TV9 Bangla Explained: প্রকৃতিকে হুকুম করে হড়পা বানের তেজ বাড়াচ্ছে মানুষই

Flash Flood In India: ২০১৩ সালের কেদারনাথ থেকে ২০২১ সালের চামোলি, এ বছরের জুলাইয়ের অমরনাথ থেকে অক্টোবরের মালবাজার—সব বিপর্যয়ই যেন একসুতোয় গাঁথা। সহজ কথায় বললে, সবই ডেকে আনা সর্বনাশ।

TV9 Bangla Explained: প্রকৃতিকে হুকুম করে হড়পা বানের তেজ বাড়াচ্ছে মানুষই
হড়পা বানের মূলে লোভী মানুষই?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 08, 2022 | 7:48 PM

কমলেশ চৌধুরী

Flash Flood Explained: জলবায়ু পরিবর্তনে কী ঘটছে? বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব না আউড়ে একটা কথা বলে দেওয়া যায়—খ্যাপা প্রকৃতি আরও খেপে উঠছে।

মানুষ কী করছে? খ্যাপা প্রকৃতির হাঁ প্রতি মুহূর্তে আরও চওড়া করে তুলছে। ক্ষতি হচ্ছে সেই মানুষেরই। হড়পা বান নিয়ে ঠিক এই কথাগুলোই বলা যায়। হড়পা বান একেবারে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক একটা ঘটনা। পাহাড়ের মাথায় প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড়ের কোল বেয়ে হঠাত্‍ই বান নামে। মেঘভাঙা বৃষ্টি হলে ভয়াবহ হয় বানের সেই রূপ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘভাঙা বৃষ্টির মতো চরম ঘটনাও বাড়ছে। তার সঙ্গেই বাড়ছে হড়পা বানের সংখ্যা। আর লোভী মানুষের কাজকর্মে সেই বান আরও ভয়াল রূপ ধারণ করছে। ২০১৩ সালের কেদারনাথ থেকে ২০২১ সালের চামোলি, এ বছরের জুলাইয়ের অমরনাথ থেকে অক্টোবরের মালবাজার—সব বিপর্যয়ই যেন একসুতোয় গাঁথা। সহজ কথায় বললে, সবই ডেকে আনা সর্বনাশ।

২০১৩ সালের জুনে ‘হিমালয়ান সুনামি’র সাক্ষী হয়েছিল উত্তরাখণ্ড। মৃত্যু হয় ৬,০৫৪ জনের। এখনও নিখোঁজের তালিকায় ৩,৩২২ জন। মহা-বিপর্যয়ের নেপথ্যে নিম্নচাপ-পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জোড়া ফলায় একটানা প্রবল বৃষ্টি। তার পর ফেটে যায় চোরাবারি তাল বা গান্ধী সরোবরের পাঁচিল। এর পরই হড়পা বান। মহাপ্রলয় নামে কেদারনাথে। ময়নাতদন্তে উঠে আসে: কেদারনাথে মন্দির-বাণিজ্যের ঠেলায় বেদখল হয়ে গিয়েছিল নদী। মন্দাকিনীর বুকে এমনই মেদ জমেছিল, ঠাঁই পায়নি হড়পা বানের বিপুল জলরাশি। দু’পাড় ভেঙে এগোনো ছাড়া উপায়ই ছিল না।

Flash Flood

এর ঠিক আট বছর পর আবার উত্তরাখণ্ডে বিপর্যয়। ধসের ফলে হিমবাহের বড় টুকরো ভেঙে হড়পা বান নামে ঋষিগঙ্গা নদীতে। জলের ঠেলায় ভেঙে যায় ঋষিগঙ্গার উপর তৈরি জলাধারও। দ্বিগুণ রোষে নেমে আসে নদী। শেষমেশ চামোলিতে মৃতের তালিকা পৌঁছয় তিরাশি (৮৩)-তে। এখানে মানুষের দোষ কোথায় জানেন? কেন্দ্রীয় সমীক্ষাতেই উত্তরাখণ্ডের ২৩টি জলবিদ্যুত্‍ প্রকল্প বাতিল করতে বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই প্রকল্পগুলির জন্য ভাগীরথী, অলকানন্দার স্বাভাবিক ছন্দে বড়সড় ক্ষতি হচ্ছে। বলা হয়েছিল, ২,৫০০ মিটারের উপরে জলবিদ্যুত্‍ কেন্দ্র গড়া যাবে না। ২টি প্রকল্পের মধ্যে দূরত্ব ১ কিলোমিটারের বেশি করতে হবে। সমীক্ষাকে পাত্তা না দিয়ে বাস্তবে কী হয়েছিল? ঋষিগঙ্গার উপরই ৪টি জলবিদ্যুত্‍ প্রকল্প। ধৌলিগঙ্গার উপর ৪টি প্রকল্প, ২টি আবার ২৫০০ মিটারেরও উপরে। উত্তরাখণ্ডে ৮৯টি প্রকল্প, আরও ৩৫০ বাঁধের পরিকল্পনা। খোদার উপর খোদকারির বহরটা বোঝা যাচ্ছে? কেন হড়পা বানের বিপর্যয় বাড়বে না?

এ বছরের জুলাইয়ের অমরনাথের বিপর্যয়ই ধরা যাক। অমরনাথ গুহার খুব কাছেই মেঘভাঙা বৃষ্টি। তার পর নদীতে হড়পা বান। জলের স্রোতে নেমে আসে পাথরও। হুড়মুড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহু তাঁবু, লঙ্গরখানা। ভিডিয়োয় স্পষ্ট দেখা যায়, নদী বয়ে যাচ্ছে—এই হুঁশ প্রায় কারও ছিল না। প্রায় নদীখাতেই তাঁবু খাটানো হয়। পুণ্যার্থীরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। প্রশাসনও চোখ বুজে ছিল। ফল, ১৬ জনের প্রাণহানি।

Flash Flood gfx

মালবাজারেও কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়? মাল নদী যে হড়পা-প্রবণ, তা শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির মানুষ মাত্রেই জানেন। ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। পুজো জুড়ে বৃষ্টিও হয়েছে। তা সত্ত্বেও এমন খরস্রোতা নদীতে বিসর্জনের অনুমতি কেন দিল প্রশাসন? নদীতে বিসর্জনের সুবিধার্থে অস্থায়ী বাঁধও বানানো হয়। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু সেই অভিযোগ ওড়ালেও, এ কথা স্বীকার করছেন, বিসর্জনের জন্য নদীতে চ্যানেল কাটা হয়েছিল। অর্থাত্‍, সেই এক কাজ, খোদার উপর খোদকারি। নদীতে মানুষের হস্তক্ষেপ, জেলাশাসকের কথাতেই স্পষ্ট।

উত্তরবঙ্গ জুড়ে নদীতে হস্তক্ষেপের এরকম নমুনা আরও। নদী বিশেষজ্ঞ জয়া মিত্রের কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গের নদী থেকে বছরের পর বছর বোল্ডার তুলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ি নদীর বাঁকে-বাঁকে মোটা পাথর থাকে, সেগুলোয় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে নীচের দিকে নামে নদী। ফলে জলের স্রোত কিছুটা বাধা পায়। গতি কমিয়ে নামতে পারে। কিন্তু সেই বোল্ডার বিক্রি করে দেওয়ায় হু-হু করে কাদা মেশানো জল নেমে আসছে। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, গোটা হিমালয় জুড়েই কাদার ধস নামছে। এরকম আগে হত না।’’

মন্দাকিনীর বুকে যেমন কাদা-পাথরের মেদ জমেছিল, একই ছবি উত্তরবঙ্গের নদীতেও। বুজে যাচ্ছে নদীখাত। জল বইবে কোথায়? উদাহরণ দিয়ে পরিবেশবিদ অনিমেষ বসু বলছেন, ‘‘ডিমডিমা, লিস, ঘিস, জয়ন্তী—এই নদীগুলোর বেশির ভাগেই খাত বলে কিছু নেই। বেশি বৃষ্টি হলেই জল রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে যায়। মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়া যাওয়ার পথে তিতিবাংরি নদী পড়ে। আগে সেই নদীর উপর তৈরি ব্রিজের নীচ দিয়ে ট্রাক যেতে পারত। এখন নদী এমন বুজেছে, ব্রিজের উপর দিয়ে জল যায়।’’ কেন এই দশা? দায়ী ভুটান। সিমেন্ট থেকে খনি, সে দেশের যাবতীয় ফ্যাক্টরির বর্জ্য বাংলার নদী হয়ে নেমে আসছে। দায়ী বাংলার প্রশাসনও। কারণ, নদীখাত বুজে যেতে দেখেও সবাই হাত গুটিয়ে বসে। অথচ, ভুটানের বৃষ্টির জলে প্রতিবার ভাসে ডুয়ার্সের নদী। তবু হুঁশ নেই।

recent Flash Flood stats

হুঁশ যে নেই, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো মহানন্দাই। অনিমেষ বসুর কথায়, ‘‘আমরা পুকুর চুরির কথা বলতাম, এ তো নদী চুরি। মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে ফুলবাড়ি—গোটা নদীটাই জবরদখল হয়ে গিয়েছে। গ্রিন ট্রাইব্যুনাল অনেক নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু নদী তো ভোট দেয় না। ভোট দেয় মানুষ। অতএব, কোনও কাজ হয়নি। পাহাড়ে প্রবল বর্ষণ হলে মহানন্দাতেও কোনও দিন মালের পুনরাবৃত্তি হবে না, কে বলতে পারে!’’

আশঙ্কা থাকবেই, কারণ পাহাড় হোক বা সমতল, অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ছেই। গত বছর জুলাইয়ে মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বরে ২৪ ঘণ্টায় ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। ফল, ভয়াবহ বন্যা। গত অক্টোবরে একদিনেই ৫৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালে। ফল, ভয়াবহ বন্যা। গত বছর সেপ্টেম্বরে একদিনে আসানসোলে ঝরেছিল ৪৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি, বাঁকুড়ায় ঝরেছিল ৩৫৪ মিলিমিটার। ফল, ভয়াবহ বন্যা। প্রতিটি ঘটনাতেই স্পষ্ট, অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি হলে নিকাশি তার ভার নিতে পারছে না। পাহাড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। অথচ, এমন বিপর্যয়ের পূর্বাভাস আগেভাগে দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেটেরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গভীর নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনেক আগে থেকে দেওয়া যায়। কিন্তু পৃথিবীর কোনও গাণিতিক মডেলই আগে থেকে মেঘভাঙা বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে পারে না। যেটা দেওয়া যায়, সেটা নাওকাস্ট, অর্থাত্‍ কয়েক ঘণ্টা আগে। কিন্তু প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে সেই পূর্বাভাস পৌঁছনো সহজ নয়। নদীর উচ্চ প্রবাহে প্রবল বৃষ্টি হলে, সেই খবর দ্রুত পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছনো দরকার। কিন্তু তার পরিকাঠামো তৈরি করাও সহজ নয়।’’

নিখুঁত পূর্বাভাসের জন্য কাছে-কাছে অবজারভেটরি দরকার। পাহাড়ে তেমন নেটওয়ার্ক আজও তৈরি হয়নি। ২০০৫ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল মুম্বই। এতদিনে সেই শহরে চারটি রেডার বসানো হচ্ছে, যাতে এই ধরনের অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির পূর্বাভাস আরও নিখুঁতভাবে দেওয়া যায়। পার্থসারথি বলছেন, ‘‘রেডার ছাড়া মেঘভাঙা বৃষ্টির আভাস আগে দেওয়া শক্ত। গোটা হিমালয়ে রেডার বসানো সম্ভবও নয়। তবে হড়পা-প্রবণ নদীগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে এগোনো যেতে পারে।’’ গোটা বিষয়টিই সময়সাপেক্ষ, খরচসাপেক্ষ।

একেই খ্যাপা প্রকৃতি আরও খেপছে। তার মধ্যে পরিকাঠামোর অভাব স্পষ্ট। হড়পা বানের পূর্বাভাস দেওয়া বিশ্ব জুড়েই কঠিন। তার মধ্যে মানুষের নিরন্তর হস্তক্ষেপ। নিরন্তর গা-জোয়ারি। ক্ষতি ঠেকাবে কে?

জরুরি কথা বলছেন জয়া মিত্র, ‘‘আগে এসব পাহাড়ি নদীর কাছে মানুষ যেত না। নদী ইচ্ছেমতো বইতে পারত। হড়পা বান আসত, যেত। কেউ টেরই পেত না। এখন নদীর কাছেই মানুষের ভিড়। তাকে ইচ্ছেমতো বইতেও দিচ্ছি না আমরা। হুকুম করে বলছি, ওদিক দিয়ে খালের মতো বয়ে যাও। এটা হয় না। প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করলে আমাদের আরও আঘাত পেতে হবে।’’

আঘাত পেলেও কি আমরা শিক্ষা নিই?

অলংকরণে: অভিজিৎ বিশ্বাস