In Depth Story on Over-Work: সব কথায় ‘ইয়েস বস’! মৃত্যুকে ডেকে আনছে না তো ওভার-টাইমের প্রবণতা?
n Depth Story on Over-Work: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, সপ্তাহে যারা ৫৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন, তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ বেশি হয়। হার্টের অন্যান্য ব্যাধিতেও মৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, আর্থারাইটিস, ক্রনিক লাং ডিজিজ এমনকী ক্যানসারও হতে পারে।
৯টার শিফটে সকাল ১১টায় হেলতে-দুলতে অফিস যাওয়া, ১টায় লাঞ্চ, ৪টে বাজলেই ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। আর ৫টা বাজলেই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি। কর্মদক্ষতায় ভারতের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল অলস মানসিকতা। কাট টু ২০২২। বিশ্বের সবথেকে ক্লান্ত কর্মীদের তালিকায় শীর্ষেই ভারতের নাম। ৯টা-৫টার ধারণা বিদায় নিয়েছে আগেই। এখন ১০ ঘণ্টার শিফট ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে। ছুটি কী, তা অনেকে বুঝতেই পারেন না কারণ সপ্তাহের ওই একটা ছুটির দিনেও বসের ফোন এলেই ল্যাপটপ খুলে বসে পড়তে হয়! এখন ওভার-টাইম করাটাই যেন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি বলেছিলেন, যুব প্রজন্মের সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত। সত্যিই কি সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব?
নথি-তথ্য বলছে অন্য কথা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এই অতিরিক্ত কাজের চাপেই অকালে ঝরে যাচ্ছে প্রাণ। ৩০-র কোঠা পার করেই কারোর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, আবার কেউ কাজের চাপ সহ্য করত না পেরে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। রুজিরুটি জোগানোর জন্য কাজ কীভাবে ডেডলাইনের চাপে নিঃশব্দে মৃত্যুকে ডেকে আনছে, তা নিয়েই আজকের টিভি৯ বাংলার এই বিশেষ প্রতিবেদন।
নতুন মহামারি ‘বার্নআউট’?
করোনাকালে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালু হওয়ার পরই অফিস আর বাড়ির সীমানা মুছে গিয়েছে। অফিসের বোর্ডরুম বেডরুমে ঢুকে পড়তেই কাজের চাপও বেড়েছে। কর্মীদের অভিযোগ, অফিসের কাজ বাড়ি বয়ে আনায় নিজস্ব সময় বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ মিলছে না। এর উপরে বসদের চাপ তো রয়েইছে। তাদের মন্ত্র ‘আরাম হারাম হ্যায়’। আপাতদৃষ্টিতে এটা সাধারণ বলে মনে হলেও, গবেষক-চিকিৎসকরা বলছেন করোনার মতোই নতুন এক মহামারি জন্ম নিচ্ছে এভাবেই। অতিরিক্ত কাজের চাপে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি থেকে অল্প বয়সেই মারণ ব্যাধি বাসা বাঁধছে।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসাবে বিশ্বের অন্যতম বড় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং (EY) সংস্থার কর্মী অ্যানা সেবাস্টাইনের মৃত্য়ুর ঘটনাই দেখা যেতে পারে। ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু লেখা থাকলেও, তাঁর পরিবারের দাবি, অফিসের অতিরিক্ত চাপেই অ্যানার মৃত্যু হয়েছে। অ্যানার প্রথম চাকরি ছিল এটাই। দিনে ১৪ ঘণ্টা ডিউটি, সপ্তাহের ৭ দিনই কাজ, তারপরও মানসিক চাপ-মাত্র ৪ মাসেই জীবনযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল অ্যানার। তাঁর মৃত্যুর পরই সংস্থার দিকে আঙুল ওঠে। সরকারও তদন্তের নির্দেশ দেয়। তবে ওই সংস্থার সাফাই ছিল, এত হাজার হাজার কর্মী কাজ করেন, কই তাদের তো কিছু হয়নি!
এই নিয়ে কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে অনেকের ধারণা, জেন-জ়ি (নতুন প্রজন্ম) কাজের চাপ সহ্যই করতে পারে না। এই ধারণা আসলে আরেক সামাজিক ব্যাধিকেই তুলে ধরে, যা হল মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা। কাজের চাপে যে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে, এই বিষয়টি অনেকে স্বীকারই করতে চান না। এবং এই বিষয় নিয়ে কথা বললে কর্মীদেরই অপরাধবোধ অনুভব করানো হয়।
ইয়েস বস মানসিকতা-
অ্যানা ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। কোথাও সিক লিভ না পেয়ে অফিসে আসা কর্মীর মৃত্যু হয়েছে, কেউ আবার নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। মনোবিদরা এর জন্য ভারতীয় কর্মীদের চিন্তাধারাকেও দুষেছেন। গুরুজনদের কথা মেনে চলার পাঠ কখন যে বদলে ‘ইয়েস বস’-এ পরিবর্তিত হয়েছে, তা বোঝেন না অনেকেই। মানসিক-শারীরিকভাবে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হলেও, কেবল বসের গুডবুকে থাকার জন্য সব কাজে ‘হ্য়াঁ’ বলার অভ্যাস বিপদ ডেকে আনছে।
চাকরি খোয়ানোর ভয়-
ভারতের মতো দেশে যেখানে জনসংখ্যার হার বিপুল এবং কর্মসংস্থান তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে অতিরিক্ত কাজে ‘না’ বললে চাকরি খোয়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। বহু চাকরিজীবীর উপরেই তার পুরো পরিবার নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে তাদের চাকরি ছাড়ার অপশন থাকে না। মুখ বুজে কাজ করাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন তারা।
ভারতীয়রাই সবথেকে বেশি কাজ করে-
ভারতে শ্রম আইন থাকলেও, অধিকাংশ সংস্থাতেই সেই আইন কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে ৮ ঘণ্টা ডিউটি বা সাপ্তাহিক কাজের হিসাব কষা হয় না। সুষ্পষ্ট আইনি পরিকাঠামো না থাকা এবং কঠোর শাস্তির বিধান না থাকায় বিশেষ একটা প্রভাবও পড়ে না বলে অভিযোগ অনেকের।
আন্তর্জাতিক শ্রম প্রতিষ্ঠান বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় সবথেকে বেশি অতিরিক্ত পরিশ্রম দেশ। দেশের ৫১ শতাংশ কর্মীই সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টা বা তার বেশি কাজ করে। তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে পড়শি দেশ ভুটান, যেখানে ৬১ শতাংশ কর্মীই ৪৯ ঘণ্টার বেশি কাজ করে।
স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হওয়ার হারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ২০২৩ সালে ম্য়াককিনসে হেলথ ইন্সটিটিউটের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতীয় কর্মীদের ৫৯ শতাংশের মধ্যেই ‘বার্নআউট’ উপসর্গ দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রেও ক্লান্তির হার ৬২ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আন্তর্জাতিক শ্রম প্রতিষ্ঠান, দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করা উচিত নয় বলেই সুপারিশ করে। তবে এশিয়ার অধিকাংশ দেশই, তা ভারত হোক বা বাংলাদেশ-পাকিস্তান কিংবা ভুটান, এই নিয়ম মানে না।
বাকি দেশের সঙ্গে তুলনা-
ভারতে যেখানে কর্মীরা ৯-১০ ঘণ্টার ডিউটি করে ক্লান্ত, সেখানেই বিশ্বের সবথেকে সুখী দেশ ডেনমার্ক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন নেদারল্যান্ডে সপ্তাহে সর্বাধিক ৩১.৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, সেখানে নরওয়েতে ৩৩.৭ ঘণ্টা কাজ করার নিয়ম রয়েছে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সের জন্য। অন্যদিকে আবার সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ভারতের থেকেও কাজের চাপ বেশি। বড় সংখ্যক কর্মীই গড়ে ৫০.৯ ঘণ্টা কাজ করে।
কীভাবে মৃত্যু ডেকে আনছে অতিরিক্ত কাজের চাপ?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, সপ্তাহে যারা ৫৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন, তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ বেশি হয়। হার্টের অন্যান্য ব্যাধিতেও মৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, আর্থারাইটিস, ক্রনিক লাং ডিজিজ এমনকী ক্যানসারও হতে পারে।
আত্মহত্যার মানসিকতা-
অতিরিক্ত কাজ, মানসিক চাপ, ক্লান্তিভাব আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। জাপানে যেখানে কর্মীরা ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করেই অভ্যস্ত, তারা অনেক সময়ই কাজের চাপে বাড়ি যান না। অফিসের আশেপাশেই কোনও মাঙ্গা ক্যাফে বা স্লিপিং পডে ঘুমোন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অফিস চলে যান। কাজের চাপে মানসিক অবসাদ ও তার জেরে আত্মহত্য়া- জাপানে এখন বড় ব্যাধির আকার নিয়েছে, যাকে বলা হয় কারোজিসাতসু (karōjisatsu)। মনোবিদদের আশঙ্কা, ভারতেও ধীরে ধীরে রোগের আকার নিচ্ছে এই আত্মহত্যা প্রবণতা।
এছাড়া কাজের চাপে ঘুম না হওয়া, সঠিক খাবার না খাওয়ার জেরে যেমন নানা রোগ দেখা দিচ্ছে, তেমনই চাপ সামাল দিতে ধূমপান-মদ্যপানের নেশায় ডুবে আরও রোগ বয়ে আনছে যুব প্রজন্ম।
ডেঞ্জার জ়োনে কারা?
একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সফটওয়্য়ার ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের কর্মী, ব্যাঙ্কিং, ফিন্যান্স ও বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থার কর্মীরাই সবথেকে বেশি সময় অতিরিক্ত কাজ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত কাজ করা, ন্যূনতম ৮ ঘণ্টা না ঘুমানোর কারণেই অল্প বয়সে শরীরে জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে।
কখন সতর্ক হবেন?
অতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে যদি অতিরিক্ত চিন্তা, বুক ধড়ফড় করা, অস্থিরতা, গা-হাত-পা ব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয়, তবে সেই মুহূর্তেই সতর্ক হওয়া উচিত। রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্যও নেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে।