যাপল তাদের প্রথম মিউজ়িক প্লেয়ার লঞ্চ করতে চলেছে, তার নাম দিতে হবে। তারপর যখন চিকোর হাতে আইপডের প্রোটোটাইপটি ধরানো হয়, তখন তিনি অবাক হয়ে যান। ডিভাইসটি হাতে পাওয়ার পরই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে 2001: A Space Odyssey ছবিটির কথা। ছবিতে ডক্টর বো বাউনম্যান নামের চরিত্রটি এক জায়গায় একটি HAL এবং একটি Pod-এর কথা বলেছিলেন। HAL একটি কম্পিউটার যা স্পেসক্র্যাফ্ট অর্থাৎ Podকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং Pod একটি স্পেসক্র্যাফ্ট, যা বহির্জগৎে যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হত। চিকো একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং মিউজিক প্লেয়ারের সম্পর্কের মধ্যে স্পেসশিপ এবং ছোট স্বাধীন পডের সম্পর্কের একটি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন।

অরিজিনাল iPod একই বছরে ডিজ়াইন ও ডেভেলপ করা হয়েছিল

অ্যাপল-এর প্রাক্তন এসভিপি টনি ফ্যাডেল একবার বলেছিলেন, জনসাধারণের জন্য iPod উপলব্ধ করতে মাত্র এক বছর সময় লেগেছিল। যে বছরে ডিভাইসটি ডিজ়াইন করা হয়েছিল, সেই বছরেই iPod ডেভেলপ এবং রিলিজ় করেছিল Apple। টনি ফ্যাডেলকে বলা হয়, ‘আইপডের জনক’। ফ্যাডেল পরে বলেছিলেন, “কোনও টিম ছিল না, প্রোটোটাইপ, ডিজ়াইন কিসসু ছিল না।” এমনকী, 2001 সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আইপড প্রজেক্টটির অনুমোদনও দেননি স্টিভ জোবস। সে বছরই মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে iPod প্রস্তুতের কাজে গতি বাড়ানো হয়। অক্টোবরে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি মঞ্চ থেকে iPod-এর ঘোষণা করেন স্টিভ জোবস।

যখন জনি ইভ iPod-কে Apple-এর প্রথম ‘ওয়্যারেবল’ আখ্যা দিয়েছিলেন

গত বছরই ভোগ-এর আনা উইন্টোরের কাছে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অ্যাপল-এর প্রাক্তন ডিজ়াইন চিফ জনি ইভ বলেছিলেন, প্রকৃত অর্থে iPod-ই ছিল Apple-এর প্রথম প্রযুক্তিভিত্তিক ওয়্য়ারেবল। তিনি বলেছিলেন, “এর থেকে বেশি ব্যক্তিগত, আরও নির্দিষ্ট এবং আরও স্বতন্ত্র ও ঘনিষ্ঠ ডিভাইস আমি আগে কখনও দেখিনি।”

সাদা রঙের Apple প্রডাক্ট পছন্দ ছিল না স্টিভ জোবসের

iPod-এর নান্দনিক, ন্যূনতম লেআউট…স্ক্রল হুইল ও তার সঙ্গে সাদা রঙের হেডফোন—একটা সিগনেচার অ্যাপল ডিভাইসে যা-যা থাকার কথা ছিল, তার সবই ছিল কিউট মিউজ়িক প্লেয়ারটিতে। জনি ইভকে নিয়ে লিয়েন্ডার কাহনের লেখা বইতে বলা হয়েছে, ইভের প্রাথমিক আইপড ডিজ়াইন পছন্দ করেননি জোবস। আর তার সবথেকে বড় কারণটি ছিল, জোবস মোটেই সাদা রং পছন্দ করতেন না। তাই মালিককে খুশি করতে আরও নতুন রঙের মিশেলে আইপড ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছিলেন ইভ ও তার সহকারী ডিজ়াইনাররা। কাহনে তাঁর বইতে লিখছেন, “ডিজ়াইনাররা ক্লাউড হোয়াইট, স্নো হোয়াইট, গ্লেসিয়াল হোয়াইট এবং মুন গ্রে—এই কয়েকটি কালার ডেভেলপ করেছিলেন। তাদের মধ্যো জোবসের পছন্দ হয়েছিস মুন গ্রে রংটি। সেটিকেই শেষ পর্যন্ত অনুমোদন দেন জোবস।” পরবর্তীতে Apple ইয়ারবাডসের জন্যও এই মুন গ্রে রংটিই বেছে নেওয়া হয়েছিল।

iPod ক্লিক হুইলটি Bang & Olufsen কর্ডলেস টেলিফোন দ্বারা অনুপ্রাণিত

অনেকের মধ্যেই একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, Apple-ই সর্বপ্রথম আইকনিক স্ক্রল হুইল ডেভেলপ করেছিল তার iPod-এর জন্য। তা কিন্তু নয়। প্রথম মিউজ়িক প্লেয়ারের জন্য হুইল নেভিগেশন দেওয়ার আইডিয়াটি Bang & Olufsen কর্ডলেস টেলিফোনের থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছিল Apple। আর এই ইনকর্পোরেশনের আইডিয়াটি ছিল অ্যাপল-এর মার্কেটিং দফতরের প্রাক্তন SVP ফিল স্কিলারের।

সময়ান্তরে iPod-এর বিবর্তন ও বিভিন্ন মডেল

সময় যত এগোতে থাকল, ততই ছোট হতে থাকল iPod। এক-এক করে এল মিনি, তার পর শাফল, ন্যানো। এমনকী তার পরে কালার স্ক্রিনও যোগ করা হয়, যাতে Wall-E এর মতো সিনেমাও দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল ক্যাপাসিটিও। 1,000-এরও বেশি গান যোগ করার মতো ক্যাপাসিটিও পেয়ে গেল iPod। অ্যাপলের এই মিউজ়িক প্লেয়ারের প্রথম প্রজন্মটি 2001 সালে লঞ্চ করা হয়। 2003 সালে আসে iPod থার্ড জেনারেশন, তার পরের বছরেই লঞ্চ হয় iPod Mini। সেই বছরই অর্থাৎ 2004 সালে এল iPod-এর ফোর্থ জেনারেশন। সেবার আবার iPod (U2 EDITION)-ও লঞ্চ করা হয়। 2005 MENS eMS iPod Shuffle ফার্স্ট জেনারেশন। সে বার iPod Nano-ও লঞ্চ করা হয়। পঞ্চম প্রজন্মের iPod-ও চলে আসে সেই বছরেই, যার বডি আরও প্রশস্ত হয় এবং ডিসপ্লেও বেশ বড় দেওয়া হয়। এর পর 2007 সালে আসে iPod Touch-এর ফার্স্ট জেনারেশন। সেই 2007 থেকে 2019 ইস্তক iPod Touch-এরই পরপর সাতটা প্রজন্ম লঞ্চ করা হয়। 2019 সালে সপ্তম প্রজন্মের যে iPod Touch নিয়ে আসা হয়, তারপর থেকে আর কোনও আইপড তৈরি করেনি অ্যাপল। মার্কেটে এখন যে সব iPod রয়েছে, সেগুলির সবই 2019 সালে বা তার আগে তৈরি হয়েছিল।

আইপডের মৃত্যুর আসল কারণ

এবার আসল দিকটায় আসা যাক। 21 বছর পর কেন আইপডের সুহানা সফর শেষ হতে চলেছে? ব্যবসার দিকটা তো রয়েইছে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, সে কথাও সত্য। তার থেকেও বড় আরও একটা কারণ রয়েছে। ক্যাসেটের বাজার দখল করেছিল সিডি। কারণ, একটা ক্যাসেটে সর্বাধিক 20টা গান থাকত। তার পরে এল সিডি, সেখানে 200 বা তার বেশিই গান থাকত। সেই জায়গায় যখন iPod এল, তখন তাতে প্রাথমিক ভাবে 1000 এবং পরবর্তীতে কয়েক GB জায়গা জুড়ে গান ধরতে শুরু করল। আর এখন স্মার্টফোনে আপনি গান লোড না করেও স্পটিফাই, গানা, জিওসাভন বা অন্য কোনও মিউজ়িক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ গান শুনতে পারবেন। অর্থাৎ সময় যতই ঘনিয়েছে, ততই গান শোনার ডিভাইস সাইজ়ের দিক থেকে পাতলা বা ছোট হয়েছে। কিন্তু ততই বেড়েছে গানের সংখ্যা, মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রির পরিধিও ততই বিস্তৃত হয়েছে। আর এই সুবিশাল গানের সংখ্যা ও সমগ্র মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রিকে ধরাতে অনেকটাই ছোট হয়ে গিয়েছে আইপড। ঠিক সেই জায়গায় মিউজ়িক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ফোনে ডাউনলোড করে রাখলে সমস্ত গান, সমস্ত দেশের মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রিই ধরে যাবে।