Explained on Hindus Attacked in Bangladesh: বাংলাদেশে কীভাবে ‘উধাও’ হয়ে যাচ্ছে হিন্দু!
Bangladesh Unrest: মহম্মদ ইউনূসের অন্তবর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করলেও, বাস্তব চিত্রটা অন্য। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ ভাঙচুর থেকে শুরু করে মোদীর দেওয়া মুকুট চুরি, বিভিন্ন হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের মতো ঘটনা সামনে এসেছে।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি….’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জন্য যেমন জাতীয় সঙ্গীত লিখেছিলেন, তেমনই পড়শি দেশ বাংলাদেশের জন্যও জাতীয় সঙ্গীত লিখেছিলেন। এপার বাংলা-ওপার বাংলা, মাঝে ফারাক শুধু কাঁটাতাঁরের। এই বিশ্বাস বহু যুগের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরছে। যে বাংলাদেশকে ‘বন্ধু’ হিসাবেই ভেবে এসেছে ভারত, সেই বাংলাদেশেই ক্রমাগত রক্ত ঝরছে হিন্দুদের। একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই লড়েছিল ভারতীয় সেনারা। আজ সেই বাংলাদেশেই আক্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দুরা। প্রতিদিন হিন্দুদের উপরে নির্বিচারে অত্যাচার চলছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মন্দির। প্রতি দেশেই তো সংখ্যালঘুরা থাকে, তাহলে কেন বাংলাদেশে এত কোণঠাসা হিন্দুরা?
বাংলাদেশের হিন্দুদের উপরে হামলার ঘটনা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছেন হিন্দু ও সংখ্যালঘুরা। সাম্প্রতিক সময়ে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে আক্রমণ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। মহম্মদ ইউনূসের অন্তবর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করলেও, বাস্তব চিত্রটা অন্য। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ ভাঙচুর থেকে শুরু করে মোদীর দেওয়া মুকুট চুরি, বিভিন্ন হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের মতো ঘটনা সামনে এসেছে।
বাংলাদেশে কেন নির্যাতিত হিন্দুরা, এর কারণ জানতে গেলে আগে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। দেখতে হবে, কীভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মের মানুষরা আক্রান্ত-রক্তাক্ত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যারা দেশ ছাড়েননি, প্রতিনিয়ত তাদের রক্ত ঝরছে। প্রাণভয়ে রাত কাটাচ্ছেন তারা।
দেশভাগের ক্ষত-
বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে দুইবার। প্রথমবার ১৯৪৭ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজ শেষ হয়ে যখন ভারত স্বাধীনতা পেতে চলেছে, তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ভেঙে দুই টুকরো করা হবে ভারতবর্ষকে। এক খণ্ড হবে ভারত, অপর খণ্ড হবে পাকিস্তান। দেশভাগের সময়ে আদানপ্রদান হয়েছিল জনগণ। পাকিস্তান থেকে বহু হিন্দুরা চলে এসেছিলেন ভারতে, এই দেশ থেকেও বহু মানুষ, বিশেষত ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পাকিস্তানে চলে যান। তবে একটা বড় সংখ্যক হিন্দুরা, যাদের ভিটেমাটির টান ছিল প্রবল, তারা পাকিস্তানেই থেকে যান।
পাকিস্তানে থেকে গেলেও, সেখানে সুরক্ষিত ছিল হিন্দুরা, এমনটা নয়। পাকিস্তানে অত্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হতে চায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দাদের আয় ছিল সমান। ১৯৭১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের আয় দ্বিগুণ। শিক্ষা থেকে চাকরি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা। বন্ধ হয়ে যায় শয়ে শয়ে স্কুল, প্রশাসনিক পদে হিন্দু বা বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। কলকারখানা থেকে নতুন শিল্প- যাবতীয় উন্নয়ন কর্মযজ্ঞই পশ্চিম পাকিস্তানে হতে থাকে। তার উপরে হিংসা, আক্রমণ, গণহত্যা তো রয়েইছে।
বাংলাদেশ নাম হল কীভাবে?
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অত্যাচার সহ্য করতে করতেই একদিন ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। স্লোগান ওঠে “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। সালটা তখন ১৯৬৯। ওই বছরই শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ডাক দেন। ঘোষণা করেন, স্বাধীন দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। ওই সভায় আওয়ামি লীগের নেতারা আরও কয়েকটি নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু শেষে মুজিবরের প্রস্তাবিত নামটিই মনে ধরে সকলের।
মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারতই-
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যখন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হতে চাইছিল, সেই সময় পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারতই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। শুরু হয় নির্বিচারে গণহত্যা। বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ ও সংখ্যালঘুদের রাতের অন্ধকারে খুন করা হয়। ১৯৭০-র সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকেও অস্বীকার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবর রহমানকে। এরপরই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় পূর্ণমাত্রায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনার সামনে যখন দুর্বল হয়ে পড়ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সেনা, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। মিশন ক্যাকটাস লিলির অধীনে ভারতীয় সেনাও মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়। ডিসেম্বর মাসে অবশেষে ভারতীয় সেনার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। দুই টুকরো হয় পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে যেভাবে কমল হিন্দু জনসংখ্যা-
১৯৪১ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে জনসুমারির সময় হিন্দুদের জনসংখ্যার হার ছিল ২২.০৫ শতাংশ। এরপর লাগাতার কমতেই থাকে হিন্দু জনসংখ্যা। ১৯৬১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮.৫০ শতাংশে, ১৯৭৪-এ তা ১৩.৫০ শতাংশে নেমে দাঁড়ায়। ২০০১ সালে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমতে কমতে ৯.৬০ শতাংশে পৌঁছয়। ২০১১ সালে তা ৮.৫৪ শতাংশে পৌঁছয়। ২০২২ সালে, শেষ জনসুমারির সময় বাংলাদেশে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৭.৯৫ শতাংশে।
ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়স ফ্রিডমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবথেকে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে হিন্দুরাই। ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ লক্ষ কমে গিয়েছে। বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালরকাটি, পিরোজপুর, ভোলা, নারাইল, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জে হিন্দুদের যে বড় জনবসতি ছিল, তা দ্রুত কমতে থাকে। গোপালগঞ্জ, দিনাজপুর, সিলেট, ময়মনসিং, খুলনা, যশোর, চট্টগ্রামে এখনও হিন্দু জনবসতি থাকলেও, তা ক্রমাগত কমছে। ঢাকাতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা হিন্দুদের।
কেন চলে আসতে হল হিন্দুদের?
বাংলাদেশে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমার অন্যতম কারণ হল গণহত্যা, ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ধর্মীয় হিংসা। ধর্ষণকে কার্যত অস্ত্রের মতো ব্যবহার করতে শুরু করে পাক সেনা। আল বাদর, আল শাম, রাজাকার, মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলামিরা বারংবার আঘাত হেনেছে হিন্দুদের উপরে। দেশভাগের সময়, ইস্ট বেঙ্গল ইভাকিউ অ্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশের ধনী হিন্দুরা জমিজমা ও সম্পত্তি খোয়ান। মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষেরা রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যান। তাদের কাছে দেশ ছেড়ে চলে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বাংলাদেশ ভাগের সময় বহু হিন্দুই সীমান্ত পেরিয়ে অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অংশে একটা বড় অংশ বাংলাদেশিরা রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে অত্যাচার, নিগ্রহের শিকার হয়ে ভারতে চলে এসেছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অন্যতম ইস্যু ছিল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যু।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও পাক সেনা হিন্দুদের শত্রু বলেই চিহ্নিত করেছিল এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার সময়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি বাসিন্দা ভারতে ঠাঁই গোঁজার চেষ্টা করেন। এরমধ্যে ৮০ শতাংশই হিন্দু ছিলেন।
বাংলাদেশে কেন গর্জে উঠল হিন্দুরা?
গত অগস্ট মাসে গণআন্দোলনের মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার ইস্তফা এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার পর, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার বাড়তেই থাকে। দিনের পর দিন এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরেই, বাংলাদেশের হিন্দুরা গর্জে ওঠেন। প্রতিবাদে নামেন পথে। সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, যাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে ইউনূস, তিনি হিন্দুদের মিছিল থেকে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, বাংলাদেশে হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংসদীয় ও প্রশাসনিক স্তরে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব চাই। হিন্দুদের সংখ্যালঘু তকমা দেওয়ার দাবিও জানান তিনি। জানান, বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হচ্ছে না কারণ তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে আলাদাভাবে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য। বাংলাদেশে হিন্দু ও সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত ও নিরাপদ, অন্তর্বর্তী সরকার বারংবার এই দাবি করলেও, তা বাস্তবে কতটা সত্যি, ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভারত সরকার হিন্দুদের সুরক্ষা নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন সহ একাধিক দেশও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং হিন্দুদের নিরাপত্তার দাবি করেছে।