উৎসবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ল দ্রোহের স্পর্ধা, কিন্তু প্রশাসন কি উৎসবে কালো কাপড় চোখে তুলল?

দাবি আদায়ে জীবন বাজি। দুসপ্তাহ পার করে চলছে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন। উৎসবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়লো দ্রোহের স্পর্ধা। সমঝোতার পথে প্রশাসন। আগামিকাল নবান্ন-য় বৈঠক। মিলবে কি সমাধান? নাকি আরও জোরাল হবে আন্দোলন?

উৎসবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ল দ্রোহের স্পর্ধা,  কিন্তু প্রশাসন কি উৎসবে কালো কাপড় চোখে তুলল?
| Edited By: | Updated on: Oct 20, 2024 | 11:58 PM

বাঁশে, ত্রিপলে বাঁধা মঞ্চ। ধর্মতলায় একদল জুনিয়র ডাক্তার। দিন-রাত এক করে অনশনে বসে তাঁদের নীরব চিৎকার। এক মা যেন সাহস যোগাচ্ছে কিছু দামাল ছেলেমেয়েকে অন্য এক মায়ের জন্য বিচার ছিনিয়ে আনতে। স্বাস্থ্য দফতরে আনাচ কানাচের ঘুঘুর বাসা ভাঙতে এগিয়ে এসেছে তারা। কিন্তু প্রশাসন কি উৎসবে কালো কাপড় চোখে তুলল? ধর্মতলায় রোদ, ঝড়, জল মাথায় করে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোকে উৎসব আর আলোর রোশনাইতে আড়াল করতে চেয়েছিল তারা? কিন্তু আড়াল করা গেল কি? চাপা গেল কি বিচারের দাবি? আর কোন কোন দাবিতে অনড় জুনিয়র ডাক্তাররা? কোন পথে এগিয়ে চলেছে তাঁদের আন্দোলন? একটা একটা করে দিন কাটছে কিন্তু বিচার অধরা, অধরা প্রশাসন-জুনিয়র ডাক্তার সমাধান সূত্র। কেন মিলছে না এই পথ? কোন পথে মিলবে এই সমাধান? তারই উত্তর খুঁজবো এই নিউজ সিরিজে। আজকের নিউজ সিরিজ উৎসব-দ্রোহ-আন্দোলন। আজকের নিউজ সিরিজে চারটি পর্ব রয়েছে, পথের দাবি, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা!, আস্থা-অনাস্থা, সমাধানের সাত-পাঁচ। এখন আজকের প্রথম পর্ব, পথের দাবি।

পথের দাবি

বিজয়ার মিষ্টিমুখে এবছর তেঁতো স্বাদ। এখনও সেই অসুরদের স্বস্তি। তাঁরা এখনও অধরা যাঁদের জন্য একটা ফুলের মত মেয়ের এই পরিণতি হল। কর্মরত অবস্থায়। আরজি কর হাসপাতালে। শেষ দুমাসে বারবার এই ঘটনায় বিড়ম্বনার মুখোমুখি প্রশাসন। এবার যেন আরও একটু বিড়ম্বনা বাড়ল পুজো কার্নিভালে। কার্নিভাল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এক অদ্ভুত ছবি দেখল গোটা বাংলা। রানী রাসমণি রোড চত্বর। সেখানেও বাজলো ঢাক। শোনা গেল বাঁশির সুর। বিসর্জনের জমকালো কার্নিভালকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লো দ্রোহের কার্নিভাল। স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের যোগদানে ডাক্তারদের ডাকা আন্দোলন পেল অফুরান অক্সিজেন। কিন্তু সেখানেও মুখ পুড়ল কার? সেদিন যখন হাইকোর্টের অর্ডারের খবর পৌঁছলো রানী রাসমণি রোডের বদ্ধ জমায়েতে, শুরু হল ঢাকের তালে বিদ্রোহ উদযাপন। দ্রোহরূপেণ সংস্থিতা। আন্দোলন থামেনি। থামেনি বিচারের দাবিও। বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে কাজে ফিরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তিলোত্তমার বিচার? স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বেলাগাম দুর্নীতি, কোনও প্রশ্নেই তাঁরা যে সমঝোতার রাস্তায় যাননি তা বুঝিয়ে দিলেন কদিনের মধ্যেই। পাঁচদফার পর এবার দশদফা।

রাস্তাই একমাত্র রাস্তা!

উদ্দাম যৌবনের সাক্ষী হচ্ছে রাজ্য। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ভিত যারা তাঁদের আন্দোলন। ইতিহাস সাক্ষী। শাসকের দিকে আঙ্গুল তুলে ক্ষমতাকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছে তাঁরা। আর হাল আমলে? শুধু তো আমাদের দেশ নয়। আন্দোলনে কেঁপে উঠেছে তথাকথিত প্রথম বিশ্বের শাসনক্ষমতাও। ১৯১৫ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। ওয়ারফ্রন্ট থেকে এসে একের পর এক জাহাজ ভিড়ছে কলকাতা বন্দরে। গুরুতর আহত সৈন্যদের জাহাজে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ চিকিত্‍সার ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। হ্যাঁ, তখনও রোগীর পরিবারের হাতে ডাক্তারদের মার খেতেন। অথচ ব্রিটিশ সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসেছিল। সঙ্গে বেতনে চরম বৈষম্য। ভাতা ও সুযোগসুবিধা নিয়ে অভিযোগ। তাই ব্রিটিশ ভারতে সেই প্রথম ডাক্তার ধর্মঘট। বলা হয়, ডাক্তার হলেন ঈশ্বর সমান। আর সমাজের ঈশ্বরেরই যখন সমাজ বা শাসকের থেকে জোটে লাঞ্ছনা, গর্জে ওঠেন তাঁরা। আমাদের কলকাতাই সাক্ষী এরম অনেক চিকিৎসক আন্দোলনের। স্বদেশী আন্দোলনের সন্তান আরজি কর মেডিক্যাল কলেজেই আছে তেমনই এক আন্দোলনের ইতিহাস। হ্যাঁ, সেদিনও তরুণ প্রজন্মের ডাকে বিদ্রোহের উদযাপনে সামিল হয়েছিলেন প্রবীণরা। বিশিষ্টজন থেকে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ। স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের জোয়ারে ছাত্র আন্দোলন হয়ে উঠেছিল নাগরিক অভ্যুত্থান। রাস্তাগুলো হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিমূর্ত সাক্ষী, আজ শহর থেকে রাজ্য একই ভাবে সামিল হচ্ছে বিদ্রোহের উদযাপনে। কিন্তু সমাধান? নিরাপত্তা থেকে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ? বিদ্রোহের শেষে আসবে কি নতুন ভোর? নাকি প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর সমাজের অসুখই চিরাচরিত সত্য হিসেবে থেকে যাবে?

আস্থা-অনাস্থা

তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুন মামলার বিচারের আশায় এখনও উত্তপ্ত রাজ্য। মিছিল-মিটিং-অনশন থেকে কোর্টের হস্তক্ষেপ। দুর্নীতি মামলা থেকে খুনের ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু এতো ডামাডোলের মাঝে কোথাও গিয়ে কি হারিয়ে যাচ্ছে ন্যায়বিচারের মূল প্রশ্নটা? বা ধরুন নিরাপদ সমাজের প্রশ্নটা? এই আড়াই মাসে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারাতে হয়েছে একের পর এক তিলোত্তমাকে। তাহলে কিছুই কি পাল্টায় নি? প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের তালিকা দিন দিন লম্বা হচ্ছে। প্রশাসনের ভূমিকায় আস্থা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে মানুষ? এই অবিশ্বাস, এই আতঙ্কের কারণগুলি ঠিক কী কারণে সঙ্গত? ৫ অক্টোবর। তিলোত্তমার মৃত্যুর প্রায় দুমাস। আর সেদিন পুজোর ক্যালেন্ডারে সেদিন ছিল দ্বিতীয়া। সেদিনই ধর্ষিতা হতে হল চতুর্থ শ্রেণীর শিশুকে। মায়ের বোধনের আগেই ফুলের মত মেয়ের বিসর্জন। ঘটনাস্থল কুলতলি। কামদুনিতে যখন আন্দোলন চলছিল, তখন সরকার দেখেছিল সিপিএম আর মাওবাদের ছায়া। আর এই কদিন আগেই হাঁসখালি, সেদিন কী বলেছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান? নারী নিরাপত্তা থেকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিরাপত্তা। দুটি দাবিই যেন অতল জলে। আন্দোলন আটকাতে প্রশাসনের বজ্র আঁটুনি নিরাপত্তার প্রশ্নে ফস্কা গেরো! নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকে তিলোত্তমার বিচারের দাবি। আন্দোলনের রাস্তায় এখনও অটল একপক্ষ। চলছে আন্দোলনকারী বনাম সরকার জেদের লড়াই। সমাধানসূত্র এখনও অধরা। সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যায়নি এখনও। কোন পথে যাচ্ছে আন্দোলন? জুনিয়র ডাক্তার আর সরকারের মধ্যে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ কোথায়?

সমাধানের সাত-পাঁচ

এক দুই তিন করে আজ অনশনের ১৬ দিন। অনাহারে ক্লান্ত শরীরগুলো ক্রমাগত জানান দিচ্ছে, ওরা রাজপথ ছাড়ছেন না। অটল প্রতিজ্ঞা, অনড় অবস্থান। ধর্মতলায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে দ্রোহের গান। আন্দোলনের পারদ চড়িয়ে যখন দাবির আওয়াজ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে তখনই ১৯ অক্টোবর, শনিবার দুপুরে আন্দোলন মঞ্চে পৌঁছে গেলেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিসি সেন্ট্রাল। সেখান থেকেই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ভায়া ফোন মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা। কী বললেন তিনি? সোমবার নবান্নে বৈঠকের ডাক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে কি কাটবে অচলাবস্থা-অনশনের জট? নাকি ডেডলাইনের আগে জট না কাটায় ডাক্তারদের হুঁশিয়ারি সত্যি হবে? থমকে যাবে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা? তবে আলোচনাই যে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ তা অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন সিনিয়র চিকিৎসক এবং প্রফেসরদের একাংশ। একদিকে পর পর অনশনে অসুস্থ হচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা ভেঙে পড়ছে তাঁদের শরীর আর অন্যদিকে যদি ধর্মঘট হয়, তাহলে ভেঙে পড়বে এ রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ২১ তারিখ আবার একদফা বৈঠক। সেই বৈঠকেই কি মিলবে সমাধানের পথ। নাকি নিজেদের দাবিতে অনড় থেকে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন জুনিয়র ডাক্তাররা?

Follow Us: